বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষকতার মহান পেশা নথির রশিতে বন্দি
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:২২
শিক্ষকতার মহান পেশা নথির রশিতে বন্দি
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

`শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লির পতি সে তো কোন্ ছার,
"আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর"।


শিক্ষকদের সম্মানার্থে কবি কাদের নেওয়াজ তার ‘শিক্ষকের মর্জাদায় কবিতাটি রচনা করেন ।


আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে দিবসটি পালিত হবে। দিনটি এবার জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করছে সরকার। ইউনেস্কো কর্তৃক নির্ধারিত এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য , ‘কাঙ্খিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা’।


১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের অবস্থা নিয়ে আন্তঃসরকার সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। এতে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রায়ই বলে থাকেন, ’জীবনে একবার যিনি শিক্ষক হয়েছেন, তিনি সারা জীবনই শিক্ষক।’


শিক্ষকতা হচ্ছে মহান ও একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা। এখনো সব পেশার মানুষ শিক্ষকদেরকেই ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। পৃথিবীতে যতগুলো পেশা রয়েছে- তার মধ্যে শিক্ষকতাকে মর্যাদার চোখে দেখা হয়। পৃথিবীতে মা বাবার পরের স্থান হচ্ছে শিক্ষকের। সমাজ ও দক্ষ মানবসম্পদ বির্নিমাণে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম।


শিক্ষক সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার কারিগর। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের মাঝে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সৃষ্টি করে। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী সুন্দর মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়- শ্রদ্ধাশীল হয়।


বিশ্ব শিক্ষক দিবসের শুরু হয়েছিলো ১৯৯৪ সালে, ইউনেস্কোর ২৬ তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কো মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়রের ঘোষনার মাধ্যমে। ইউনেস্কো মনে করে, ‘ বিশ্ব শিক্ষক দিবস‘ শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।


দেশে দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিবসটি পালন করে। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার শিক্ষক দিবস পালিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শিক্ষক দিবস পালন করা হলেও শিক্ষক দিবস পালন করা সবার একই উদ্দেশ্য। আর তা হলো শিক্ষকদের সম্মান করা।


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়। চীনে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে ডক্টর উপাধিপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক উপরে। শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষকদের উচ্চতর স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করা হয়।


আমাদের দেশে ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর থেকে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১৫ ধারায় মৌলিক অধিকার হিসেবে এবং ১৭ ধারায় একই ধারার অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের রাষ্ট্রীয় নীতি ঘোষিত হয়।


বিজ্ঞানী ড. কুদরতই খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবস্থান বিশ্বায়নের বিবেচনায় খুবই দুঃখজনক। দেশের ৮০ ভাগ শিক্ষা এখন পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে। বাকি ২০ ভাগ সরকারি এবং প্রাইভেট শিক্ষার মাধ্যমে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারী বেসরকারিদের তুলনায় ভালো হলেও আন্তর্জাতিক মানের অনেক নিচে । আজও বাংলাদেশে প্রতি চারজনের একজন নিরক্ষর । তারা দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না।


আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলে যে জিনিসগুলো আমাদের চোখে পড়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রায় সারাবছর চাদর বিছিয়ে শিক্ষকদের নানা দাবি দাওয়া নিয়ে অনশন, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল হাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বক্তব্যকে রেকর্ড করে পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার ও শিক্ষককের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাকে অপমানিত করা। শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানি পেশার সাথে একেবারেরই মানানসই না হওয়ায় শিক্ষক সমাজ শিক্ষার মানোন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখছেন না, অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও এ পেশায় আসতে আগ্রহ দেখায় না।


শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড, তবে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার মেরুদন্ড। তবে অবশ্যই সেই শিক্ষাকে হতে হবে সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক শিক্ষা বা সমাজ কখনো সুনাগরিক তৈরী করতে পারে না। আর সুনাগরিক ছাড়া সমাজ অগ্রগামী হয় না। আমাদের শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। শিক্ষকতা পেশার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পেশায় সামগ্রিক নিরাপত্তা না থাকার ফলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অনেকে আসতে চায় না এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতেও আসতে চাইবে না। বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা যেন সন্মান নিয়ে জীবন যাপন করতে পারে সেটাও ভাবতে হবে। সময়ের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদন্ড মানসম্মত করতে হবে।


শিক্ষকতা একটি মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও অপমানের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক বিচ্যুতিও আমাদের সমানভাবে ব্যথিত করে। বিশেষ করে মাদ্রসার শিক্ষকদের অতিমাত্রায় অনৈতিক কাজে জড়িত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।


নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝে আজও অনেক শিক্ষক নিজ প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন। তেমনই একজন শিক্ষক আবদুল মালেক ছৈয়াল। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। নিজে অন্ধ হয়েও ল্যাপটপে রিডিং সফটওয়্যারের সাহায্যে বইয়ের বিষয়বস্তু শুনছেন আর সামনে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। ক্লাস নেওয়া শেষে ঢোকেন সংগীতের ক্লাস নিতে। সঙ্গে হারমোনিয়াম ও তবলা বাজানোও শেখান। আলোহীন চোখ নিয়েই তিনি শিশুদের মধ্যে আলো বিলানোর মহান ব্রত নিয়েছেন। নিজ মেধা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শিশুদের মন জয় করেছেন।


আবদুল মালেক ছৈয়াল ১৯৯২ সালে তাঁকে রাজধানীর একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।


আরেক শিক্ষক শালমারা বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায় । তিনি তার ৫০ লাখ টাকা মূল্যে জমি দান করেন বিদ্যালয়ের জন্য। দীর্ঘ ৯ বছর জগদীশ চন্দ্র রায় এখানে বিনা বেতনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের সমাজে আজও এমন অনেক শিক্ষকের দেখা মিলা দুষ্প্রাপ্য। তবে অপ্রতুল শিক্ষক দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি প্রায় অসম্ভব। তার প্রতিফলন তো দেখাই যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে আজ আমাদের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই সঠিক শিক্ষানীতি।


এসব অসঙ্গতি বিচ্যুতিকে পিছনে ফেলতে অধুানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক শিক্ষার পরিবেশ দিলে তবেই এই মহান পেশায় যারা আছে বা আসবে তারাও নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারবেন।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com