কালের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ১৬:১৮
কালের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

এক সময় শিশুদের খেলাধুলার প্রধান উপকরণ ছিল মাটির তৈরি পুতুল, হাড়ি-পাতিল ও হাতি-ঘোড়া। পুতুলের সঙ্গে পুতুলের বিয়ে দেয়া আর হাড়ি-পাতিল নিয়ে চড়ুভাতি খেলায় সারাক্ষণ আনন্দে মেতে থাকত শিশুরা। শিশুদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাদুঘর গ্রামের পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা তৈরি করতো হরেক রকমের খেলনা। সবচেয়ে বেশি খেলনা বিক্রি হতো বিভিন্ন মেলায়। আর তাই মেলার জন্য ব্যস্ত ছিল মৃৎশিল্পীরা। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা পালপাড়ায় আসতেন মেলার জন্য পুতুল, হাড়ি-পাতিল ও হাতি-ঘোড়াসহ নানা ধরণের মাটির তৈরি খেলনা এবং জিনিসপত্র বানানোর অর্ডার নিয়ে। রাত-দিন কাজ করে পাইকারদের অর্ডার ডেলিভারী দিতেন মৃৎশিল্পীরা।


আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বসেছে ব্রাহ্মণাবড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।


পালপাড়ায় প্রায় পাঁচশতাধিক মানুষের বসবাস। এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের। তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস এই মৃৎশিল্প। তবে এখন অনেকেই এই পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় মনযোগী হয়েছেন। বছর পাঁচেক আগেও পালপাড়ার ৪০-৫০টি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল।


কিন্তু দিন-দিন প্লাস্টিকের কারণে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় মৃৎশিল্পের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। প্লাস্টিকের পণ্য বাজারে আসার পর থেকেই পালপাড়ার দুঃখ যেন আরও বেড়েছে। এখন কেবল ৮ -১০টি পরিবার এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তবে তাদের কেউই শিশুদের জন্য খেলনা সামগ্রী তৈরি করেন না। তিতাস নদী ও বিভিন্ন বিল থেকে এঁটেল মাটি এনে দইয়ের পাতিল ও গ্লাস বানিয়ে ধরে রেখেছেন পালপাড়ার ঐতিহ্য।


পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে এখনও টুকটাক মাটির জিনিসপত্র বানান ঝন্টু পাল। অন্যকাজের পাশাপাশি বাড়ির মহিলাদের নিয়ে দইয়ের পাতিল ও গ্লাস বানিয়েও কিছু টাকা আয় হয় তার। তিনি বলেন, আগে বিভিন্ন মেলার জন্য পুতুল, হাতি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন খেলনা বানিয়েছি। পাইকাররা এসে অর্ডার দিয়ে যেতো। কিন্তু এখন এসব চলেনা, তাই বানাইও না। মিষ্টির দোকানে মাটির তৈরি পাতিল-গ্লাস না নিলে এগুলো বানানো বন্ধ হয়ে যাবে।


পালপাড়ার বাসিন্দা পিংকি রাণী বলেন, আগে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের অনেক চাহিদা ছিল। আমরা রাতে-দিনে কাজ করে পাইকারদের অর্ডার ডেলিভারী করেছি। পুতুল, হাতি-ঘোড়া আরও কত কি বানিয়েছি। এখন আর সেই দিন নেই। মাটির জিনিস ভেঙে যাবে- সেই অজুহাতে কেউ নিতে চায় না। দইয়ের পাতিল-গ্লাস বানিয়ে কোনো রকমে টিকে আছি। বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও আর এসব কাজ করতে চায় না। কারণ এ কাজে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সে অনুযায়ী ভালো দাম পাওয়া যায়না।


তিনি বলেন, যখন মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা ছিল তখন আমরা হাড়ি-পাতিল, কলস, মটকা, সরাসহ বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী বানিয়েছি। তখন ব্যবসা ভালো ছিল, সংসারও ভালো চলতো। এখন মাটির জিনিসের চাহিদা নেই। তাই এখন কৃষিকাজও করি। প্লাস্টিক বাজারে আসার পর থেকে আমাদের জন্য দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, মৃৎশিল্প আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। ভাদঘুর গ্রামের পালপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মৃৎশিল্প বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু সেই খ্যাতি হারিয়ে যাচ্ছে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। এছাড়া এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।


এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো:ইয়ামিন হোসেন বলেন, মৃৎশিল্প আমাদের প্রাচীন একটি শিল্প। এই শিল্পকে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের উদ্যোগ নেয়া হবে।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পালপাড়ার শতবর্ষের ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প। আবহমান বাংলার এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। বিশিষ্টজনদের অভিমত প্রচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে ।


বিবার্তা/নিয়ামুল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com