আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমার কাছের এক বন্ধু বেশ কিছুদিন ক্লাসে অনুপস্থিত। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম আন্টির স্তন ক্যান্সার। অপারেশন করতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরেরই আন্টি তার শরীরে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছিলেন। হাতের কাছে মাংসপেশি নাকি দলা পাকিয়ে উঠছিলো তার। কিন্তু অফিসের চাপ, সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা সব মিলিয়ে ডাক্তার দেখানোর সময় করে উঠতে পারেননি তিনি। ডাক্তার দেখানোর সময় পেলেন মাস দেড়েক পর! তখনই সার্জারি করাতে হলো। বায়োপসিতে ক্যানসার ধরা পড়ল। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান ছক দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, প্রচুর নিয়মকানুন মানতে হবে। আগে এলে এত সমস্যাই হত না।

হলের এক বড় আপু, বেশ চুটিয়ে সংসার করছেন। সদ্য মা হয়েছেন। একদিন স্নানের সময় তার মনে হলো, স্তনে একটা শক্ত দলা মতো ঠেকছে। সে দিনই সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে গেলেন। সাত-আট মাস ধরে কেমোথেরাপি চলল। তার পর গত তিন বছর ধরে কিন্তু একেবারে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন তিনি।

কাজেই, স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে কোনো বয়সে অসুখ ধরা পড়ছে, সেটা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হলো কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হচ্ছে। ব্রেস্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে অন্যান্য বেশ কিছু ক্যান্সারের চেয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারে ১০-১৫ বছর বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশ্ব জুড়ে সাধারণত তিরিশ থেকে ষাট বছর বয়সি মহিলাদের এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে এশিয়ায় ৩০ বছরের মহিলাদেরও এই রোগ হচ্ছে। তাই একটু সন্দেহ হলেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তা হলে রোগ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়বে না। এই অসুখের রোগলক্ষণ, রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

কী ভাবে চিনবেন

• স্তনে ব্যথাহীন শক্ত টিউমর হতে পারে। ব্যথা নেই বলে ডাক্তারকে দেখাতে দেরি করবেন না। তবে স্তনে টিউমর মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়। ৮৫% ব্রেস্ট টিউমর ম্যালিগন্যান্ট হয় না। তবুও ব্যথা হোক বা না হোক, স্তনে কোনো শক্ত ভাব দেখা দিলে তখনই চিকিৎসকের কাছে যান।

• স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত পড়াও একটি লক্ষণ। তবে এই লক্ষণ থাকলেও ৮০% ক্ষেত্রে ক্যান্সার হয় না। সংক্রমণ বা বিনাইন টিউমরের জন্যও এমন হতে পারে। স্তনবৃন্ত ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, ব্যথা নেই— সে ক্ষেত্রেও ক্যান্সার হতে পারে।

• অ্যাডভান্সড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে স্তনের চামড়া শক্ত হয়ে কমলালেবুর চোকলার মতো হয়ে যায়। ব্যথা কম থাকে।

• ব্রেস্টে ক্যান্সার হলেও তার লক্ষণ বাহুমূলেও ফুটে উঠতে পারে। তাই এই অংশে বড় বড় গ্ল্যান্ড ফুলে উঠলেও সাবধান হন।

কাদের হতে পারে?

যে কোনো বয়সে, যে কোনো মহিলার স্তন ক্যান্সার হতে পারে। আমাদের দেশে ৯১% ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের কোনো পারিবারিক ইতিহাস থাকে না। তবে যাদের পরিবারে আগে এই রোগ হয়েছে, সেখানে অনেক সময়ে একটা ‘ক্লাস্টার’দেখা যায়। অর্থাৎ যার এই অসুখ হয়েছিল তার বোনের মধ্যে বা দু’-এক প্রজন্ম পরের বংশধরদের মধ্যে আবার রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা যেতেই পারে। তাই এমন পরিবারের মানুষকে একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলে, যাদের বাড়িতে আগে এই রোগ ছিল না, তারা খুব নিশ্চিন্ত থাকবেন এমনটা একেবারেই নয়। প্রত্যেককেই খুব সাবধান হতে হবে।

কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যেস মানলে, ফুসফুস পাকস্থলী বা মুখের ক্যান্সার অনেক সময়ই প্রতিরোধ সম্ভব। ব্যক্তিগত অঙ্গ সুরক্ষিত রাখলে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে। কিন্তু চিকিৎসকেরা লক্ষ করেছেন যে, স্তন ক্যান্সার খুব দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। অথচ কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ জানা সম্ভব হচ্ছে না। রোগের কারণ স্পষ্ট নয় বলেই এ রোগকে আটকানোর উপায়ও জানা নেই।

তবে আতঙ্কিত হবেন না। খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে, এ রোগকে দমিয়ে রাখা যায়। এমনকি আর্লি ডায়াগনসিস-এ অনেক সময়ে স্তন বাদও দিতে হয় না। স্তনের আকৃতিরও পরিবর্তন হয় না। চিকিৎসার খরচও কমে।

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা

প্রতি মাসে ঋতুচক্রের পাঁচ-ছ’দিন বাদে স্নানের সময়ে হাত দিয়ে নিজের স্তন পরীক্ষা করার অভ্যেস রাখুন। নিয়মিত এই পরীক্ষা কিন্তু বিপদের আভাস অনেক আগেই দিয়ে দেয়। স্তন বা বাহুমূলে কোনো রোগলক্ষণ অনুভব করলে, তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বয়স ৩০ পেরোলে প্রত্যেক মহিলারই ক্লিনিকাল চেকআপ করানো উচিত। ৪০ বছর বয়সের পরে রুটিন ম্যামোগ্রাফি করা যেতে পারে।

অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা টার্গেটেড থেরাপি-র (খুব ছোট টিউমর ধরে চিকিৎসা) মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়। অল্টারনেটিভ মেডিসিনে কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব নয়। এক বার ক্যান্সার মুক্ত হলেও পরে অসুখ ফিরতে পারে। তাই রুটিন চেকআপ অত্যাবশ্যক।

বিবার্তা/অনামিকা/জাই