শফী ভাই মারা গেছেন আওয়ামী লীগার হিসেবে। কিন্তু দেশজুড়ে তার পরিচিতি আসলে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় 'ছাত্রলীগ' নামে একাধিক সংগঠন ছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের পাশাপাশি জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগও বেশ জনপ্রিয় ছিল। তাই আলাদা করতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে ব্র্যাকেট বন্দি করা হতো। যেমন ছাত্রলীগ (সু-র) মানে সুলতান-রহমান বা ছাত্রলীগ (হা-অ) মানে হাবিব-অসীম আওয়ামী লীগ সমর্থিত। আবার ছাত্রলীগ (শি-মু) মানে শিরিন-মুশতাক, ছাত্রলীগ (না-শ) মানে নাজমুল-শফী; ছিল জাসদ সমর্থিত।
এরশাদ আমলে একবার দুই ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মিলে ডাকসুতে প্যানেল দিয়ে জয় পেয়েছিল। ভিপি হয়েছিলেন আওয়ামী ছাত্রলীগের সুলতান মনসুর, জিএস জাসদ ছাত্রলীগের মুশতাক আহমেদ, এজিএস ছাত্র ইউনিয়নের নাসিরউদ দোজা। তখন মাঠ ছিল উত্তাল, আন্দোলনমুখর। এটা মানতেই হবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্বটা ছিল ছাত্রদের হাতে।
'৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে '৯০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা ধাপে ছাত্ররাই সামনে থেকে লড়াই করেছে। '৯০-এর ১০ অক্টোবর শহীদ জিহাদের লাশ সামনে রেখে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়েছিল। এই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন শফী আহমেদ। ছোটখাটো গড়নের হলেও মিছিলে, মিটিংয়ে, স্লোগানে, লড়াইয়ে শফী ভাই সবসময় সামনের কাতারেই থাকতেন।
তবে শফী ভাইয়ের আসল কৃতিত্ব ছিল কৌশল প্রণয়নে। ছাত্রঐক্যের বৈঠকে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মসূচি নির্ধারণ, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দারুণ পারঙ্গম ছিলেন তিনি। আন্দোলন নস্যাৎ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের নানা কৌশলও নস্যাৎ হয়ে যেত শফী ভাইয়ের পাল্টা চালে।
ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল অধ্যায় শেষে জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন শফী আহমেদ। জাসদ হয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তবে আওয়ামী লীগ থেকে কিছু পাননি তিনি। ছাত্রলীগের কমিটিতে তার সভাপতি নাজমুল হক প্রধান জাসদে থেকেই এমপি হয়েছেন। কিন্তু শফী ভাই আওয়ামী লীগে এসে মনোনয়নই পাননি। একেবারে পাননি বললে ভুল হবে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে সেবার নির্বাচনই হয়নি। এরপর ৪টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা জয় পেয়েছে, কিন্তু শফী ভাইয়ের কপালে আর মনোনয়ন জোটেনি। মনোনয়ন না পেলেও রাজনীতি ছাড়েননি তিনি, ছাড়েননি এলাকার জনগণকেও।
নেত্রকোণার হাওরের মানুষ তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। মনোনয়ন না পেয়ে শফী ভাই যতটা বঞ্চিত হয়েছেন, তার মত তীক্ষ্ণ মেধার একজন মানুষকে কাজে লাগাতে না পারায় আওয়ামী লীগের ক্ষতিও কম নয়। অবশ্য আওয়ামী লীগে এখন স্মার্ট হাইব্রিড নেতাদের দাপটে শফী ভাইয়ের মত মাটি-মানুষের নেতা বড্ড বেমানান। শফী ভাইদের থাকা না থাকায় কিচ্ছু যায় আসে না। শফী ভাইয়ের বুক ভরা অভিমান ছিল; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। বুক ভরা অভিমান নিয়েই দুপুরে ঘুমের মধ্যে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে চির ঘুমের দেশে চলে গেলেন শফী আহমেদ।
শুরুতে যেমনটা বলেছি, আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তার পরিচিতি ছিল জাসদ হিসেবেই। শফী ভাইয়ের মৃত্যুর পর গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাসদ বা জাসদ ছাত্রলীগ নেতাদের হাহাকারই বেশি কানে আসছে। শফী ভাই হয়তো পুরোপুরি আওয়ামী লীগার হতেই পারেননি।
* মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শফী আহমেদের মরদেহ রাখা হবে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধার জন্য।
লেখক : প্রভাষ আমিন, লেখক ও সাংবাদিক।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে)
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]