ভাইকে ফাঁসাতে নিহত দেখিয়ে জুলাই হত্যা মামলা, তদন্তে মিলল জীবিত
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৬
ভাইকে ফাঁসাতে নিহত দেখিয়ে জুলাই হত্যা মামলা, তদন্তে মিলল জীবিত
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বেছে নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে; উত্তাল সেসময়ে ওই ভাইকেই নিহত দেখিয়ে করেন মামলা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, ওই মামলাকারী এখন নিজেই ফেঁসে যাচ্ছেন। হত্যাকাণ্ডের এ মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪২ জন।


পুলিশ তদন্তে নেমে দেখতে পেয়েছে, আন্দোলনের মধ্যে ৩ আগস্ট যাকে হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল সেই ব্যক্তি দুলাল ওরফে সেলিম (মূল নাম-সোলায়মান সেলিম) জীবিত রয়েছেন।


এ মামলার বাদী সেলিমের ভাই মোস্তফা কামাল ওরফে মোস্ত ডাকাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করায় ২১১ ধারায় অভিযোগ দায়েরের অনুমতি চেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের ওয়ারী বিভাগের এসআই ইনামুল ইসলাম।


ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের উপ পুলিশ কমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে বাদী মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে মামলা করতে আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।


“আদালত অনুমতি দিলে আমরা করবো। আবার আদালত বিষয়টা নথিজাতও করতে পারেন। আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবে, আমরা সেইভাবে কাজ করব।”


ভাই ‘নিহত’ হওয়ার দাবি করে ঢাকার একটি আদালতে মামলার আবেদনে সোলায়মান সেলিমের নাম দেওয়া হয় দুলাল ওরফে সেলিম। পেশা দেখানো হয় ‘ঠিকানা’ পরিবহনের হেলপার। তিনি ৩ অগাস্ট যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।


প্রথমে মামলার আবেদনে ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছিল। পরে তদন্তের শুরুতে পুলিশ আরও একজনকে এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায়। মোট ৪২ আসামির মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।


মামলার পরবর্তী তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে, সেলিম নিহত হননি। এলাকায় ডাকাত হিসেবে পরিচিত এবং হত্যা-ডাকাতি মামলা মাথায় নিয়ে পলাতক তার ভাই মোস্তফা কামাল পারিবারিক বিরোধের জেরে সেলিমকে ফাঁসাতে মামলাটি করেছেন।


তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে তার ‘জমি দখল করার’ চক্রান্ত সাজানোর অভিযোগ করে সোলায়মান সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কোনো ছেলে সন্তান নাই। আমাকে মেরে জমি দখল করতে চায়। এজন্য আমি খুন হয়েছি উল্লেখ করে মামলা করে। পরে যেন খুনের কাজটা করা সহজ হয়।


“তারা আমাকে খুন করে অন্যকে ফাঁসাতে পারে। আতঙ্কের মধ্যে আছি। তারা কখন কী করে ফেলে।"


দুই মেয়ের জনক সেলিম স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বেলতলী বাজারে বসবাস করছেন। ভাইদের ভয়ে বাড়িতেও থাকতে পারছেন না বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, “তাদের কারণে বাড়ি ছেড়ে দোকানেই বসবাস করছি। তারা শুধু আমাকে না, আমাদের মেয়েদেরও মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এতে তারা আমার জমি দখল করতে পারবে।"


থানা পুলিশের হাতঘুরে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। সম্প্রতি এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪২ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে ৩০ নভেম্বর চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওয়ারী বিভাগের এসআই ইনামুল।


প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই মহিন উদ্দিন বলেন, এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে ২১ ডিসেম্বর। সেদিন চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে।


শেখ হাসিনা ছাড়া অব্যাহতির সুপারিশ করা অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রমেশ চন্দ্র সেন ও আসাদুজ্জামান নুর, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মশিউর রহমান মোল্লা সজল, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি ও সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ড। তারা সবাই পলাতক।


আর গ্রেপ্তার দেখানো দুই আসামি মোহাম্মদ উল্লাহ পাটোয়ারী ও মিরাজ খানকেও অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।


তদন্তে নেমে তদন্তকর্তা এসআই ইনামুল দেখতে পান বাদী মোস্তফা কামাল ও নিহত দেখানো সেলিম আপন ভাই। তারা চার ভাই ও দুই বোন। ভাইদের মধ্যে সেলিম (৫০) সবার ছোট। তাদের বড় ভাই হেলাল উদ্দিন (৬২), মেজ ভাই মো. আবুল হোসেন আলম (৫৮) ও সেজো ভাই মোস্তফা কামাল (৫৫)। তাদের মধ্যে মোস্তফা ডাকাতি করার কারণে সে এলাকায় ‘মোস্ত ডাকাত’ নামে পরিচিত।


চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মোস্তফার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া থানায় হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট থাকায় সে ১০ বছর ধরে পলাতক রয়েছে। তার সঙ্গে সেলিমের কোনো যোগাযোগ নাই। ভাইদের সঙ্গে সেলিমের জায়গা জমি নিয়ে শত্রুতা আছে এবং মামলা চলমান আছে।


হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সাজানোর বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “আপন ছোট ভাই সোলায়মান সেলিমকে যাতে পরবর্তীতে হত্যা করে লাশ গুম করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারে এবং অসাধুভাবে অর্থনৈতিক লাভবান হওয়ার আশায় এবং মোস্তফা কামাল এজাহার নামীয় আসামিদের টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।”


অনুসন্ধান শেষে তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং ঘটনায় পারিপার্শ্বিকতা যাচাই করে দেখেছে যাকে নিহত দেখানো হয়েছে তিনি জীবিত। জমিজমা সংক্রান্তে বিরোধকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ নেওয়া হয়েছে বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা।


যে কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।


এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো দুই আসামির একজন মিরাজ খানের আইনজীবী রাশেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন, “লোকটা (তার মক্কেল) রাজনীতি করেন না। তারপরও তাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাকে প্রথমে লালবাগ থানার একটা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যেটির মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার মামলাটাও রয়েছে।


“হত্যার ঘটনাই ঘটল না, তারপরও আসামি হল। হয়রানির শিকার হল। তার উচিত হবে রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করা। কারণ বিনা কারণে তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।"


মামলার বাদী মোস্তফার দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com