স্মরণে চে গুয়েভারা
যে আদর্শের মৃত্যু নেই
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ২০:১৭
যে আদর্শের মৃত্যু নেই
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

বিপ্লবী চে গুয়েভারা। তিনি কোন দেশের বা বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর জন্য জন্ম গ্রহণ করেননি। তিনি সকল মানুষের, সকল দেশের। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া একজন চে বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য জন্ম নিয়েছিলেন।


চে গুয়েভারা বলিভিয়ার সেনাবাহিনী হাতে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গ্রেফতার হওয়ার পর কোন উদ্বিগ্নতা তিনি দেখাননি, কোন অপরাধবোধ তাকে তাড়িত করেনি। ৯ অক্টোবর বেলা ১.১০ মিনিটে যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়- তখন বিপ্লবী চেগুয়েভারা প্রাগুক্ত কথাগুলো বলেন। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘গুলি কোরো না। আমি চে গুয়েভারা। মৃত চে গুয়েভারার চেয়ে জীবিত চে গুয়েভারা তোমাদের জন্য বেশি মূল্যবান।’ চে গুয়েভারার মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে মতভেদ ও রহস্য এখনো আছে। ধারণা করা হয় ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর লা হিগুয়েরা নামক স্থানে বন্দি, নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।


বিপ্লবীর কোনো দেশ থাকে না। তিনি বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের। বিশ্বের প্রতিটি দেশ থেকে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও সামজিক বৈষম্য ঘুচিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথ খোঁজেন বিপ্লবীরা। তার কাছে নিজ দেশের একজন শ্রমিক বা সাধারণ নাগরিকের শ্রম শোষণ যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি বিশ্বের যেকোনো দেশে পুঁজিবাদীর নগ্ন থাবা তার কাছে সমান বিষাক্ত। একজন বিপ্লবী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এভাবে এক সময় রাষ্ট্রীয় সীমারেখা মুক্ত হয়ে সকল মানুষ শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নহীন সাম্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশীজন হবে। এমন বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছিলেন চে গুয়েভারা। তাই আর্জেন্টিনার নাগরিক হয়েও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক কিউবার এক নায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাতের লড়াইয়ে। এ লড়াইয়ে বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সকল সাম্যবাদী মানুষের কাছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন তিনি।


আর্নেস্তো চে গুয়েভারার আসল নাম এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না। তবে সারা বিশ্বে তিনি চে গুয়েভারা বা চে নামে পরিচিত। চে’র জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার আর্জেন্টিনা রোসারিও। তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। একজন চিকিৎসক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা।


চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নকালে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এ সময়ে তিনি গোটা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ পান। ভ্রমণকালের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এঅঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ। মানুষের অভাব, অনটন সবই সৃষ্টি হয়েছে অন্যের শ্রম শোষণ করে কিছু মানুষের বিত্তশালী হওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা। চে বুঝতে পারেন ধনী-গরিবের এই ব্যবধানের অবসান ঘটাতে একমাত্র পথ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের পথে নিজকে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেন


মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা। তার মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ় হয় একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববিপ্লব এর মাধ্যমেই বিশ্বে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানো সম্ভব। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াাতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।


১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমান ক্ষমতাচ্যুত হলে চে’র বৈপ্লবিক আদর্শিক চেতনা আরো শানিত হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় কিউবার বিপ্লবী রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে চে’র আলাপ হয়। এ আলাপের সূত্র ধরে চে ফিদেল কাস্ত্রোর ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তা উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বিপ্লবের জন্য লড়াইকালে তিনি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে পদোন্নতি পান। বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


চে গুয়েভারা গেরিলা যুদ্ধ চলাকালেই ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি ও অধ্যবসায়ের কথা জানান। তিনি গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেকার চুল্লি প্রস্তুত করেন। এ সময়ে তিনি নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালাও পরিচালনা করেন। এছাড়াও চে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য আদান-প্রদানের জন্য পত্রিকা চালাতেন। ওইসময় বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।


বিপ্লবের প্রতি একাগ্রতা, অদম্য সাহস ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। চে শৃঙ্খলার বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। তিনি বিশ্বাস করতেন, দলের যে কারো শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বা শৃঙ্খলার প্রতি অবহেলার কারণে পুরো দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই শৃঙ্খলার প্রতি অবহেলাকারীকে তিনি নির্দ্বিধায় গুলি করতেন। গেরিলা অভিযানের সময় গুপ্তঘাতকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দায়িত্ব চে’র ওপর ন্যস্ত ছিল। এমন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈনিকদের শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। কাজের অবসরে তিনি সবার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করতেন।


কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কিউবার শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং কিউবান নোটগুলোতে তার স্বাক্ষরে শুধু ‘চে’ লেখা থাকতো। তিনি বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টর, কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন উল্লেখযোগ্য। তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানেরও সুযোগ পান। তার প্রশিক্ষণেই এই বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়।


কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চে গুয়েভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিউইয়র্ক শহরে যান। ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে আবেগ অভিভূত বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। তিনি আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্য বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চান। এ সময়ে চে গুয়েভারা নিগ্রো জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ক্রোধান্বিত চে গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হ্যাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন যে, তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, নিগৃহীত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা। বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, সারাবিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিৎকার এখন হয় স্বদেশ অথবা মৃত্যু।


বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করে বলিভিয়ায় যান। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দি ও নিহত হন বিপ্লবী চে। এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণকবরে চে ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।


চে গুয়েভারা চিকিৎসক কিংবা বিপ্লবীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যানুয়েল রচনা করেন। সারা জীবনে তিনি অসংখ্য ডায়েরি লিখেছেন। সেসব ডায়েরি পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ৭০টির মতো নিবন্ধ লিখেছেন। মূলত কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি শুরু করেন। তরুণ বয়স হতেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। এছাড়াও প্রচুর চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন কয়েকটি বইয়ের ভূমিকা। তার লেখা ডায়েরি ‘দি মোটরসাইকের ডায়ারিজ’ ১৯৬৩ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এটি স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত। বইটি নিউইর্য়ক টাইমসের বেস্ট সেলার ছিল। এছাড়াও তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়।


সাংবাদিক জন লি এন্ডারসনের আত্মজীবনী ‘চে গুয়েভারা: আ রেভল্যুশনারি লাইফ’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, চে গুয়েভারাকে গুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যাইমি টিরান নামক জনৈক সার্জেন্টকে। চে গুয়েভারা তাকে বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে খুন করতে এসেছ। গুলি করো। তুমি কেবল একজন মানুষকে মারতে যাচ্ছ।’ টিরান চে গুয়েভারার হাত, পা ও বুকে গুলি করলেন। চের বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর। চে গুয়েভারাকে হত্যার সংবাদ যখন বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে যায়, তখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার পোস্টার, স্টিকার, টি-শার্টসহ বিভিন্ন কাপড়ে বিপ্লবী চে’র ছবিতে ভরে যায়। মার্কিন প্রশাসন বুঝতে পারে যে, জীবিত চে’র চেয়ে মৃত চে আরো শক্তিশালী।


আজও চে গুয়েভারাকে নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা হয়। এসব গ্রন্থে সর্বদাই ফুটে ওঠে একজন আদর্শ বিপ্লবীর প্রতিচ্ছবি। বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায় লিখেছিলেন-


আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!


বিবার্তা/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com