নিরপেক্ষ নির্বাচনে একধাপ এগিয়ে গেল আওয়ামী লীগ
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ১৯:১২
নিরপেক্ষ নির্বাচনে একধাপ এগিয়ে গেল আওয়ামী লীগ
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

গাজীপুর সিটি নির্বাচন দিয়ে শুরু করে বরিশাল-খুলনা নির্বাচনের ফলাফল ও সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক ধাপ এগিয়ে গেল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগাম পরীক্ষায় পাশ করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পরবর্তী এক প্রতিক্রিয়ায় সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও দলটির প্রভাবশালী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও জনগণ ভোট বর্জন করেনি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বরিশালে ৫০ শতাংশের বেশি আর খুলনায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও জনগণ ভোট বর্জন করেনি। এ থেকে বিএনপিকে শিক্ষা নিতে পরামর্শ দেন তিনি।


নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দলটি কোন নির্বাচনেই যাবে না। সেটি তাদের জন্য বুমেরাং হবে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার আর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নাই। বিএনপি নির্বাচনে আসলে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। বরং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি আলোচনা করতে পারে। যদি তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা থাকে। কারণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির বিকল্প খুঁজে নিয়েছে। বিএনপি যদি গোঁ ধরে তাদের অবস্থান ধরে রাখে, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির বিকল্প হিসাবে হয়তো আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিবে। বিএনপির সমর্থক এবং আওয়ামী বিরোধী ভোটাররাই তাদের ভোট দিবে। কারণ ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির ভিতর থেকেই জন্ম নেয়া রাজনৈতিক সংগঠন।


বরিশাল এবং খুলনার সিটি নির্বাচনে ভোটের হিসাব যদি দেখি, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট। তৃতীয় হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান ৭ হাজার ৯৯৯ ভোট পেয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী পেয়েছেন ৬ হাজারের সামান্য বেশি ভোট। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট পড়েছে প্রায় ৪৮ হাজার। খুলনার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ ভোটের মধ্যে তালুকদার খালেক পেয়েছেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের মো. আব্দুল আউয়াল পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট।


ইসলামী ঐক্যজোট সাংগঠনিকভাবে কি জাতীয় পার্টি বা অন্য কোন ছোট রাজনৈতিক দলের চেয়ে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে? অথবা ৫০/৬০ হাজার ভোট পাওয়ার মত রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক কি তাদের আছে? এক কথায় উত্তর দিলে সেই সক্ষমতা ইসলামী ঐক্যজোটের নেই। তাহলে এই ভোট কোথা থেকে আসলো? আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই হাতপাখা মার্কায় ভোট দেয়নি। জ্বীন-ভূত এসেও লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয় নাই। তার মানে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপি, জামায়াত ইসলাম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সমর্থকরাই এই ভোট দিয়েছেন। সেই হিসাবটি পরিস্কার।


ইসলামী ঐক্যজোটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূলত এই দলটি গঠন করা হয়েছিল। এবং ইসলামী ঐক্যজোট ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক মিনারে নির্বাচন করে সিলেটের জকীগঞ্জ-কানাইঘাট আসন থেকে মাওলানা উবায়দুল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন (পাবনা-পাথরঘাটা) থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী গোলাম সরওয়ার হিরু সংসদ সদস্য নিবাচিত হন। তাছাড়া ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের মনোনীত ও চার দলীয় প্রার্থী হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল) আসন থেকে মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী, যশোর-৫ (মণিরামপুর) থেকে মুফতি মুহাম্মাদ ওয়াক্কাছ, নড়াইল-২ থেকে মুফতি শহিদুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জ থেকে মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেষোক্ত দু’জন উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুল হক প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৬ হাজারের সামান্য বেশি।


১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপি চারদলীয় জোট গঠন করেছিল যাতে ইসলামী ঐক্যজোট ছিল। তৎকালীন ছয়টি ইসলামী দল নিয়ে গঠন করা হয় এই জোট। দলগুলো হচ্ছে- খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন। জোট গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পীর মাওলানা ফজলুল করিম, মাওলানা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা আশরাফ আলী ধর্মান্ডুলি, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ। ইসলামী ঐক্যজোট মূলত বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে।


সর্বশেষ ঢাকায় চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে তারা একটি মিছিল ও সমাবেশ করেছিল। সেই সমাবেশে ৯২ ভাগ মুসলমান দেশের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপন দেখতে চায় জনগণ বলে দাবি করেছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা। পাঠ্যক্রমকে ইসলাম বিরোধী দাবি করে অবিলম্বে তা বাতিল করার আহ্বানও জানিয়েছিল।


মিছিল পূর্ব সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী বলেন, বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাসের মাধ্যমে দেশের নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। পাঠ্য বইয়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ঈমান হারা করার পাঁয়তারা চলছে।


তিনি বলেন, অবিলম্বে ইসলামবিরোধী বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাস বাতিল করতে হবে। বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের চিন্তা চেতনা অনুযায়ী আলেমদের তত্ত্বাবধানে নতুন শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এই সিলেবাস প্রণয়নে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।


এই পুরনো আলোচনার মূল যে কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষে আওয়ামী লীগ আর অন্যপক্ষে আওয়ামী বিরোধী। এর মাঝখানে যে শত শত রাজনৈতিক দলসমূহ নামে বেনামে রাজনীতির মাঠে খেলছেন- তারা আসলে ওই পক্ষসমূহের সহযোগী খেলোয়াড়। গাজীপুর, খুলনা বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় ধরণের কোন অভিযোগের সংবাদ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কোন গণমাধ্যমে অনিয়মের কোন অভিযোগ বা সংবাদ আসে নাই। দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচনী সংস্কৃতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনে যে সব হতাহত, সন্ত্রাস, অস্ত্রের মহড়া বা প্রভাব বিস্তার করার সংস্কৃতি ছিল- সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছে বলেই ধারণা করা যায়। নির্বাচন কমিশন এবং সরকার, দুইপক্ষই নিরপেক্ষতা প্রমাণে এবং অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়েছে।


আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলে যে উদ্বেগ ও রাজনীতি চলছে, সেই রাজনীতির আগুনে পানি ঢেলে দিয়েছে এই নির্বাচন। আর এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল দলটি।


এখন বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার অধীনে অংশ গ্রহণ করবে কী না। অন্যথায় আওয়ামী বিরোধী শক্তি যারা বিএনপির নেতৃত্বে রাজনীতি করে আসছে- তাদের বৃহৎ দুইটি অংশ হচ্ছে জামায়াত ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট। জামায়াত ইসলাম বাংলাদেশে রাজনীতি করবে কী করবে না সেই আলোচনা ভিন্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে, আদর্শিকভাবে কোনদিনও চাই না জামায়াত আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুর্নবাসিত হোক। আইনগতভাবে যদিও দলটি নিষিদ্ধ নয়। সেই সুযোগকেই হয়তো বাজির তাস হিসাবে খেলতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ইঞ্জিনিয়ার ইনিস্টিউটে দীর্ঘ ১৪ বছর পর আনুষ্ঠানিক কোন সমাবেশ করেছে জামায়াত ইসলাম। এবং সরকারের আশীর্বাদেই সেটি করতে সক্ষম হয়েছে, এই বিষয়টি সাধারণ মানুষ খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বিএনপিকে বাদ দিয়েও করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ হয়তো সেই পথেই হাঁটছে।


লেখক: সম্পাদক - ব্রিকলেন, যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com