অন্যায় দেখে কথা না বলতে পারলে আপনি আবার মানুষ কিসের
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ২২:১৮
অন্যায় দেখে কথা না বলতে পারলে আপনি আবার মানুষ কিসের
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

গতকাল রাত প্রায় ১টার দিকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। এত রাতে বিমানবন্দর থেকে বের হলে বাড়ি যাওয়ার জন্য সাধারণত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায় না, সিএনজি বা রিক্সায় করেই বাড়ি যাই। কিন্তু গতকাল বিমানবন্দর ওভার ব্রিজের নিচেই 'ভিক্টর ক্লাসিক' এর একটা রানিং বাস পেয়ে গেলাম। বাসে উঠে তেমন মানুষ দেখতে পাইনি, চেহারায় হালে বখাটে টাইপ একটা ৮-৯ জনের গ্রুপ বাসের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিল।


তাদের ছাড়া আমরা যাত্রী ছিলাম ৪ জন, এই ৪ জনের মাঝে দুইজন অল্প বয়সের মেয়ে ছিল, ঘটনার পরবর্তী অবস্থায় জানতে পারি উনারা বান্ধবী। বাসে উঠার পরই ড্রাইভার জিজ্ঞাস করতাছে মামা কই যাইবেন? আমি উত্তরে বললাম খিলক্ষেত যাব। তখন ড্রাইভার জোড়ে বললো- খিলক্ষেত যাইব সমস্যা নাই। আমি বাসে উঠাতে যেন অখুশি তারা। কিছু বুঝে উঠতে পারিনি তখনো। বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত আসতে স্বাভাবিক সময় লাগে আমার ৮-১০ মিনিট। এই অল্প সময়ে ছেলেগুলোর ভয়াবহ আচরণ আমি দেখছিলাম, হতবাক হয়ে ছিলাম। বাসে ২টা মেয়ে ভয়ে চুপসে ছিল। বাসে উঠার পর থেকেই আমি দেখছি ওই ছেলেগুলো একদম ভয়হীনভাবে মেয়ে দু'টোকে লাগাতার হ্যারাসমেন্ট করেই যাচ্ছে। বিভিন্ন নোংরা গান গাইছে, তাদের মধ্য থেকে একটা ছেলে কন্টিনিয়াসলি তার সিট ছেড়ে উঠে মেয়েদের সিটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, গরম লাগছে উছিলা দিয়ে তাদের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা ছেলে হাতে সুইচ গিয়ার (এক ধরনের ছুড়ি) ঘুরাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এ কোথায় আছি। রাস্তা একদম খালি। মেয়েগুলো ভয়ে বাস থেকে নামতেও পারছে না, কারণ রোজার কারণে কাওলা থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তা একদম ফাঁকা। বাসে আমি ছাড়াও আরেকজন সাধারণ যাত্রী ছিল। সে এমনভাবে আছে যে সে কিছুই দেখছে না। এমন পরিবেশে আমি বাসে যে আরেকজন যাত্রী ছিল তার কাছে গিয়ে বসলাম। তাকে জিজ্ঞাস করলাম, ভাই কই যাবেন? উনি বললো রামপুরা যাবে। আবার জিজ্ঞাস করলাম বাসে হচ্ছেটা কী? আপনি কখন থেকে এমনটা দেখছেন? ভদ্রলোক আমাকে খুব ফিসফিস করে বললো, সে আব্দুল্লাহপুর থেকে বাসে উঠেছে। এটা রেগুলার বাস না। এই রাতে ড্রাইভার নিজের আলাদা আয়ের জন্যে গাড়ি বের করে থাকে। আমি বললাম মেয়েগুলো বাসে কখন উঠেছে? উনি জানাল মেয়েগুলো উত্তরা থেকে বাসে উঠেছে। আমাকে সাবধান করে বললো, ভাই যা হচ্ছে হোক কিছু বইলেন না। সবগুলা নেশাগ্রস্থ। পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়েগুলো ভয়ে নতজানু অবস্থা। ইতিমধ্যে আমার গন্তব্য পার হয়ে বাস কুড়িল ফ্লাইওভারে- আমি ইচ্ছে করে বাস থেকে নামিনি। এই অবস্থায় কিছু একটা করতে হবে সেই ইচ্ছা নিয়ে আমি বাসেই রয়ে গেলাম। ড্রাইভার প্রশ্ন করল, এই মামা আপনি নামলেন না কেন? আমি বললাম, আমার রামপুরায় কিছু কাজ আছে- আমার যেতে হবে।


বাস চলছে আর ওরা কুকুরের মত পিছন থেকে আরো কয়েকজন যুক্ত হয়ে মেয়েগুলোকে উত্ত্যক্ত করার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফ্লাইওভার থেকে যমুনা পর্যন্ত রাস্তা পুরোটাই নীরব থাকে। যমুনার সামনে মানুষজন থাকবে এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। তাই ফ্লাইওভারে থাকাকালীনই সাহস নিয়ে আমি মেয়েগুলোর পাশের সিটে গিয়ে বসি। তাদের জিজ্ঞাস করলাম আপনারা কোথায় যাবেন আপু? বললো, ভাইয়া আমরা ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। উত্তরায় বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিল- ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছে, তারা বাড্ডায় যাবে। আমি খুব শক্ত গলায় সবাইকে শুনিয়ে বললাম, আপু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ছেলেগুলোর শরীর থেকে মদের দুর্গন্ধ আসছিল। তারা এতই মাতাল ছিল মেয়েগুলোর সাথে কথা বলার সময় একটা ছেলে এসে আমার কলারে হাত দিলো। গালি দিয়ে বলল কী বুঝাইতে চাস? আমরা খারাপ পোলা? আমরা কি কিছু করছি? যেহেতু আমি তামিল মুভির হিরো না, সেই হিসেবে আমি চুপ করে রইলাম। ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে ট্রাকের একটু জ্যামে পরলাম। যারা এই রোড দিয়ে আসা-যাওয়া করেন তারা জেনে থাকবেন রাস্তাটা কতটা নীরব।


আমি ৯৯৯ এ কল করার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু কল করলে ওরা শুনে ফেলবে। আর একটু অপেক্ষা করলে আমি যমুনার সামনে চলে গেলে মানুষজন পেয়ে যাব। আমি যমুনা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই ভালো মনে করলাম। ছেলেগুলো গায়ে পরে ঝগড়া করতে আসছে আমার সাথে, মেয়েগুলোকে খারাপ ভাষায় কথা বলা, গায়ের উপরে পরে যাওয়া- এমনসব নোংরা কাজগুলো করছিল। আমি কোন উত্তর না দিয়ে বসে রইলাম। বাস যমুনার কাছাকাছি আসতে দেখলাম সামনে অনেক মানুষজন। এর মধ্যে বাসে ৫-৬ জন যাত্রী উঠে গেল। আমি ওই মুহূর্তে সিট থেকে উঠে এতক্ষণ যা সহ্য করেছি তার সবটুকুন রাগ নিয়ে ড্রাইভারকে কষায়া একটা চড় দিয়া বললাম গাড়ি থামাতে। সাহস নিয়ে এমন না করলে গাড়ি থামাবে না বা আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য হলেও ও গাড়িটা থামাবে। ও গাড়ি থামিয়ে আমার উপর চড়াও হলো। ওর সাথে গাড়ির সাধারণ যাত্রীরা বলছিল আপনি মিয়া ড্রাইভারকে মারলেন কেন, আপনি কে? আমি মেয়েগুলার সামনে গিয়ে বললাম আপু নামেন গাড়ি থেকে। কোন ভয় নাই, এখানে অনেক মানুষ আছে। মেয়েগুলো একটা দৌঁড় দিয়ে বাস থেকে নেমে পরল। আমি গলা উঁচু করে অন্যান্য যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললাম, এই দুইটা মেয়েকে সেই বিমানবন্দর থেকে দেখছি এই ছেলেগুলা খারাপভাবে ডিস্টার্ব করছে। রাস্তায় কোন মানুষজন পাইনি তাই এদের সহ্য করেছি। অবাক হয়ে দেখলাম গাড়ির একটা যাত্রীও কিছু বলল না। ছেলেগুলা একদম চুপ হয়ে আছে। ওদের আচরণে বোঝার উপায় নেই ওরাই এতক্ষণ এগুলা করেছে। ড্রাইভার তাকে চড় মারার কারণে আমার উপর চড়াও হচ্ছে, আমি ড্রাইভারের কলার ধরে উচ্চস্বরে বলছি এগুলারে পুলিশে দিব। ওই মুহূর্তে এক যাত্রী বলে বসল, ভাই বাসায় যাইতে হইব এই মাঝ রাতে আপনি ভেজাল কইরেন না। এক মুরুব্বি বলে উঠল, এত রাইতে মাইয়্যা মানুষ বাসে কী করে? আমি বুঝলাম এই আহাম্মকদের সাথে তর্ক করে লাভ নাই।


যেহেতু ড্রাইভার আর ওরা মিলিত সবাই গাড়ির স্টাফ, আমিতো আর সবাইকে ধরতে পারবো না। আমি ড্রাইভারের কলার ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামালাম। নিচে মেয়েগুলো অঝোরে কান্না করছিল। বাস থামানো অবস্থায় আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ রহমতে পুলিশের দুইজন সদস্য ভাটারা থানার দিকে যাচ্ছিল বাইকে। তারা এমন হট্টগোল দেখে বাইক থামিয়ে আমাদের কাছে আসল। আমি তাদের কাছে আমার পরিচয় দিয়ে ঘটনা বললাম। আমার হাত তখনো ড্রাইভারের কলারে। মেয়েগুলা এমনভাবে কাঁদছিল যে ওদের সাথে কথা বলা যাচ্ছে না। স্বাক্ষী হিসেবে শুরু থেকে বাসে থাকা যে সাধারণ যাত্রী ছিল- তাকে ডাকলাম। আহাম্মকটা সবার সামনে এসে বলছে আমি এগুলা কিছুই জানি না। আমি বাসে উঠে ঘুমিয়ে ছিলাম। মনে চাচ্ছিল ওদের বাদ দিয়ে ওরে আগে পিটাই। পুলিশ সদস্যরা বাস রাস্তার সাইডে নিল, এগুলো ঘটতে ঘটতে আরেক পাশের জানালা দিয়ে ছেলেগুলা সব পালিয়েছে। পুলিশ মেয়েদের কাছ থেকে ঘটনা শুনল, ড্রাইভার বলল ওরা গাড়ির স্টাফ পরিচয় দিয়ে উঠছে। আমি ভয়ে কিছু কইতে পারি নাই। কিন্তু তার এই বক্তব্য মিথ্যা, আমি নিজে দেখেছি ছেলেগুলা ওর পরিচিত। পুলিশ ড্রাইভার ও গাড়ি আটকাল, বলল আপনারা ভাটারা থানায় এসে কমপ্লেইন করলে আমরা ব্যবস্থা নিব। মেয়েগুলো রিপোর্ট করতে চাচ্ছিল না কোনভাবেই। তারা কান্না করে বলছিল, যা করছেন ভাই অনেক করছেন আমরা বাসায় যেতে চাই।


পুলিশ তাদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করলে আমি বাড়ি ফিরে আসি। এই পুরো ঘটনায় ড্রাইভার বা বখাটে ছেলেগুলার চেয়ে আমার বেশী রাগ হচ্ছিল ওই সাধারণ যাত্রীদের উপরে- যারা আমাকে বিন্দুমাত্র সহায়তা করেনি। যারা চোখ বন্ধ করে ছিল, উলটো আরো এত রাতে মেয়ে মানুষ কেন রাস্তায় থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছিল সবচেয়ে বেশি অপরাধী সমাজের এই এড়িয়ে চলা লোকজন। বেশীরভাগ মানুষই এদের মতন। এরা নিজেদের উপরে না আসলে সেটাকে সমস্যা মনে করে না। এরা প্রচুর স্বার্থপর হয়। আমি সবসময় এই মেকি ক্যাটাগরির মানুষজনকে এড়িয়ে চলেছি। আমার কাছে সমাজে এরাই সবচেয়ে বেশি অপরাধী।


যদি আমি আমার গন্তব্যে আগেই নেমে যেতাম? যদি আমি সাহস করে মেয়েগুলার সাথে কথা না বলতাম? বাস না থামাতাম? ভিন্ন কিছু ঘটতে পারত, পত্রিকায় দুঃখজনক কোন শিরোনাম আসতে পারত। কাল শাহবাগে হয়ত আপনারা আন্দোলনে নামতেন। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা হয়ত মিছিল সংগ্রাম করত। কিন্তু দূর্ঘটনাকে আর ঠিক করা যেত না। তাই বলি কি মেরুদণ্ডটা সোজা রাখুন। অন্যায় দেখে কথা না বলতে পারলে আপনি আবার মানুষ কিসের?


আর একটা পরামর্শ- সমাজের এই স্বার্থপর টাইপ মানুষ যারা নিজের উপরে না আসলে কথা বলে না তাদের এড়িয়ে চলুন। তারা সমাজের সবস্তরেই ভয়াবহ।


মানুষ থেকে মানুষ আসে। বিরুদ্ধতায় ভিড় বাড়ায়। তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ,তফাৎ শিরদাঁড়ায় । মেরুদণ্ড সোজা থাকুক।


(ফেসবুক থেকে নেয়া)


লেখক: রায়হান কবির।


বিবার্তা/এনএস


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com