
রাজধানীর গাবতলী হাটে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল এক গরু, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শাকিব খান’। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি সাদা রঙের গরু, নাম দেওয়া হয়েছে ‘পরীমনি’। আরেকটু সামনে এগুতেই চোখে পড়ল বড় আকৃতির সাদা-কালো আরেকটি গরু, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’! কেউ দাঁড়িয়ে থেকে এসব গরু দেখেন, কেউ ছবি তোলেন। কেউ আবার বাহারি নামের এসব গরুর ভিডিও করছেন।ক্রেতারা এসব দেখে হাস্যরসে মাতলেও বিষয়টি বেশ যন্ত্রণার বলে জানিয়েছেন গরু বিক্রেতারা।
তারা জানিয়েছেন, ইউটিউবার আর কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিউ কারসাজিতে তাদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। গরুর নামে চলছে ভাইরাল ব্র্যান্ডিং, সঙ্গে মিথ্যা দামের প্রচার। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন ক্রেতা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিক্রেতারা।
বুধবার (৪ জুন) দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর গাবতলী হাটে কোরবানির পশু ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিক্রেতাদের অভিযোগ, পশুর নামকরণ থেকে শুরু করে দাম নির্ধারণ- সবই এখন ইউটিউব লাইভ আর কন্টেন্টের শোডাউনে নির্ধারিত হচ্ছে। এসব কনটেন্ট ক্রিয়েটররা হাটে গিয়ে নিজের মতো করে পশুর নাম দিয়ে ভিডিও করে নিচ্ছেন।
পাবনা থেকে গাবতলীতে আসা গরু ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমার গরুর দাম শুরু থেকে আমি ৩ লাখ টাকা চাই, কিন্তু কিছু ইউটিউবার ভিডিও করে বলে দেয় ৫ লাখ টাকা! পরে ক্রেতা ৫ লাখ টাকা শুনে চলে যায়, কেউ দামদরও করে না। আবার কেউ যদি ভিডিওতে কম দাম বলে তখন সেই কম দামেই ক্রেতা কিনতে চায়।
তিনি বলেন, ভিডিও বা লাইভের সময় অনেক সময় বিক্রেতারা জোরাজুরিতে পড়ে দাম বলে ফেলেন। পরে ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে সেই দামই ‘বাধ্যতামূলক’ হয়ে দাঁড়ায়।
‘শাকিব খান-পরীমনি’ নাম দেওয়া গরুর বিক্রেতা আবু হারিস ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, একজন ইউটিউবার এসে গরুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল- এই হচ্ছে ‘শাকিব খান, তার পাশে দাঁড়ানো গরুটি পরীমনি’। এরমধ্যে শাকিব খান নামক গরুর দাম ৬ লাখ টাকা এবং পরীমনি গরুর দাম ৪ লাখ টাকা। দাম নিয়ে আমি কিছু বলার আগেই সে ভিডিও করে নিল। পরে দেখি ভিডিও ভাইরাল।
তিনি বলেন, যে গরুর দাম সে বলল ৪ লাখ, আমার সেটি ক্রয়মূল্যই ৩ লাখ ৬০ হাজার। এখন আমি ৪ লাখ ৫০ হাজার চাইলে ক্রেতা বলে ‘ইউটিউবে তো ৪ লাখ বলেছে!’
হাট ঘুরে দেখা গেছে ইউটিউব কেন্দ্রিক কনটেন্ট ক্রিয়েটররা গরুর গায়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন নাম ফেস্টুন, কেউ কেউ পশুর গায়ে টেম্পোরারি স্প্রে পেইন্টও ব্যবহার করছেন।
এক বিক্রেতা বলেন, লাইভের মধ্যে তারা এমন প্রশ্ন করে, উত্তর না দিয়ে উপায় থাকে না। পরে দেখি ভিডিওতে বলছে- ‘এই গরু কম দামে দিয়ে দিচ্ছে ভাই’। অথচ বাস্তবে আমি ওই দামে বিক্রি করলে তো ক্ষতি।
একাধিক বিক্রেতা অভিযোগ করেছেন, ইউটিউব চ্যানেল থেকে কিছু বিক্রেতাকে পেইড কনটেন্ট বানানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
সাকিবুল আলম নামক এক ক্রেতা বলেন, আমি ভাবছিলাম গরুটা ২ লাখ ৫০ হাজারের মতো হবে। কিন্তু বলছে এটা ‘পরিমনি’, ইউটিউবে ভাইরাল, ৫ লাখ না হলে দেব না। কোরবানির জন্য আমি গরু কিনব নাকি ভাইরাল নাম কিনব?
মিরপুর থেকে গাবতলী হাটে গরু কিনতে আসা ক্রেতা মাহবুবুল আলম বলেন, অনলাইনে দেখলাম একটা মাঝারি সাইজের গরু, নাম দিয়েছে ‘প্রিন্স মামুন’। ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে দেখে মনে ধরল। হাটে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা বললেন- এইটা ভাইরাল গরু, ৫ লাখের নিচে কিছুতেই হবে না। আমি তো হতবাক! ওই গরুর শরীর, দাঁড়ানো দেখে বুঝলাম- সর্বোচ্চ ৩ লাখের গরু এটি।
তিনি বলেন, বাজারে এখন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এসবের জন্য দায়ী ইউটিউবার-কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা।
মিরপুর এলাকার বাসিন্দা জাহিদ হাসান বলেন, আমার ছেলে ‘শাকিব খান’র গরুর ভিডিও দেখে পাগল! বলল, ওই গরুই লাগবে। হাটে গিয়ে খুঁজে খুঁজে গরুটা বের করলাম। মাঝারি গরু, একটু ঝলক আছে, কিন্তু দাম শুনে আমি অবাক। ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা! বিক্রেতা বলল, ভাই এটা তো ‘শাকিব খান’, অনেকেই চাইছে। আমি দর কষাকষি করে ৪ লাখ ৫০ হাজারে কিনেছি। কী আর করা, ছেলের আবদার।
হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য হারিস মিয়া বলেন, আমরা ইউটিউবারদের ভিডিও করতে মানা করি না। কিন্তু সমস্যা হয় যখন তারা গরুর নামে মিথ্যা তথ্য, দাম এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে। এতে বাজারে দর কষাকষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিক্রেতাদের দাবি, সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি থাকুক, কিন্তু সেটার জন্য যেন বাজারের স্বাভাবিক প্রবণতা ধ্বংস না হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার উচিত ইউটিউব কনটেন্টে একটি গাইডলাইন নিশ্চিত করা- যা বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
বাজার ঘুরে লায়লা, প্রিন্স মামুন, শাকিব খান, পরীমনি, ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বেশকিছু ভাইরাল হওয়া পশুর দেখা মিলেছে। এর মধ্যে লায়লা নাম দেওয়া গরুটির দাম হাঁকানো হচ্ছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, প্রিন্স মামুন গরুর দাম ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা, শাকিব খান নামে গরু ৬ লাখ টাকা, পরীমনি নামে গরু ৪ লাখ টাকা। এছাড়া জায়েদ খান নামে ছাগলের দাম দেড় লাখ টাকা, ডোনাল্ড ট্রাম্প গরু ৭ লাখ টাকা, তেজি বাঘ নামে একটি গরুর ৯ লাখ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসবের পেছনে যদি গরু বিক্রির বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেন তাহলে তো কোরবানির ঈদের আসল সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর হাটগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল (মঙ্গলবার) থেকে কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে। গতকালের তুলনায় আজকের হাটে ক্রেতাদের ভিড় বেশি দেখা গেছে। প্রথম দিনের তুলনায় হাটে গরু-ছাগলও বেশ বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হাট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিক্রেতারা।
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]