
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ১৮টি পিআইসি প্রকল্প দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৩৫ লাখ টাকা লুটপাট, অনিয়ম ও প্রকল্প প্রদানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে কাজ না করে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আওতায় আসা বরাদ্দের অর্থ নামকাওয়াস্তে প্রকল্প দেখিয়ে তোলা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। অনুসন্ধানে তার সত্যতাও মিলেছে।
এ কাজে উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রকৌশলী অফিস ও প্রকল্প সভাপতিরা জড়িত বলে জনপ্রতিনিধিগণ মন্তব্য করেছেন।
কেননা, উপজেলা চেয়ারম্যান তার একক ক্ষমতাবলে একচেটিয়া ভাবে পছন্দের লোকদের নামে-বেনামে এসব প্রকল্প দিয়েছেন। যেহেতু উপজেলা পরিষদের পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মিত কোন প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয় না। পাঁচ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছ থেকে কোন ধরনের প্রকল্প চাহিদাও নেওয়া হয় না। যার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা।
প্রতিবেদকের অনুসন্ধান ও উপজেলা এলজিইডি অফিসের কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে যে ১৮টি প্রকল্পের নাম হাতে এসেছে। সে সব হলো-১. কর্ণফুলীর শিকলবাহা ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামত নামে আবদুল্লাহ আল মামুনকে ২ লাখ টাকা ২. কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মৎস্য পোনা বিতরণ নামে সাজ্জাদ খাঁনকে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা ৩. বড়উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নামে সাজ্জাদ খাঁনকে ২ লাখ টাকা ৪. চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামত কাজের নামে জয়নাল আবেদিনকে ২ লাখ টাকা ৫. নামহীন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে আইসিটি উপকরণ বিতরণের নামে মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে ২ লাখ টাকা ৬. চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামত কাজের নামে নুরতাজ বেগমকে ২ লাখ টাকা ৭. শিকলবাহা ইউনিয়নের চরহাজারী বিলে কৃষি নলকূপ স্থাপনের নামে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ২ লাখ টাকা ৮. বড়উঠানের দৌলতপুর এমআর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চ-ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নামে সাজ্জাদ খাঁনকে ২ লাখ টাকা ৯. জুলধা ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামত কাজের নামে মো. জয়নুল আবেদীন বাবুকে ২ লাখ টাকা।
এছাড়াও ১০. জুলধা ডাঙারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চ-ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নামে মো. জয়নুল আবেদীন বাবুকে ২ লাখ টাকা ১১. উত্তর শিকলবাহা আহসানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চ-ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নামে কহিনুর আক্তারকে ২ লাখ টাকা ১২. বড়উঠান ইউনিয়নের পূর্ব শাহমীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৈদ্যুতিক পাখা সরবরাহের নামে নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে ২ লাখ টাকা ১৩. চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের চরলক্ষ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চ-ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নামে মোহাম্মদ হাসানকে ২ লাখ টাকা ১৪. চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে বেঞ্চ-ক্রীড়া ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নামে মোহাম্মদ হাসানকে ২ লাখ টাকা ১৫. চরলক্ষ্যার পশ্চিমার বিলে কৃষি নলকূপ স্থাপনের নামে জয়নাল আবেদিনকে ২ লাখ টাকা ১৬. পূর্ব জুলধার ইউনিয়ন বিলে কৃষি নলকূপ স্থাপনের নামে জয়নুল আবেদীন বাবুকে ২ লাখ টাকা ১৭. বড়উঠান উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আইপিএস সরবরাহের নামে মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে ২ লাখ টাকা ১৮. কাজ তদারকি ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার নামে চরলক্ষ্যার মো. হাসানকে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।
এতে মোট ১৮টি প্রকল্পে ৩৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার অভিযোগ। এ টাকা তোলা হয়েছে গত ২৪ জুন। অথচ উন্নয়নের নামে এসব পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) নেওয়া হয়। এই ১৮টি পিআইসি প্রকল্পের মধ্যে দুটি দুই লাখ টাকার নিচে। বাকি ১৬টির প্রাক্কলিক মূল্য ২ লাখ টাকা করে।
প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিকলবাহা ইউনিয়নে প্রকল্প গেছে ৩টি, বড়উঠান ইউনিয়নে প্রকল্প গেছে ৬টি, জুলধা ইউনিয়নে গেছে ৩টি, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে গেছে ১টি, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে গেছে ৫টি। এরমধ্যে অধিক সংখ্যক প্রকল্প ও অর্থ গেছে উপজেলা চেয়ারম্যানের ইউনিয়নে। এরপর গেছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ইউনিয়নে। আর সবচেয়ে নগন্য বরাদ্দ গেলো চরপাথরঘাটায়।
এতে একই ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। যেমন-বড়উঠানের ইউপি সদস্য সাজ্জাদ খাঁন পেয়েছেন ৩টি প্রকল্প, একই ইউনিয়নের নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ৩টি প্রকল্প, জুলধার ইউপি সদস্য জয়নুল আবেদীন বাবু ৩টি প্রকল্প, চরলক্ষ্যার ইউপি সদস্য মো. হাসান ৩টি প্রকল্প, একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদিন ২টি প্রকল্প, শিকলবাহার ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ২টি প্রকল্প, উত্তর শিকলবাহার সংরক্ষিত ইউপি সদস্য কহিনুর আক্তার ১টি প্রকল্প ও সর্বশেষ চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য নুরতাজ বেগম পেলেন ১টি প্রকল্প পেয়েছেন।
এছাড়াও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নিজের এলাকায় একের পর এক প্রকল্প দেওয়া মানে জনপ্রতিনিধিদের নীতিরও বৈষম্যকরণ বলে মনে করছেন সাধারণ জনগণ। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তালিকায় দেখা মিলেনি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার নামে কোন প্রকল্প। একই তালিকায় নেই চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের কোন জনপ্রতিনিধিকে দেওয়া প্রকল্পও।
পর্যালাচনায় আরো দেখা যায়, এ প্রকল্পে সরকারি টাকায় কি ক্রয় করা হয়েছে। ক্রয় আইন ও বিধিমালা মানা হয়েছে কিনা, না নিম্নমানের কোন সামগ্রী ব্যবহারের জন্য কেনা হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। কর্ণফুলীর দুই ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এলজিইডি অফিসের প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও অফিস সহকারি জসিম উদ্দিন এসব অনিয়ম সরাসরি জড়িত। এরা অফিসের দরজা সব সময় বন্ধ করে এসব কাজ করেন। প্রকল্পে কমিশন ঠিক করে তারপর অর্থ লুটপাটে সহযোগিতা করেন।'
এ বিষয়ে শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম বিবার্তাকে বলেন, ‘মাসিক সমন্বয় মিটিং হয় কিন্তু মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বরাদ্দের কোন সমন্বয় হয় না। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যাকে ইচ্ছে তাকে প্রকল্প দিচ্ছে। এখন না শুধু বিগত সময়েও কোন চেয়ারম্যান মেম্বার থেকে প্রকল্প চাহিদা নেওয়া হয় না।'
কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী'র কাছে অনিয়ম আর অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য এই রিপোর্ট লেখাকালীন সময়ে পরপর কয়েকবার ফোন করা হয় কিন্তু কোন ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমির আহমদ বিবার্তাকে বলেন, 'এসব প্রকল্প নিতে আমাদের কখনো জানানো হয় না। কাকে কি প্রকল্প দিচ্ছে জানি না। পরের মিটিংয়ে জেনে জানাবো।'
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ডা. ফারহানা মমতাজ বিবার্তাকে জানান, 'তিনি গাড়িতে আছেন। পরে কল করে জানাবেন।' কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সম্ভবত মন্তব্য করতে ভুলে গেলেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা উমা খান কাফি ছুটিতে আছে বলে জানান। তবে পিআইও অফিসের সহকারি প্রকৌশলী তসলিমা ইসলাম চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, 'এডিপি বরাদ্দ কখনো আমাদের অফিসে আসে না। টিআর-কাবিকা আসে। এসব প্রকল্পের বিষয়ে এলজিইডি অফিস ভালো বলতে পারবে।'
উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা এলজিইডি অফিসের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী সুমন তালুকদারকে এসব বিষয় জানালে তিনি বিবার্তাকে বলেন, 'আপনি যে সব বিষয় আমাকে উপস্থাপন করেছেন, তা আমি নির্বাহী প্রকৌশলী জানাবো।'
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বিবার্তাকে বলেন, ‘ধন্যবাদ। বিষয়টি সরেজমিনে গিয়ে দেখা হবে। যদি কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন যথাযথভাবে না করে তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।'
চট্টগ্রাম বিভাগীয় এলজিইডি কার্যালয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব ও অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর মো. তৌফিক হাসান বিবার্তাকে বলেন, 'বিষয়টির খোঁজ খবর নিয়ে কোন অনিয়ম থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
বিবার্তা/রোমেল/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]