শিরোনাম
সিরিয়া সঙ্কটে কার কী এজেন্ডা
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:২৯
সিরিয়া সঙ্কটে কার কী এজেন্ডা
সুমন দত্ত
প্রিন্ট অ-অ+

সিরিয়ায় সঙ্কট এখন বিশ্বশক্তিগুলোর লড়াইয়ের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি সিরিয়ার পূর্ব ঘৌতা ও দুমাতে রাসায়নিক হামলা হলে তার জবাবে ব্রিটেন ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে সিরিয়ার সরকারি স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালায়। জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে এই হামলা চালানোয় রাশিয়া একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলেছে। অন্যদিকে ফ্রান্সে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র একে সঠিক বলে মন্তব্য করেছে। ভবিষ্যতে রাসায়নিক হামলা হলে এমন হামলা আরো চালানো হবে বলে তারা মন্তব্য করে।


সিরিয়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি করেছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে রেজিম চেঞ্জ নিয়ে সাবেক মার্কিন শাসক জর্জ ডাব্লিউ বুশের এজেন্ডার শিকার সিরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ একজন স্বৈরাচার। কারণ দীর্ঘদিন তিনি ক্ষমতায় আছেন। এই যদি হয় যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি তবে সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এসব দেশের শাসকরা আরো বড় স্বৈরাচার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেন কখনই এসব দেশে তাদের রেজিম চেঞ্জের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না।


মধ্য প্রাচ্যের এসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে এসব দেশের শাসকরা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের কাছে হালাল। এদের পরিবর্তনের কোনো দরকার নেই। অন্যদিকে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ যুক্তরাষ্ট্রের কথামত চলে না, থাকে শুধু রাশিয়ান ব্লকে, তাই তাকে সরে যেতে হবে। যেটা ইরাকে সাদ্দামের ক্ষেত্রে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই রেজিম চেঞ্জের রোগই গোটা মধ্য প্রাচ্যকে উত্তপ্ত করে তুলছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বুশের এই পলিসি থেকে পুরোপুরি সরে আসতে পারেনি। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া নিয়ে এতটা আগ্রাসী কখনই ছিল না। ইরাকে সাদ্দাম পতনের পর যে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আজকের সিরিয়া সমস্যা।


ইরাকে সাদ্দাম ছিল সুন্নি গোষ্ঠীর শাসক। সেখানে শিয়া ও কুর্দি গোষ্ঠীরা ছিল তাদের অধীন। বর্তমানে তা হয়ে যায় উল্টো। এখন ইরাকের মালিক শিয়া ও কুর্দিরা। আর সুন্নিরা তাদের অধীন। আর এই অধীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহায়তায় জন্ম নেয় আইএস তথা ইসলামিক স্টেট। সুন্নি এই জঙ্গি গোষ্ঠী ইরাকের মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারের কাছ থেকে সব ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। আর এই জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দেয় সাদ্দামের সাবেক সেনারা ও সমর্থকরা। জঙ্গি এই গোষ্ঠী প্রতিবেশী সিরিয়া গিয়ে সেখানকার আসাদ বিরোধীদের সঙ্গে তাল মেলায়। আর তাতে প্রতিরোধ করতে গেলে সিরিয়া হয়ে যায় রণক্ষেত্র। লোকজন হয় গৃহহারা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চাভিলাষী রেজিম চেঞ্জ এজেন্ডা পরিত্যাগ করা হলে আজকে সিরিয়ায় এই মানবিক সঙ্কট দেখা যেত না।



রাশিয়া ও ইরানের মত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বুঝতে পেরে সিরিয়ার শাসককে সমর্থন করে যাচ্ছে। তাদের এই সমর্থন মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী। এটা বুঝতে পেরেই সিরিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট জঙ্গিদের দিয়ে চালানো হয় রাসায়নিক হামলা। রাসায়নিক হামলার টাইমিং দেখেই বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের উদ্দেশ্য কি ছিল। সিরিয়া আইএস বিরোধী যুদ্ধ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। রাশিয়ার সহযোগিতায় সিরিয়ার একের পর এক নগরী যখন আইএস মুক্ত হচ্ছে তখনই সিরিয়ায় শুরু হয় রাসায়নিক হামলা। কারণ পুরো সিরিয়া যদি রাশিয়ার সমর্থিত শক্তির কাছে চলে যায় তবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কি হবে? সিরিয়ার রেজিম চেঞ্জের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই শেষ সময়ে সিরিয়ার পলায়নপর নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক হামলা।


এর আগে বিশ্ববাসী দেখেছে ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে কি ধরনের মিথ্যাচার করেছিল। সেই মিথ্যাচারের ওপর ভর করে ইরাকে হামলা চালায় বুশ-ব্লেয়ার। পরে ইরাকে গিয়ে কোনো রাসায়নিক অস্ত্র পায়নি তারা। আর এদিকে ইরাকে মার্কিন ব্রিটিশ হামলায় মারা যায় লক্ষাধিক লোক। ঠিক একইভাবে সিরিয়াতে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে। সিরিয়ায় যেখানে একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে নিশ্চিত হয়ে বলে পূর্ব ঘৌতায় ও দুমাতে রাসায়নিক হামলার সঙ্গে আসাদ বাহিনীই জড়িত। সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী একা যুক্তরাষ্ট্র শুধু নয়। সেখানকার কুর্দিরা আসাদ বিরোধী। সেখানকার সুন্নিরা আসাদ বিরোধী। সিরিয়ায় একেকটি পক্ষ একেকটির সঙ্গে বিবাদে জড়িত। সিরিয়া সঙ্কট এখন একাধিক রুপ নিয়েছে।


মোটা দাগে সিরিয়ায় কুর্দি, সুন্নি, আসাদ বাহিনী তিনটি পক্ষ। সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স, ওয়াইপিজি এরা সিরিয়ায় কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে লড়াই করছে দীর্ঘ দিন ধরে। তাদের লক্ষ্য সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন কুর্দিস্তান গঠন করা। আর স্বাধীনতাকামী এই কুর্দিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইরাক ও তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহীরা। আর এতেই সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্কের মাথা ব্যথা। তুরস্ক তার সীমান্তে কখনই কুর্দি দেশ মেনে নেবে না। তুরস্ক নিজেদের স্বার্থে সিরিয়ার কুর্দিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। আফরিন ও মানভিজে তারা অভিযান শুরু করেছে। এতদিন কুর্দিদের বিরুদ্ধে যেতে আইএসকে মদদ দিয়েছে তুরস্ক। তাই দেখা যায় বিদেশ থেকে যেসব আইএস সিরিয়ায় এসেছে তারা তুরস্কের ইস্তাম্বুল দিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। আবার সেই পথেই দেশে ফিরে যায় তারা।


আর তুরস্কের এই ভূমিকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে চেষ্টা করেছিল একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান করাতে। যেটি বিফল হয়। তুরস্ককে চাপে রাখতে কুর্দিদের সেনা ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আগামী দিনে সিরিয়া নিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধে জড়াবে না, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।


অন্যদিকে সিরিয়ার সুন্নিরা ইসলামিক স্টেটের অধীনে পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এই সুন্নি গোষ্ঠীর পতাকা তলে যোগ দিয়েছে ইরাক থেকে আসা জঙ্গিরা, বিদেশি জঙ্গিরা, আল নুসরা ফ্রন্ট। সিরিয়ায় আল-কায়দার নামই হচ্ছে আল নুসরা ফ্রন্ট। এদের আবার আইএসআইএস বলা হয়। খেলাফতের নামে তারা আসাদ সরকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আর আইএস বিরোধী যুদ্ধ করায় এতদিন আসাদ সরকার ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনকে কাছে পেয়েছে। এখন আইএস মৃত কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। তাই আসাদ সরকার এখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে আগের মত পাচ্ছে না। শুরু হয়েছে স্বার্থের সংঘাত।



এদিকে ইসরায়েল সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর উপস্থিতি কখনই মেনে নেবে না। আসাদ সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ারা। এদের সঙ্গে ইরানের বিপ্লবী পার্টির সেনারাও আছে। তাই ইসরায়েল হিজবুল্লাহ ও ইরান বিরোধী যেকোনো শক্তিকে সহায়তা করবে। এটাই ইসরায়েলের নীতি। আইএসকে পেছন থেকে যে কয়টি দেশ মদদ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল তার মধ্যে ইসরায়েল একটি।


এখন সিরিয়ায় আইএস প্রায় শেষ তাই ইসরায়েলকে এখন বাধ্য হয়ে রণক্ষেত্রে নামতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সিরিয়া অভিযান চালাতে গিয়ে ইসরায়েলের কয়েকটি জঙ্গি বিমানও খোয়াতে হয়।


সিরিয়ায় এখন বাশার আল আসাদকে হারানো সহজ নয়। রাশিয়ার মদদ বন্ধ করতে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র গুপ্তচর হত্যার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। এদিকে আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক হামলারও অভিযোগ দাঁড় করায় তারা। যাতে বিশ্ববাসীর কাছে মনে হয়, সিরিয়া ও রাশিয়া কুখ্যাত দুটি দেশ লোকজনকে রাসায়নিক দিয়ে মারছে। তবে রাশিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সিরিয়া আসাদ বিরোধী যেকোনো শক্তিকে মোক্ষম জবাব দেয়া হবে। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এটাও বলেন, সিরিয়ায় তার দেশের সেনারা যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয় তবে রাশিয়া সেই সব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করবে, যেখান থেকে এসব হামলা হয়। যার ফলে সিরিয়ায় একদিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে পরদিনই তা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আগামী দিনগুলোতে আরো পরিষ্কার হবে সিরিয়া সঙ্কট কোন দিকে যাবে।


বিবার্তা/সুমন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com