সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৪, ২২:০১
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

দুর্নীতি ও অনিয়মই যখন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় তখন শিক্ষার আলো সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য হয় মরীচিকা। ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের কথা বলছি। একসময় বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্নদুয়ার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এখন অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির কারণে নীরবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।


স্বনামধন্য সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে নেই পরিবহন খাত, নেই শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা। অথচ, প্রতিবছর সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া হচ্ছে পরিবহন খরচ। সেই টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে সেই বিষয়ে নেই কর্তৃপক্ষের সদুত্তর। এছাড়াও, নানা অনিয়মে কলেজের ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হলেও কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য রীতিমতো বিস্ময়কর।


পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। কলেজটিতে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজের একটি।


১৯৪৯ সালের ১১ নভেম্বর নালগলার ৫/১, জুম্মন ব্যাপারী লেনে (ভাওয়ালরাজ এস্টেট) কলেজটির কার্যক্রম শুরু হয়। তখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপাধি অনুসারে কলেজের নাম রাখা হয় কায়েদ-ই-আজম কলেজ। পরবর্তীতে লক্ষ্মীবাজারে জমি ক্রয় করে কলেজটি স্থানান্তর করা হয়, আর নালগলার ভবনটি হয় ছাত্রাবাস। কলেজটিতে ১৯৫৮ সালে বিএসসি কোর্স চালু হয়। ওইসময় ঢাকার অন্য কোনো কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে নামকরণ হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর সরকারি হলে এর নাম হয় সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ।


২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে প্রতি বছর ভর্তি হয় প্রায় ১৯৯৫ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদে ৭৪০ জন, বাণিজ্য অনুষদে ৪০০ জন এবং কলা ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে ৮৫৫ জন।


২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ৪র্থ বর্ষের ভর্তি ফি বিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে, পরিবহন বাবদ ১০০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি এক সেশনে পরিবহন বাবদ পায় ১,৯৯,৫০০ টাকা। অর্থাৎ স্নাতকের ৪টি বর্ষ থেকে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি পরিবহন খাত থেকে নিচ্ছে ৭,৯৮,০০০ টাকা। এ তো গেলো স্নাতক, বাকি থাকল স্নাতকোত্তর। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে ১৭টি বিভাগে স্নাতকোত্তরের সুযোগ। সেই হিসাবে পরিবহন খাত থেকে আরো আসে প্রায় ২ লক্ষ টাকা। তাহলে পরিবহন খাতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের আয় বছরে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা।


এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কলেজের অফিসে যোগাযোগ করা হলে যেহেতু কাগজপত্রে পরিবহন খাত নেই- তাই এই বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য বা কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।


কলেজের এক শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে দশ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু তারপরেও প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। পরিবহন ব্যবস্থা না থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর মাথাপিছু ভর্তি ফির সাথে ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এবিষয়ে জানার চেষ্টা করলেও কলেজ কতৃপক্ষ জানায়নি পরিবহন খাতের টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে। পরিবহনের টাকা কোথায় খরচ হয় জানতে চেয়ে ২০১৮ সালে ‍শিক্ষার্থীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করেন ।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শুধু পরিবহন না কলেজ কতৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিচ্ছে শিক্ষা সফরের টাকা। কিন্তু ‍শিক্ষা সফর হয় না। ওই শিক্ষার্থী আরো বলেন, কেন নেওয়া হচ্ছে এই টাকা? কোন খাতে এই টাকা খরচ করা হচ্ছে?


এ বিষয়ে জানার জন্য কথা হয় কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমি শুধুমাত্র একাডেমিক বিষয়গুলো দেখি, আর্থিক বিষয়গুলো দেখি না। ক্লাস সঠিক সময়ে হচ্ছে কি না, ইনকোর্স পরীক্ষা হচ্ছে কিনা এটা দেখি।


বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোহসিন কবীরের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমাদের একটি গাড়ি আছে, যেটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে ক্রয় করা হয়েছে। পরিবহনের খাতে উত্তোলিত টাকা দিয়ে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পরিবহন খাতের টাকা নেওয়া হচ্ছে নিয়ম মেনে। এখানে কোনো সমস্যা নেই।


তবে জানা যায়, ওই প্রাইভেট গাড়িটি কলেজ অধ্যক্ষ অফিসে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন। অধ্যক্ষ যে গাড়িটি ব্যাবহার করেন- সেবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার হয় না। কলেজের বিভিন্ন কাজে, যখন পরীক্ষা-টরীক্ষা থাকে তখন ব্যবহৃত হয়।


প্রতি বছর প্রায় আট নয় হাজার স্টুডেন্ট এখানে ভর্তি হয়। পরিবহন খরচবাবদ জনপ্রতি ১০০ টাকা তো অনেক টাকা। এর এক টাকাও কি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে খরচ হয়? তাহলে পরিবহনের জন্য প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা কেন নিচ্ছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বিবার্তাকে বলেন, এটা তো আজকে থেকে না, অনেক আগে থেকেই- যখন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে গাড়ি কেনা হয়েছে তখন থেকেই এমন হচ্ছে। আমি তো কয় বছর হয় এসেছি, কিন্তু এটা তো আগে থেকেই হচ্ছে। বাংলা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, সব কলেজেই এমনভাবে হয়। প্রশাসনিকভাবে কোনো সমস্যা নেই এবং ফান্ডের টাকাটি পরবর্তী খরচের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে বলেই জানান তিনি।


তবে, পরিবহন খাত ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে বিভিন্ন খাত নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কলেজটিতে প্রাক-নির্বাচনি ও নির্বাচনি পরীক্ষা বাবদ টাকা নেওয়া হলেও শুধু নির্বাচনি পরীক্ষাই অনুষ্ঠিত হয়। এই বিষয় নিয়ে বিবার্তার পক্ষ থেকে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোহসিন কবীর এরকম কিছু জানেন না বলে জানান।


কলেজের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষা সফরের কথা বলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয়, সেই টাকার অঙ্ক শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হওয়া মূল খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। আরো জানা যায়, সফরে যাওয়া শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চাঁদার টাকাতেই শিক্ষা সফরে যান। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আড়ালে কথা বললেও, সম্মুখে বলতে চায় না।


তবে অধ্যক্ষের দাবি, কলেজ থেকে শিক্ষা সফরের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়। যেসব বিভাগে শিক্ষা সফরে যাওয়া বাধ্যতামূলক, সেসব বিভাগে ভর্তুকি দেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদের থেকে অল্পকিছু খরচ নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।


শিক্ষা সফরের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে আরো জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন বিভাগে এমন হচ্ছে জানান। বাংলা ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে এমন হচ্ছে জানালে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান অধ্যক্ষ।


তবে, অধ্যক্ষ সকল অনিয়মের বিষয়েই 'খতিয়ে দেখা'র প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে দীর্ঘ সময় ধরে কলেজ চালিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, এই সকল বিষয়ে একাধিকবার জানানো হলে, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের স্বেচ্ছাচারিতা বহাল রেখেছেন, যার প্রভাব পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর।


বিবার্তা/এসএফ/এসবি/রোমেল/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com