মেক্সিকানরা নিশ্চয়ই অনেক আশা নিয়ে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বামপন্থী নেতা আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। তারা নিশ্চয়ই চান, তাদের দেশটিতে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য কমবে, থাকবে না সহিংসতা।
কোনো সন্দেহ নেই, এসব আশা নিয়েই তারা ওব্রাদরকে ভোট দিয়েছেন, নেতা নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কি সহজ হবে?
তবে পরিবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী দেশটির টেপিটো শহরের মানুষ। টেপিটোকে বলা হয় মেক্সিকোর সবচেয়ে দরিদ্র এবং একইসঙ্গে বিপদজনক একটি শহর। মেক্সিকো সিটির পাশেই এর অবস্থান। কিন্তু রাজধানীর এত কাছের শহর হয়েও টেপিটোতে গেলে যে কেউ খালি চোখেই দেখতে পাবেন, শহরটিতে এখনো উন্নয়নের ছোঁয়াই লাগেনি। তাই এখানকার প্রতিটি মানুষের চাওয়া একটাই - পরিবর্তন।
গত রবিবার মেক্সিকোর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখনো তার আমেজ রয়ে গেছে প্রতিটি স্থানে। টেপিটোর প্রধান মার্কেটটির সামনে পুলিশের কড়া পাহারা সেটাই জানান দেয়। তবে এমন থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেও রাস্তার পাশেই দোকান খুলে বসেছেন কয়েকজন। তাদেরই একজন হোরহে ডেরা।
হোরহে ডেরার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই। তাই শহরের ভালো-মন্দ নিয়ে বেশ ভাবেন তিনি। শহরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও তাঁর চিন্তার শেষ নেই। তিনি বলেন, "আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, টেপিটোয় ভালো কিছু টিকিয়ে রাখা কঠিন। কেননা এখানে স্থানীয় মাস্তানদের দৌরাত্ম্যে কিছু করা যায় না। মাস্তানরা নিজেদের গ্যাংয়ের নাম দিয়েছে ''ইউনিয়ন''। অথচ তারা অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে। এতে আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। তবে এর বেশি আমি কিছু বলতে পারবো না। ভয় হয়, যদি তারা জেনে যায় আমি তাদের নিয়ে কথা বলছি, তাহলে তারা আমাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে।"
হোরহে ডেরার ভয়টা স্বাভাবিক। কারণ, মাত্র গত বছরই তার ছেলেকে এসব গ্যাংয়ের হামলায় জীবন দিতে হয়েছে। একদিন তার ছেলে বাড়ি ফেরার সময় গ্যাংয়ের সদস্যরা মাঝপথে তার রাস্তা আটকায়। পরে তাকে খুন করে গাড়িটা নিয়ে যায়।
এমন আরো নানা ঘটনা টেপিটো শহরের ''নিয়মিত বিষয়''। তারপরও জন্মস্থানের প্রতি মায়া থেকে এখানেই থাকছেন হোরহে ডেরা।
ডেরার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও প্রতিবেশী এবং ফুটপাথ দোকানি গ্লোরিয়াও এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, "আমি রাস্তার পাশে ছোট একটা খাবারের দোকান চালাই। সব মিলিয়ে দিনে ৪শ থেকে ৭শ পেসো আয় হয়, ডলারের হিসাবে যা ২০ থেকে ৩৫ ডলারের মতো। ভাবতে পারেন, এই টাকায় কিভাবে সংসার চালাই! কিন্তু আমরা গরিব। আমাদের কিছু করার নেই।"
গ্লোরিয়ার তিন সন্তান - দুই মেয়ে, এক ছেলে। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি কখনোই চান না তারা টেপিটোতে বেড়ে উঠুক। এজন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের এমন কোথাও পাঠাতে, যেখানে তাদের এই অস্থিরতা স্পর্শ করতে পারবে না। যেখানে তারা ভালো জীবন পাবে, ভালো ভবিষ্যৎ পাবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ভালো জায়গা। মিসেস গ্লোরিয়ার আশা, তাঁর সন্তানরা একদিন সেখানে যেতে পারবে।
মেক্সিকোর নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে মিসেস গ্লোরিয়ার দাবি একটাই - তিনি যেন নিজের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করেন। যেন দেশের উন্নয়ন হয়। দেশের ছেলেমেয়েরা যেন দেশের ভেতরেই ভালো কাজের সুযোগ পায়। জীবনে কিছু হয়ে উঠতে পারে।
তবে মেক্সিকোবাসী যা আশাই করুক না কেন, এটা সত্যি যে, দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে এ ধরণের কো্নো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। হবে কিনা, সেটাও অনিশ্চিত।
মিস্টার ডেরা টেপিটোতে দীর্ঘদিন ধরে একটি বক্সিং জিম পরিচালনা করে আসছেন। সেখানে তিনি কয়েক বছর ধরে বহু মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি আশা করেন, খেলাধুলার প্রতি তরুণদের উৎসাহিত করতে পারলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। তাই তার কাছে এটা নিছক কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নয়, বরং তরুণদের অনিশ্চিত বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচার ছোট একটা পথ।
তিনি বলেন, "এখানে নতুন প্রজন্মের অনেককে আমি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। অনেক ছেলে আছে যাদের হাতে মাত্র ১২ বছর বয়সেই বন্দুক পৌঁছে যায়। তাদের অনেকেই আমার এখানে আসে। বন্দুকটা লুকিয়ে রাখলেও আমি বুঝি। আমার কিছু করার নেই। তবে আমি চেষ্টা করি ভালমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অপরাধের জগত থেকে বের করে আনতে।"
যেদেশে দারিদ্র্য ও সহিংসতার এমন পাশাপাশি অবস্থান, সেদেশে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা পর্বততুল্য চ্যালেঞ্জ। প্রেসিডেন্ট ওব্রাদর ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু সফল হন - সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]