শিরোনাম
ত্বকের আধুনিক চিকিৎসা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান ডা. সামিনা মাহজাবিন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১২:০৬
ত্বকের আধুনিক চিকিৎসা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান ডা. সামিনা মাহজাবিন
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

শৈশবে জীবন নিয়ে প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র একটি ভাবনা থাকে। সময়ের আবর্তনে সে ইচ্ছে কারো পূরণ হয়, আবার কারো হয়ে ওঠে না। তারও ইচ্ছে ছিল চারুকলায় ভর্তি হয়ে একদিন বড় চিত্রশিল্প হওয়ার। সময়ের পালা বদলে নিজের ইচ্ছের বদলে গুরুত্ব দিতে হলো প্রিয়জনদের ইচ্ছেকে। হলেন ত্বকের চিকিৎসক। সুস্থ ত্বক এবং সৌন্দর্যের আধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে চান প্রতিটি সাধারণ মানুষকে। সে উদ্দেশ্য নিয়েই মানুষের সেবা করছেন সফল এই ত্বক চিকিৎসক।


বলছিলাম ‘স্কিনোলজিক স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার’র ফাউন্ডার ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক ডা. সৈয়দা সামিনা মাহজাবিনের কথা। তিনি একজন ডার্মাটোলজি অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস ফিজিশিয়ান। ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চর্ম ও যৌন বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে মানুষের শরীরের ত্বকের সমস্যার সমাধানের কাজ করছেন।


ডা. মাহজাবিনের জন্ম ঢাকা জেলায় সম্ভ্রান্ত মসলিম পরিবারে। তখন ব্যবসার সুবাদে বাবা-মা থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। যখন হাইস্কুলে ওঠেন তখন বাবা-মা ঢাকায় আসেন। বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন তিনি।


শৈশব থেকেই মাহজাবিনের আর্টের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা ছিল। আর্ট করতে খুব ভালো লাগতো তার। যেকোনো ছবি আঁকতে আনন্দ পেতেন। সে ভালোলাগা থেকেই বড় হয়ে চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে ছিল তার। সে স্বপ্ন মনে লালন করে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। অন্যদিকে, তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। তাদের একমাত্র মেয়ে বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। মানুষের সেবা করবে।



শত প্রতিকূলতা মাড়িয়ে আত্মপ্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়া


এইচএসসি পাস করে ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এলো। অন্যদিকে পারিবারিকভাবে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হবু স্বামী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত প্রিয়জনদের ইচ্ছের মূল্য দিতে নিজের ইচ্ছেকে বিসর্জন দিলেন তিনি। ভর্তি হন উত্তরা মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হাসপাতালে। লক্ষ্য চিকিৎসক হওয়া।


এদিকে মেডিকেলে ভর্তির আগেই পারিবারিকভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। ছাত্রী অবস্থায় বিয়ে হওয়ায় প্রাইভেট মেডিকেলে পড়তে গিয়ে তাকে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়।


ডা. মাহজাবিন বলেন, মেডিকেলে প্রথম বর্ষে ক্লাসমেটরা নানা কটু কথা শুনাতো। অনেকে আমাকে এড়িয়ে যেতো, অবহেলা করতো। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।



আপন ভূবনে ডা. মাহজাবিন


তিনি মেডিকেলে প্রথম বর্ষে অ্যানাটমি সাবজেক্টে ফেল করেন কয়েকবার। পরে জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে হয়েছে। অনেকটা হাতাশ হয়ে যান। ভাবছিলেন মেডিকেলে পড়া বন্ধ করে দেবেন। তখন তার স্বামী সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগান। সেই শক্তি দিয়ে তিনি সব হতাশা কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ান। মনের জোর বেড়ে যায়। আত্মপ্রত্যয় নিয়ে শুরু করেন মেডিকেল পড়াশোনা।


তত দিনে তিনি সব সামলে নিয়েছেন। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে চলে আসে। সবই চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। পঞ্চম বর্ষের শেষের দিকে এসে প্রেগনেন্ট হন তিনি। ভাগ্যদেবী তার প্রসন্ন হয়নি। হাইরিস্ক প্রেগন্যান্সি ছিল তার। ৬ মাস বেড রেস্টে থাকতে হয়। সময়ের পালাবদলে ফাইনাল প্রফের সময় আসলো। কিন্তু প্রেগন্যান্সির কারণে দেয়া হলো না ফাইনাল প্রফ। এর পরও থেমে থাকেননি। সব বাধা-বিপত্তি উতরে ১২ দিন বয়সী মেয়েকে নিয়ে আবার শুরু করলেন পড়াশোনার যুদ্ধ। দৃঢ় মনোবল আর প্রচণ্ড জেদ নিয়ে শেষ করেন এমবিবিএস।



পেশায় চিকিৎসক হলেও চিত্রকর্মের নেশা ছাড়তে পারেননি


প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর ওই মেডিকেলেই সফলভাবে ইন্টার্নি করেন ডা. মাহজাবিন। এমবিবিএস ডাক্তার তো হলেন। এখন কোন বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন তা নির্ধারণের পালা। এমবিবিএস পাস করার সময় যে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সবসময় তাকে পড়াশোনায় সাহায্য করতেন, এমবিবিএসের পর ওই বান্ধবী ডার্মাটোলজিতে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য ট্রেইনিংয়ে যোগ দেন। তাকে দেখে এই বিষয়ে অনুপ্রাণিত হন তিনি। এছাড়া স্বামীও স্কিন ডাক্তার । দুজনে মিলে ভবিষ্যতে মানুষের কল্যাণে সেবামূলক কাজ করতে স্ত্রীকেও ত্বকের লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসা নিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিন তিনি । ডা. মাহজাবিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে ডার্মাটোলজি অ্যান্ড ভেনেরোলোজিতে এক বছরের অনারারি ট্রেইনিং সম্পন্ন করেন।


ডা. মাহজাবিন বলেন, ঢাকা মেডিকেলে প্রশিক্ষণ নিতে এসে খুবই ভালো একজন শিক্ষাগুরু পেয়েছি। তিনি হলেন ঢাকা মেডিকেলের সহকারী অধ্যাপক এবং স্কিন, চুল বিশেষজ্ঞ ও ডর্মাটোলোজিস্ট ডা. এস এম বখতিয়ার কামাল স্যার। উনার হাতেই অ্যাসথেটিকস ডার্মাটোলজি বিষয়ে আমার প্রথম হাতেখড়ি। পরে ঢাকা মেডিকেলে অনারারি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করি। সেখান থেকে অ্যাসথেটিকসের কাজ শেখার নেশায় যোগ দেই ডা. ঝুমু খান'স লেজার মেডিকেল সেন্টারে। সেখানেও ডা. ঝুমু খানে ম্যামের অধীনে প্রায় দুই বছর পার্টটাইম হিসেবে চাকরি করি। ঝুমু ম্যাডাম আমাকে হাতে ধরে ধরে অনেক যত্ন করে ত্বকের লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।



মাহজাবিনের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বর্ণিল ক্যানভাস


এরই মধ্যে ডা. মাহজাবিন যোগ দেন ঢাকা সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে। চাকরির পাশাপাশি ডা. ঝুমু খানের অধীনে পার্টটাইম চাকরিটা চালিয়ে নেন। চাকরির মধ্যেই সময় সুযোগ করে ত্বকের বিষয়ে ইন্ডিয়া থেকে ফেলোশিপ ইন ইনস্টিটিউট অব লেজার অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস মেডিসিন কোর্স সম্পন্ন করেন। ত্বকের লেজার বিষয়ে শেখার নেশা দিন দিন বাড়তে থাকে তার। সেই টানে জার্মানির ইউনির্ভাসিটি অব গ্রেইফসওয়াল্ড থেকে লেজার অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস মেডিসিন বিষয়ে ফেলশিপ করেন তিনি। এর সাথে সাথে তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন ঝুমুখান লেজার মেডিকেল সেন্টার লিমিটেডে। সেই সাথে দেশে ও বিদেশে যখন যেখানে লেজার অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস বিষয়ে সার্টিফিকেট ট্রেনিং হয় সেখানে নিয়মিত যোগ দেন। বর্তমানে তিনি রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে কাজ করছেন।


মাহজাবিনের স্বামী ডা. সৈয়েদ রোকোনুজ্জামান কাজ করছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের স্কিন বিভাগে। দুজনের কাজই ত্বক নিয়ে। সাধারণত দেশের মানুষ ত্বক বা চুলের খুব একটা যত্ন করে না। অবহেলা করে। অনেক সময় নানান জটিল রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগ মানুষের জন্যই ত্বকের লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। ডা. মাহজাবিন ভাবলেন গরিব ও মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে ত্বক ও চুলের চিকিৎসা পৌঁছে দিতে দুজনে মিলে কোনো উদ্যোগ নিলে কেমন হয়। সুন্দর উদ্যোগকে অভিনন্দন জানান স্বামী। প্রতিষ্ঠা করেন স্কিনোলজিক স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার (Skinologic Skin & Hair Care) নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই সাধারণ মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে ত্বকের লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসা পৌঁছে দিতে কাজ করছে। Skinologic এ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।



আছে টুকরো টুকরো অর্জন


ডা. মাহজাবিন বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ত্বকের লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরনের চিকিৎসা তুলে দিতে চাই। এছাড়াও ত্বকের যত্ন নিয়ে নানা ধরনের সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করে যাচ্ছি। এখানে লেজার বা অ্যাসথেটিকস চিকিৎসার পাশাপাশি স্কিন সার্জারির কাজও হয়ে থাকে।


সাধারণত কোন কোন রোগের ক্ষেত্রে অ্যাসথেটিকস চিকিৎসা কার্যকর? এ প্রসঙ্গে ডা. মাহজাবিন বলেন, ত্বকের আধুনিক চিকিৎসায় লেজার অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস ট্রিটমেন্ট বেশ জনপ্রিয়। ব্রনের দাগ, মেছতা, অবাঞ্চিত লোম, তিল, আঁচিল, শ্বেতী, ব্রনের গর্ত প্রভৃতি ক্ষেত্রে লেজার চিকিৎসা উপকারী। যেকোনো দাগ ঢাকতে, লোম সরাতে, চুল গজাতে, মেদ কমাতে এবং আরো অনেক সমস্যায় মানুষ বেছে নিচ্ছে এই ট্রিটমেন্টকে। আজ এ চিকিৎসা উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।


তবে মনে রাখা ভালো, লেজার সব রোগের জন্য প্রযোজ্য নয়। ত্বকের এমন কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো প্রথমে ওষুধ দিয়ে সারানোর চেষ্টা করা হয়। একেবারেই ভালো না হলে লেজার করানো হয়।


ডা. মাহজাবিনের পেশা মানুষের ত্বকের চিকিৎসা দেয়া। নেশা হলো ছবি আঁকা। ছোটবেলার সে নেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। গত করোনার সময় বাসায় বসে বসে ছবি আঁকতেন। উদ্দেশ্য ওই ছবিগুলো বিক্রির টাকার ৬০% প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য দান করা। গত এক বছরে সেটা তিনি একটা প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানে দানও করেছেন।


পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং নিজের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে সময় পেলেই পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও প্রকৃতির মাঝে ঘুরতে চলে যান ডা. মাহজাবিন। ভ্রমণ করতে ভীষণ পছন্দ তার। অবসরে নিজের পেশাগত কাজ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে লেখালেখিও করেন।


ডা. মাহজাবিন আজ যা হয়েছেন সব কিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে চান তার পরিবারকে। তার এ পর্যন্ত আসার পেছনে পরিবার, স্বামীর ভূমিকা অনেক বেশি বলে জানান তিনি। তার স্বামী তার এই সেবামূলক কাজের অনুপ্রেরণা, মানসিক শক্তির উৎস। সেই সাথে ধন্যবাদ জানাতে চান তার প্রিয় বন্ধুকে যার জন্য তার মেডিকেলের পড়া শেষ করা সহজ হয়েছে। আর ধন্যবাদ জানাতে চান তার আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের, যাদের আন্তরিক সহযোগিতা এবং উৎসাহে অনেক কঠিন সময়ে কাজগুলো সহজভাবে করতে পেরেছেন।



যেতে হবে বহুদূর


সারা জীবন মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চান স্বপ্নবাজ এই স্কিন চিকিৎসক। ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, আমার সব স্বপ্ন এখন ‘স্কিনোলজিক স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার’কে ঘিরে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে একটা এমন কিছু করতে চাই যেটা মানুষের সেবায় ব্যবহার করা যাবে। অল্প দিনেই এই সেন্টার মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। অসংখ্য রোগী সল্প খরচে স্কিনের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন। সাধারণ মানুষেরা যাতে সুলভ মূল্যে আমাদের সেবাগুলো পেতে পারেন সে ব্যবস্থার পরিকল্পনা করছি। এছাড়াও উত্তরায় আরেকটা ব্র্যাঞ্চ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে উদ্যোগটাকে একদিন ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। আমার বিশ্বাস আমরা সেটা করতে পারবো। সেই সাথে সবার দোয়া চাই।


বিবার্তা/গমেজ/কেআর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com