
নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রয়াণের প্রায় শত বছর হতে চললেও তিনি যে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন, সেই স্বপ্নকে আমরা আমলে আনতে পারি নাই। অগ্রসর হতে পারি নাই বলে মন্তব্য করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আজকে তার জন্ম উপলক্ষে যে আয়োজন, সেটা শুধু তাকে স্মরণ করার জন্য না; আমাদের ব্যর্থতাগুলো খুঁজে বের করার জন্য। কেন আমরা ব্যর্থ হলাম? কেন এই ১০০ বছরে আরও বেগম রোকেয়া আসল না আমাদের মাঝখানে? যে আমাদেরকে পথ দেখাতো, এগিয়ে নিয়ে যেতো, ধাক্কা দিতো, মনে করিয়ে দিতো কোন পথে আমাদের যাওয়া দরকার। ১০০ বছর পরে কী হলো? কত অগ্রসর হলাম?’
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে চার নারীর হাতে রোকেয়া পদক তুলে দেন অন্তবর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নারীশিক্ষা শ্রেণিতে (গবেষণা) রুভানা রাকিব, নারী অধিকার শ্রেণিতে (শ্রম অধিকার) কল্পনা আক্তার, মানবাধিকার শ্রেণিতে নাবিলা ইদ্রিস ও নারী জাগরণ শ্রেণিতে (ক্রীড়া) পদক পান ঋতুপর্ণা চাকমা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে মহিয়সী নারীর কথা স্মরণ করে আজকের অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছে, সেই মহিয়সী নারীর আত্মা আজকে শান্তি পাবে। তিনি যে কল্পনা করেছিলেন, তার ইমাজিনেশনে তিনি যে সমাজ চিন্তা করেছিলেন; আজকে যারা পুরস্কার পেল, তারা সেই সমাজ নির্মাণের পাথেয় আমাদেরকে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারা জাতি তাদের উদাহরণ থেকে তাদের পথচলা থেকে শিক্ষা পাই এবং যে আদর্শে বেগম রোকেয়া আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন, অতি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন তার বক্তব্যে, তার লেখায়; আজকে যে চারজন পুরস্কার পেলেন, তারা রোকেয়ার সেই পথে আমাদের জাতিকে তুলে ধরলেন, এগিয়ে দিলেন। আমরা ভাগ্যবান, আমরা ভাগ্যবতী।’
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছর রোকেয়া পদক দেয় বাংলাদেশ সরকার।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের একই তারিখে কলকাতার সোদপুরে তার মৃত্যু হয়।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থায় নারীর সমান অধিকারের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন মহিয়সী এই নারী।
বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পণ প্রথা, ধর্মের অপব্যাখ্যাসহ নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন রোকেয়া। মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি কালজয়ী গ্রন্থে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সমাজের কুসংস্কার ও নারীর বন্দিদশার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তিনি।
তৎকালীন সমাজের অচলায়তন ভেদ করে রোকেয়া যে নারীদের আলোর পথ দেখিয়েছিলেন, সেই কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছে, সাংঘাতিক রকমের স্বপ্ন; এরকম স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে সেই আমলে ও পরিসরে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আজকে মনে হয় যে— হ্যাঁ, এটা তো সুন্দর কথা বলছে। সুন্দর কথা না; বিপ্লবী কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমস্ত সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা, কিন্তু সে ঝাঁকুনি বহন করে নিয়ে যাওয়ার লোক আর আসলো না। এটি হলো দুর্ভাগ্য; আমাদের দুর্ভাগ্য।’
নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন বেগম রোকেয়া, সেই প্রসঙ্গ ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘কীভাবে আমরা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বেগম রোকেয়াও নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে পারতো, পেরেছিল। তার বহু কাজ ছিল। কিন্তু কোনো কাজের মধ্যে সে সমাজকে বাদ দিয়ে করেনি। সবসময় সমাজকে নিয়েই করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার যে কল্পনাশক্তি তার সাহিত্যে সে প্রকাশ করেছে; যে ভবিষ্যৎ চিন্তা সে করেছে, একটা বাক্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলছে যে, নারী কন্যাদের লেখাপড়া শেখাও— যাতে তার অন্ন উপার্জন করতে পারে। সে ১০০ বছর আগের কথা, ১৫০ বছর আগের কথা; অন্ন অর্জন করতে পারে।’
রোকেয়া চাকরি করার কথা বলেননি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা বলছি— উদ্যোক্তা হতে হবে, এই হতে হবে; সে বহু কাল আগে এটা বলে চলে গেছে। শিক্ষা নিয়ে চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি করো, তোমার চাকরি কোথায় কোথায় আছে আমরা খুঁজে দিই, কিচ্ছু বলেনি। সে নিজের অন্নের ব্যবস্থা করবে। আর সেখান থেকে আমরা শিখতে পারছি না কেন? উৎসব করছি, সব করছি। কিন্তু শিখতে পারছি না। আমাদের দৈনন্দিন পথে রোকেয়ার সঙ্গে থাকুন, তাহলেই সার্থকতা।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ যারা পুরস্কার পেলেন, তারা শুধু বাংলাদেশের নয়। তারা বাংলাদেশকে অন্য একপর্যায়ে নিয়ে গেছে, প্রত্যেকে। এটা আরও একটি পুরস্কার নাম, এটা যুগান্তকারী পুরস্কার; যারা আমাদেরকে দুনিয়ার সামনে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। এরা শুধু বাংলাদেশের মেয়ে না, এরা সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দেওয়ার মেয়ে। কাজেই তাদেরকে যে আজ আমরা পেয়েছি এই ছোট অনুষ্ঠানে সম্মান দেখানোর জন্য, সেটা তার প্রথম ধাপ।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম সম্প্রতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ব্যানারে নতুন নাম নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় না দেখে প্রধান উপদেষ্টা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আয়োজকদের।
বিবার্তা/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]