১০ বছর আগে কেন মাসুদকে মেরে ফেললেন না?
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:১৮
১০ বছর আগে কেন মাসুদকে মেরে ফেললেন না?
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে আটটার দিকে ঘুম ভাঙে। ক্লাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এরই মধ্যে আমার কাছে ফোন এলো যে সকাল ৮ টার দিকে জিয়াউর রহমান হল ও শহীদ হবিবুর রহমান হলের মাঝামাঝি জায়গায় ফোকলোর বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক টগর এবং ইতিহাস বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ সদস্য আব্দুল্লাহ আল মাসুদের রগ কেটে দিয়েছে।


যেহেতু আমি সেই সময় বিডিনিউজের প্রতিনিধি ছিলাম, তাই দ্রুততার সাথে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তথ্যের ক্রস চেকিং করে নিউজটি যখন লিখতে বসলাম, তখন ওই হামলার দু'টি ছবি পেলাম, তা দেখার পর আমি আর কোন শব্দ লিখতে পারছিলাম না। কতটা নৃশংস হতে পারে, তা ওই ছবি যারা দেখেছিলেন, তারা জানে।


একটি ছেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, আর তার পায়ের গোড়ালি পা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশেই পড়েছিল। প্রায় এক ঘণ্টা পর নিউজটি লিখে অফিসে পাঠলাম, সম্ভবত বিডিনিউজই প্রথম ব্রেক করেছিল। কিন্তু আমরা সেই ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারিনি, কারণ সেটি প্রকাশযোগ্য ছিল না।


এই যে পা হারানো ছেলেটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, যাকে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। মাসুদের আপন বড় ভাই ছাত্রলীগের নেতা ছিল, সেই তুলনায় মাসুদ কেবলই একজন সাধারণ ছাত্রলীগের কর্মীই ছিল। ওই ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তেমন কিছু পেলাম না, তবে সেই সময় অনেকেই বলেছিল, ওই ঘটনার কয়েকদিন আগে আমার বিভাগের এক জুনিয়র মাদার বখশ হলের শিবির সভাপতি ওয়ালিউল্লাহ ওলিকে মারধরে শিকার হয়েছিল, ওই আক্রোশে মাসুদ-টগর মামলার শিকার হয়।


ওই হামলার ঘটনায় করা মামলায় ১১ দিন পর র্যাব-৫ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান মৈইফুল নামের ওই শিবির নেতাকে আটক করেছিল, যা আমরা ওইসময়ই নিউজ করেছিলাম।


এরপর আমি দেশের বাহিরে এলাম। পরে শুনলাম মাসুদ স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। তাকে কৃত্রিম পায়ের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। কয়েক বছর আগে ফেইসবুকে হঠাৎ মাসুদের একটি মেসেজ পেয়েছিলাম। সে সেই সময় বলল, ভাই আমি মাসুদ আপনি আমাকে চিনেছেন নিশ্চিয়। পা হারানোর পর আমাকে কেউ চাকরি দেয় না, আমি মানবেতর জীবন যাপন করি। এই কথাগুলো শোনার পর আমি সত্যিই অসহায় বোধ করি।


পা হারানোর পর সে আর কখনোই সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরেনি। পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন সংগ্রাম করছিল ছেলেটি। দ্বারে দ্বারে একটি চাকরির জন্য ঘুরেছে। এরই মধ্যে ২০২২ শেষের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরি হয়। সংসারী হয়। গত সপ্তাহে নিজের ফুটফুটে এই বাচ্চাটির বাবা হয় সে।


কাল রাতে যখন ওর মারধর করার ভিডিওটি পেলাম, তা দেখার পর বিশ্বাস করেন, একটি মিনিটির জন্য হলেও শান্তি পাইনি। ঘুমাতেও পারিনি। ওরা কতটা বর্বর, নৃশংস হলে একজন পঙ্গু ছেলেকে মারতে মারতে মেরেই ফেলতে পারে?


যে ছেলেটি প্রায় ১০ বছর ধরেই অধঃমৃত ছিল, সেই পঙ্গু ছেলেটি যখন সবকিছু ফেলে নিজের জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত, সেই ছেলেটি আপনাদের ঠিক কী অপরাধ করেছিল, যার কারণে আপনারা এই শিশুটিকে পিতৃহারা করলেন? সেকি ফের রাজনীতিতে ফিরে আপনাদের ক্ষতি করেছিল তার প্রতি আপনাদের কি ক্ষোভ ছিল, দয়া করে একটু বলেন?


একজন বাবা তার সন্তানের জন্য দুধ/ওষুধ কিনতে গিয়ে আপনারা তাকে পরিকল্পিতভাবে 'হত্যা' করলেন, মৃত্যুর পর আপনারা আল্লাহর কাছে সেই জবাবদিহি করতে পারবেন তো? তাকে যদি মেরে ফেলে আপনাদের খায়েস থাকত, তাহলে এই দশ বছর আগেই সেটা করতেন, এতোদিন ধরে ছেলেটাকে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন সংগ্রাম করতে হতো না, এমন বাচ্চাটাকে বাবা হারা হতো না। ১০ বছর আগে যদি মারতেন, তাহলে ওর পরিবারকে এমন কঠিন বোঝা বহন করতে হতো না।


জানি এই হত্যার বিচার রাষ্ট্র কখনোই করবে না, এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসুদের সহকর্মীরাও বিচার চাইবে না, তবে বলে রাখি যারা আজ 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র' ছাতায় হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করলেন, তারা চব্বিশের এই অর্জনকে আর একবার কালিমালেপন করলেন মাত্র।


ধিক্কার আপনাদের পশুত্বকে, ধিক্কার আপনাদের অন্ধত্বকে!


লেখক: সাংবাদিক নাদিম মাহমুদ


(ফেসবুক ওয়াল থেকে)


বিবার্তা/এসএ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com