
পর্যটনের রাজধানীখ্যাত কক্সবাজার শহর এখন টমটম-মিশুকের শহরই বলা চলে। ৩২.৯০ বর্গকিলোমিটারে এই ছোট্ট শহরের পৌরসভায় নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টমটম-মিশুক চলাচল করে। যাদের কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, নেই কোনো ট্রাফিক সিগন্যালবিষয়ক ন্যূনতম ধারণা। স্থানীয়দের পাশাপাশি চালকের আসনে রোহিঙ্গারাও রয়েছে বিশাল একটা অংশে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের ভাগ-ভাটোয়ারায় পৌর-প্রশাসকের নানা নাটকীয়তায় জেলা প্রশাসকের অনুমতিক্রমে নতুন করে আরো এক হাজার ৫শ টমটম লাইসেন্স ইস্যু করা হলেও স্থানীয় শহরবাসীর দাবির মুখে তা স্থগিত করা হয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ একটি টমটম লাইসেন্স সিন্ডিকেট স্থগিত করা লাইসেন্সগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় (পৌর প্রশাসকের ভাষ্যমতে) এবং সেই স্থগিত লাইসেন্সগুলো ব্যবহার করে শহরের প্রধান সড়কে টমটম চালানো হচ্ছে। পরবর্তীতে প্রশাসন স্থগিত করা লাইসেন্সগুলো বাতিল বা উদ্ধার করতে পারেনি অদৃশ্য কারণে।
সাম্প্রতিক সময়ে শহরের আলোচিত বিষয় টমটম-মিশুক। এই বাহনটি তিন চাকার সুবাদে যে কেউ এগুলো প্রধান সড়ক থেকে শহরের অলিগলিতে চালানোর সাহস করে। ফলে শহরে হুঁ হুঁ করে বাড়ছে টমটম-মিশুকের সংখ্যা। এই বাহনগুলোর চালক শ্রেণি অত্যন্ত গরিব হওয়াতে জেল জরিমানার আওতায় আনাও অসম্ভব। এই বাহনগুলোর আমদানিকারক শো-রুমের মালিকরা নগদে ও কিস্তিতে গাড়িগুলো কেনার সুযোগ দেওয়াতে এবং দামও হাতের নাগালে হওয়ায় যে কেউ তা কিনে সড়কে নেমে পড়ছে। কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই। টমটম-মিশুক ড্রাইভারদের মধ্যে বেশিরভাগ কিশোর শ্রেণির। স্থানীয়ভাবে মাদক পরিবহন ও ছিনতাই আর ডাকাতিতে এখন সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে টমটম-মিশুক। পর্যটক জিম্মি করা, অপহরণ, ছিনতাই আর নানা অপরাধে জড়িত টমটম-মিশুকের কিছু কিছু ড্রাইভার।
জেলা প্রশাসকের অনুমতিক্রমে কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে তিন হাজার টমটম লাইসেন্স প্রদান করলেও এখন পর্যন্ত নাম্বার প্লেট দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০০। তিন হাজার লাইসেন্স নিয়ে পৌরসভায় চলাচল করে প্রায় ৩০ হাজার টমটম-মিশুক। এই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক চার্জের ওপর নির্ভর। তাই জেলার জন্য বরাদ্দকৃত বিদ্যুতের বিশাল একটি অংশ ব্যাটারিচালিত এই টমটম-মিশুকই গিলে খাচ্ছে। ফলে লোডশেডিং এই জেলার নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্যাডেলচালিত রিকশার পরিবর্তে টমটম-মিশুক সড়কে নামানো হলেও এই গাড়িগুলোর পরিমাণ এখন এত বেশি যে শহরে প্রবেশ করলেই এখন যে কেউ বলে দেয় এটি টমটম-মিশুকের শহর। জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বারবার এই গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও অদৃশ্য কারণে তা কখনো বাস্তবায়ন হয়নি। লোক দেখানো কিছু কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও তা ছিল নামেমাত্র। অভিযান চালাতে গেলে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা আসে রাজনৈতিকভাবে। দলীয় মিটিং মিছিলে এসব পরিবহনের মালিক-চালকদের কর্মী হিসেবে ব্যবহার করতে ও নির্বাচনে শ্রমিকদের পাশে তারা আছেন এটা বুঝাতেই তারা বাধা দিয়ে থাকেন প্রশাসনের অভিযানগুলোয়। এছাড়া মালিক-চালক সমিতি বা সংগঠনের শহর অবরোধ বা ধর্মঘট ডাকের ঘটনা নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়। ফলে এই গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েও সফলতা আসছে না কোনোভাবে।
টমটম-মিশুক গাড়ি চালাতে কায়িক শ্রমের দরকার পড়ে না বলেই বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ এখন এই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। কৃষক, রাজমিস্ত্রি, জেলেসহ নানা শ্রমজীবী মানুষ এখন শহরে এসে টমটম-মিশুক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। ফলে ওই সব পেশায় লোক সংকট দেখা দিয়েছে।
ডিসেম্বর হতে শুরু হওয়া পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে বেপরোয়া টমটম মিশুক গাড়ির সংখ্যা সীমিতকরণের প্রস্তাব পর্যটন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ও ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে টমটম-মিশুক গাড়ির চালকদের মাধ্যমে। এদের সঠিক তালিকাভুক্তি ও সীমিতকরণ এবং প্রশিক্ষিত না করে সড়কে অবাধ বিচরণ করতে দিলে পর্যটক হয়রানির শিকার হওয়ার চরম আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে পর্যটক বিমুখের মতো পরিবেশ তৈরি হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
বিষয়টি নিয়ে বর্তমান পৌর প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (স্থানীয় সরকার) শাহীন আল ইমরানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন ও উদ্বিগ্ন। তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তা ছাড়া এই টমটম মিশুক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর নাছিমা আক্তার বকুল ও সাবেক কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুকুল বলেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং পৌরসভার মেয়রের চেয়ার বদলের সঙ্গে সঙ্গে টমটম মিশুক লাইসেন্সের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে সিন্ডিকেট করে অবৈধ আয়ের পথ সুগম করতে। এগুলো নিষিদ্ধ করা দরকার পৌর শহরকে আধুনিকায়ন ও যানজট কমানোর উপায় হিসেবে। ছিনতাই, অপহরণ রোধ করতে ড্রাইভার মালিকদের সুনির্দিষ্ট একটি ফ্রেমে এনে ডাটাবেজের মাধ্যমে ট্রাফিক বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভায় তাদের তথ্য সংগ্রহ করে রাখা উচিত বলে মনে করছি।
আগামী পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান স্থানীয় সচেতন মহল।
বিবার্তা/ফরহাদ/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]