১৫ আগস্ট; যে সত্যগুলো অজানা
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ১৯:১৩
১৫ আগস্ট; যে সত্যগুলো অজানা
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

১৫ আগস্ট বাঙালির শোকের মাস, কলঙ্কের মাস। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন জাতির পিতাকে সপরিবার এত মর্মান্তিক ও বর্বরতমভাবে নিশ্চিহ্ন করার ঘটনা ঘটেনি, আর ঘটবেও না।


তার চেয়েও বর্বরতম বিষয় ছিল ইনডেমিনিটি দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে দেয়া। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া খুনী এবং ষড়যন্ত্রে জড়িতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পদ পদবী পদোন্নতিসহ নানাভাবে পুরস্কৃত করা।


৭৫’ পরবর্তী এক অন্ধকার সময় পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর রচিত হয়েছিল অন্ধকূপ হত্যা নামের কাহিনী। সিরাজের নির্মমতা বুঝাতে ব্রিটিশ সেনা হলওয়েল এই কাহিনী লিখেছিলেন- যাতে সিরাজউদ্দৌলাকে ইতিহাসে নির্মম হিসাবে উপস্থাপন করা হয়- যাতে মানুষ নবাবকে তার নির্মমতার জন্য ঘৃণা করে।


ইতিহাসের খলনায়কেরা বারবার তারই পুনরাবৃত্তি করে। একই মিথ্যা শতবার বললে যেমন সত্যের মত শোনায়, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুহূর্ত থেকেই বেতার, পত্রিকাসহ যাবতীয় গণমাধ্যম দখল নিয়ে খুনীর দল ইতিহাসের মহানায়ককে ভিলেন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া শুরু করে। শুরু হয় মিথ্যার উৎসব। শুরু হয় বাংলাদেশের পশ্চাতযাত্রা।


খুনিরা সদম্ভে সেই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিচার ব্যবস্থাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল।


একটা মিথ্যা সময়ে, ভুল সময়ে, বিভ্রান্ত সময়ে পথচলতে শুরু করে সদ্য স্বাধীন একটা দেশ। সদ্য স্বাধীন দেশের ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো গঠনে ব্যস্ত। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ঠিক তখনই ১৫ আগস্ট ঘটিয়ে দেশের সেই যাত্রাকে ব্যহত করা হয়।


শুধু বঙ্গবন্ধু ও তার আত্মীয় পরিজন নয়, জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পর সর্বত্র আতংক, বিশৃঙ্খলা ও গুজব প্রচার হতে থাকে। শুধু ৭৫ পরবর্তী প্রজন্ম নয়, দেশের তখনকার সাধারণ মানুষও সেই বিভ্রান্ত সময়ের সত্যটুকু জানা থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়। দশকের পর দশক ধরে সেই সব মিথ্যা কল্পকাহিনী সত্য মিথ্যার মিশেলে এখনো চলমান।


৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ধানমন্ডি ৩২নং সড়ক পর্যন্ত এক শোক মিছিল বের করে। ওই মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা, ভাই রাশেদ মোশাররফ অংশ নেন। সর্বত্র প্রচার হতে থাকে যে, ভারতের সহযোগিতায় খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ও গণবাহিনীর নামে লিফলেট বিতরণ এবং বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যাই হোক, পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হন এবং জিয়া পুনরায় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাসদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এরমধ্যে জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় খুনি মেজরচক্র নিরাপদে দেশত্যাগ করে। খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ৩ নভেম্বর রাত ৮টায় খুনি মেজরচক্রকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেন। ব্যাংকক পৌঁছেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার কথা স্বদম্ভে ঘোষণা করে।


মেজরের ডালিমের বউকে অপহরণের মিথ্যা অপবাদও জুটেছিল শেখ কামালের কপালে। ডালিম নিজে সেই অপহরণ সম্পর্কে তার ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে পরিস্কার লিখে গেলেও শেখ কামালের সেই অপবাদ ঘোঁচেনি। ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে স্ত্রী এথলেট সুলতানাকে জোর করে বিয়ে করাসহ যত ভাবে সম্ভব শেখ কামাল নিয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে। এবং দীর্ঘ ৪ দশক পরেও অনেকেই বিশ্বাস করে যে- শেখ কামালের জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।


অন্য আরেকটি মিথ্যাচার খুব প্রচারিত, এখনো বিএনপি-জামায়াত বলে বেড়ায়, বাকশাল গঠনই বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কারণ। অথচ বাকশাল তখনো পুরোপুরি কার্যকরই হয়নি। সেই শাসন ভাল কি মন্দ- সেই ধারণাই পায় নাই দেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে বাকশালের খলনায়ক বানিয়ে প্রচার প্রচারণা, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগসহ নানাবিধ মিথ্যাচার সমান তালে চলমান ছিল।


অথচ প্রত্যেক সাংবাদিককে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল, সেই সত্যটা বলা হয় না।


একটা ধারণা পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস্ বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী দালালদের বিচারের জন্য সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই আইনে ৩৭৪৭১ জনকে গ্রেফতার এবং অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকার এক আদেশে দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। অবশ্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে সরকার জুলাই ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ বাংলাদেশ সংসদে পাস করিয়ে নেয়। কিন্ত যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা একটা বক্তব্য প্রায়শই বলে থাকে, বঙ্গবন্ধু রাজাকার-আলবদর যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। তাই তাদের বিচার করা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। সেই অর্ধসত্যকেই তারা বারবার বলে সত্য বানাতে চায়।


বিএনপি আরেকটি মিথ্যাচার হলো জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে দেখানো।


মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি এবং ক্ষমতালোভী চক্রের সরকার ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক আদেশে দালাল আইন বাতিল করে দেয়। এর ফলে সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার এবং অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। শহীদদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করে রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা।


১ মে ১৯৭৬ ঢাকায় এক শ্রমিক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করে বলেন, সে সময় মানুষকে অবাধে ধর্ম পালন করতে দেয়া হয়নি। তার ঠিক দু’দিন পর ৩ মে ১৯৭৬ সরকার এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জেনারেল জিয়া সংবিধানের ৯ সংশোধনীর মাধ্যমে তা আইনে পরিণত করে। এর ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ আবার তাদের তৎপরতা শুরু করে। রাষ্ট্র-সমাজ আর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনী। মূলত এদের পূণর্বাসিত করার নামই ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র।


১৫ আগস্ট পরবর্তী মানুষের ক্ষোভ প্রতিবাদ দমিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান তার পুরো শাসনামলে সান্ধ্যআইন জারি রেখেছিল। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এমন কি বঙ্গবন্ধুর যাবতীয় বক্তব্যসহ সকল ডকুমেন্টস আর্কাইভ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।


হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে রাতের আঁধারে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছ। আর এর মূল কারণ, জিয়াউর রহমান তার মসনদ টিকিয়ে রাখতে প্রতিবাদের সবগুলো স্তম্ভকে ভেঙে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করেছিল। যা ১৯৭৫ পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছে। সঠিক ইতিহাস জানার কোন পথ খোলা ছিল না। এখন সেই দুয়ার খুলে গেছে। সেই সত্যগুলো জনসন্মুখে আনা সময়ের দাবী। এখনো যে অমিংমাসিত বিষয়গুলো আলোচনা হয় না। আলোর মুখ দেখেনি প্রকৃত সত্য। ইতিহাসের দায়, সেই সত্যটুকু প্রকাশ করা। কিন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ক্যু পাল্টা ক্যু- এইসব নিয়ে সবার মাঝেই এক ধরণের অস্বস্তি কাজ করে। পুরোপুরি কিছুই কোন পক্ষই পরিস্কার করেন না। অর্ধসত্য-অর্ধমিথ্যার মত করে বলে দায় এড়িয়ে চলে।


আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো বিশ্বাস করি, ১৯৭৫ সালে সময়ের দাবী ছিল বাকশাল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এর কোন বিকল্প ছিল না। সেই বাকশাল নিয়ে খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে সেই সময় বলা হত গোলামী চুক্তি। স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী পর এসে সেই চুক্তি যখন বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হয়েছে চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে।


সিরাজ সিকদার নিয়ে সত্য জানানো প্রয়োজন। সিরাজ শিকদার কেমন বিপ্লব চেয়েছিলেন। সদ্য প্র‍য়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার এখনো অনলাইনে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- কি ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ ছিল সিরাজ শিকদার। থানা লুট, বন্দর উড়িয়ে দেয়াসহ এক বিধ্বংসী যজ্ঞে নেমেছিল তিনি। এই সত্যিগুলো সামনে আসা প্রয়োজন।


১৫ আগস্টকে খুব সামান্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। শুধুমাত্র বিপথগামী কিছু সৈন্য হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মত নেতাকে রাতের শেষ প্রহরে সপরিবার আত্মীয় স্বজনসহ ইতিহাস থেকে তাঁর রক্তের ধারা মুছে দেয়ার পরিকল্পনা করে, তা কোন ভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুধুমাত্র সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সাজা কার্যকর করে এর ঐতিহাসিক দায় মিটবে না। সেনাবাহিনী কেন ব্যর্থ হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দিতে, সেই প্রশ্নের উত্তর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। একজন সেনাপ্রধানের ক্ষমতা, সামান্য একজন মেজর এর চেয়ে কম, সেটি কখনো বিশ্বাসযোগ্য নয়।


রক্ষী বাহিনীই বা কেন কোন প্রতিরাধই গড়ে তুলতে পারল না। খালেদ মোশাররফ-জিয়াউর রহমান দ্বৈরথের কারণ? জেনারেল ওসমানীর সেখানে ভূমিকা কী ছিল?


৪ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড কারা ঘটিয়েছিল। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যারা সেদিন যোগ দিয়েছিল তারা কি আসলেই অস্ত্রের মুখে সবাই যোগ দিয়েছিল? শুধু জিয়াউর রহমান নয়, জাসদ, গণবাহিনী, কর্নেল তাহের, সিরাজুল আলম খান, খালেদ মোশাররফ, জেনারেল ওসমানী আর খন্দকার মোশতাক, ১৫ আগস্টের আগে পরে যারাই ক্ষমতার ভিতরে বাইরে কলকাঠি নেড়েছেন তাদের ভূমিকা এবং সেই ভূমিকার সুযোগ যারা লাভ করেছে। এদের প্রকৃত ভূমিকা প্রকাশ্যে আনলে প্রকৃত সত্যটুকু জানা যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যে সব মানুষকে হিরো হিসেবে আমরা চিহ্নিত করছি- এরা কি সত্যিকারের হিরো না কী ১৫ আগস্টের সুযোগ সন্ধানী?


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বিবার্তা/রোমেল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com