আশরাফুলকে হত্যার পর করা হয় ২৬ টুকরো, জানা গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৬
আশরাফুলকে হত্যার পর করা হয় ২৬ টুকরো, জানা গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীতে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের ২৬ খণ্ড মরদেহ উদ্ধারের পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে দুটি নীল রঙের ড্রামে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এমন নৃশংস হত্যার ঘটনায় আসামি করা হয় তার বন্ধু জরেজুল ইসলামকে।


জানা গেছে, শামীমা আক্তার নামে বিবাহিত এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন আশরাফুল ও জরেজ এ নারীর সঙ্গে দুজনের ছিল ত্রিভুজ প্রেম। কিন্তু এই প্রেম তাদের বন্ধুত্বে ফাটল তৈরি করেছিল। যার জেরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আশরাফুলকে।


ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) স্বল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, আশরাফুলকে প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। ‌মৃত্যুর দুইদিন পর তার মরদেহ কেটে ২৬ টুকরো করা হয়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন জরেজ ও পরকীয়া প্রেমিকা শামীমা আক্তার।


এ ঘটনায় আশরাফুলের বন্ধু এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি জরেজুলকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। গতকাল শুক্রবার রাত ১০ টার দিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। ‌অন্যদিকে র‍্যাব-৩ এর একটি দল লাকসাম থেকে হত্যাকাণ্ডের আরেক আসামি পরকীয়া প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তার করেছে।


ডিবি সূত্রে জানা গেছে, শামীমা আক্তার কুমিল্লার বাসিন্দা। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শামীমার স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। তিন বছর আগে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে তার সম্পর্ক হয় মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজুল ইসলামের সঙ্গে। ছুটিতে দেশে ফেরার সময় শামীমার সঙ্গে জরেজুলের শারীরিক সম্পর্ক হয়।


রংপুরে একই এলাকায় থাকা জরেজুল ও আশরাফুলের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। জরেজুলের মাধ্যমে আশরাফুলের সঙ্গে শামীমার পরিচয় হয়। এরপর আশরাফুল ও শামীমার মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জরেজুল ঢাকায় আসার পর দক্ষিণ ধনিয়ায় একটি বাসা ভাড়া নেন। শামীমা তার ছেলে-মেয়েকে কুমিল্লায় রেখে সেখানে ওঠেন। পরে আশরাফুল ও জরেজুল বাসায় একসঙ্গে যান। ওই সময় জরেজুলের সঙ্গে শামীমার শারীরিক সম্পর্ক হয়। এটি জেনে আশরাফুলও শামীমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান এবং তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়।


এ বিষয়টি টের পেয়ে যান জরেজুল। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান তিনি। বের হওয়ার সময় ভুলে আশরাফুলের মোবাইলও সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। পরে মোবাইল নিতে ফিরে এসে জরেজুল দেখেন শামীমা ও আশরাফুল একসঙ্গে ঘুমিয়ে আছেন। ওই সময় তিনি বাসার ভেতরে লুকিয়ে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।


ডিবি সূত্রে আরও জানা গেছে, রাত হলে শামীমা ও আশরাফুল আবার শারীরিক সম্পর্ক করলে জরেজুল তা মেনে নিতে পারেননি। পরে আশরাফুলকে বালিশ চাপা দিয়ে ধরেন জরেজুল। ওই সময় শামীমাও সেখানে ছিলেন। এক পর্যায়ে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করলে আশরাফুল মারা যান।


হত্যার পর মরদেহ দুইদিন বাসার ভেতরে রাখা হয়। পরে দুইজন মরদেহ ২৬ টুকরো করে দুটি ড্রামে ভরে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনে ফেলে দেন এবং কুমিল্লায় পালিয়ে যান।


ঈদগাহর সামনে ড্রাম পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয়রা। তখন পুলিশ এসে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে।


জানা গেছে, আশরাফুল একটি মামলার বাদী ছিলেন। সে কারণে তার ডাটাবেজ পুলিশের কাছে ছিল। পরে সিআইডি এসে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলে তার পরিচয় শনাক্ত হয়। পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ডিবি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করে।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, “ত্রিভুজ পরকীয়া প্রেমের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। আশরাফুল ও জরেজুল ইসলাম একে অপরের বন্ধু হলেও শামীমা নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের দুইজনেরই পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ‌ এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আশরাফুল তার বন্ধু ও তার প্রেমিকার হাতে খুন হয়। মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে এ বিষয়ে ডিবি তদন্ত শুরু করে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি সহযোগিতায় শুক্রবার রাত ১০ টায় কুমিল্লা থেকে জরেজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এবং এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”


ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. দীপিকা রায় আশরাফুলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গলা থেকে নিচ পর্যন্ত ২৫ টুকরো, মাথাসহ মোট ২৬ টুকরো লাশ পাওয়া গেছে। চুল ও দাঁত স্বাভাবিক থাকলেও গলার নিচের অংশের অনেক অংশ মিল পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।


এর আগে শুক্রবার আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় জারেজুল ইসলামকে প্রধান আসামি করা হয়।


আনজিনা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, “আশরাফুল কাঁচামালের ব্যবসা করেন। তিনি দিনাজপুর হিলি বন্দর থেকে সারা বাংলাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আলুসহ কাঁচামাল সরবরাহ করেন। গত ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় আশরাফুল ও জরেজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রংপুরের বদরগঞ্জের গোপালপাড়া থেকে ঢাকার সায়দাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তারপর থেকে আশরাফুলের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজাখুঁজি করি, কিন্তু তাকে (আশরাফুল) পাওয়া যায়নি।”


এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়, “গত ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৭টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখিতে পাই এবং জানতে পারি যে, শাহবাগ থানা পুলিশ হাইকোর্ট পানির পাম্প সংলগ্ন থেকে ২টি নীল রঙের ড্রামের ভিতর থেকে অজ্ঞাতনামা পুরষের খণ্ডিত মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। ওই সংবাদ দেখতে পেয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ শাহবাগ থানা যাই ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে খণ্ডিত মৃতদেহের মুখমন্ডলসহ দেহের বিভিন্ন অংশ দেখে আমার ভাই আশরাফুল হকের মৃতদেহ শনাক্ত করি। আমিসহ আমার পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ যে, জরেজ তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামীদের সহযোগীতায় গত ১১ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর এর মধ্যে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আশরাফুল হককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।”


এজহারে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, “মুখমন্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ মোট ২৬ টি খণ্ডে খণ্ডিত করা হয়। মৃতদেহ গোপন করার উদ্দেশ্যে ২টি নীল রংয়ের ড্রামের ভিতর ভরে ড্রামের মুখ কালো রংয়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে শাহবাগ থানাধীন হাইকোর্ট পানির পাম্পে রাস্তার উপরে ফেলে রেখে হত্যাকারীরা অজ্ঞাতস্থানে পালিয়ে গেছে।”


পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল হক হিলি স্থলবন্দর থেকে কাঁচামাল কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারী বিক্রি করতেন। তার বন্ধু জরেজ মিয়া সদর উপজেলার শ্যামপুরের বাসিন্দা। জরেজ দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া ছিলেন। দেশের ফেরার পর আশরাফুলের সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয় তার।


আশরাফুলের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, হিসাব-নিকাশ রাখতেন জরেজ। গত মঙ্গলবার আশরাফুল হক বন্ধু জরেজসহ ব্যবসার কাজে ঢাকায় যান।


বুধবার বিকেলে আশরাফুলের সাথে স্ত্রী লাকী বেগমের শেষ কথা হয়। এরপর থেকে আশরাফুলের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা।


বৃহস্পতিবার বদরগঞ্জ থানায় জিডি করতে আসেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে এসে জানতে পারেন আশরাফুল হককে ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।


আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, “আমার স্বামীর কাছে বিদেশ যাওয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন জরেজ। গত মঙ্গলবার জরেজুল আমার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে যান। এরপর স্বামীকে ফোনে পাই না। তার ফোন ধরেন জরেজুল বলেন আপনার স্বামী ফোন রেখে কালেকশনে গেছে। আমি কী বাচ্চা ছাওয়াল, কিছুই বুঝি না। আমার স্বামীকে খুন করে করেছে ওই জরেজুল। আমি তার কঠোর বিচার চাই।”


হত্যাকাণ্ড নিয়ে বৃহস্পতিবার ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার বাড়ি থেকে আশরাফুল ঢাকায় আসেন। বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার কথা হয়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। ভারত ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ এবং আলু আমদানি করতেন আশরাফুল। পণ্য আমদানির জন্য তার সরকারি লাইসেন্স রয়েছে।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com