বাড়ছে বেকারত্ব, পঠিত বিষয় সংশ্লিষ্ট ক্যারিয়ারে অনীহা!
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:৩৪
বাড়ছে বেকারত্ব, পঠিত বিষয় সংশ্লিষ্ট ক্যারিয়ারে অনীহা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে যেমন উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিনকে দিন বাড়ছে, এরই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে বেকারত্বও। এদিকে উচ্চ শিক্ষিতদের অনেকে আবার নিজের পঠিত বিষয়সংশ্লিষ্ট জবে ক্যারিয়ার গড়তে চায় না। এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের টেকনিক্যাল পড়াশোনায় অর্জিত জ্ঞানকে বাদ দিয়ে বিসিএসসহ নানা পরীক্ষায় বসছেন আর সফলও হচ্ছেন। স্পেসাল বিসিএস ছাড়া মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য



ফলে প্রশ্ন উঠেছে এসব শিক্ষার্থীদের টেকনিক্যাল পড়াশোনায় অর্জিত জ্ঞানের কাজ কী? এই বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে বেকারত্ব যে বাড়ছে এটা যেমন সত্য, একইসাথে কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় পঠিত বিষয়ের প্রতি বিমুখ হওয়ার বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। তবে এক্ষেত্রে নানা ফ্যাক্টরও কাজ করে। কেন শিক্ষার্থীরা অন্যপেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইছে- সেটা ভাবতে হবে, আর বেকারত্ব দূরীকরণে কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে।



বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে (৩ মাসে) দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আর গত বছরের শেষ কোয়ার্টারে এই সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার অর্থাৎ গত বছরের শেষ ৩ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে বেকারের সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার বেড়েছে। এদিকে শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ এ একই তথ্য ফুটে উঠেছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার। যা মোট জনগোষ্ঠীর ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৭ লাখ ১০ হাজার, যা ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে যা ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮০ হাজার।


উভয় জরিপে উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের আলাদা পরিসংখ্যান না দেখানো হলেও তাদের অধিকাংশ এর আওতাভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


উচ্চ শিক্ষায় বেকারত্বের কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম আরিফ বিবার্তাকে বলেন, প্রতি বছর যে হারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে, সে অনুপাতে তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এছাড়া কোভিড পরিস্থিতি তাদের মাঝে হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। একদিকে চাকরি সোনার হরিণে পরিণত হওয়া, অন্যদিকে অনেকের চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ার বিষয়টিও চাকরিপ্রত্যাশীদের ভোগাচ্ছে। ফলে অনেকে হতাশ হতে হতে জীবনের মায়াও ত্যাগ করছেন।


দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠের উর্দু বিভাগ থেকে পাস করে চাকরির প্রতিযোগিতায় থাকা শিক্ষার্থী নাঈম ভূঁইয়া বিবার্তাকে বলেন, এমনিতে এখন চাকরির বাজার খুবই মন্দা। এরপর আবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরাও নিজেদের টেকনিক্যাল পড়াশোনায় অর্জিত পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএসসহ বড় সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন। ফলে তাদের মেধার কাছে আর্টসহ অন্যান্য গ্রুপের শিক্ষার্থীরা অনেকক্ষেত্রে ছিটকে পড়ছেন।


তিনি বলেন, সাধারণত সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের ম্যাথ, বিজ্ঞানে বেসিক ক্লিয়ার থাকাসহ অন্যান্য বিষয়েও তারা সহজে নিজেদের আয়ত্বে নিতে পারে। এদিকে অন্যান্য গ্রুপের অনেক শিক্ষার্থীদের ম্যাথ, বিজ্ঞান বিষয়গুলো যেন আতঙ্কের নাম। ফলে তারা চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে খারাপ করে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শিক্ষার্থীও আছে।


এই শিক্ষার্থীর বক্তব্যের প্রমাণও পাওয়া যায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে পাওয়া তথ্যে। এতে দেখা যায়, ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারের নিয়োগ পেয়েছেন ২৪৫ জন। এর মধ্যে ৫৫ জন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে)। এই ক্যাডারের মধ্যে প্রথম ২০ জনের ৯ জনই বুয়েট শিক্ষার্থী ছিলেন। পুলিশ ক্যাডারের ৭১ জনের মধ্যে চার জন বুয়েটের। আর পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৪ জনের মধ্যে বুয়েটের রয়েছেন ৯ জন। এ ছাড়া শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন বুয়েটের ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হোসেন। আর পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের মোহাইমিনুল ইসলাম। শুধু বুয়েট নয়, বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি ভালো জবগুলোতে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারসহ টেকনিক্যাল পড়াশোনা যারা করেছেন তারাও আবেদন করছেন। দিনকে দিন তাদের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। এদিকে সফলও হচ্ছেন এসব শিক্ষার্থীরা।


উচ্চ শিক্ষিতদের বেকার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, কর্মমুখীসহ ল্যাবকেন্দ্রিক শিক্ষা বাংলাদেশে খুব কম হচ্ছে। তাই এ জায়গাগুলোতে অ্যাড্রেস করতে আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু এর একটা সমন্বিত ব্যবস্থা থাকা উচিত। আরেকটি বিষয়, আমাদের পরিকল্পনাগুলো আরো দ্রুত পর্যায়ে করা উচিত। এটি আসলে সময় সাপেক্ষে করার প্রয়োজন নেই। যে জিনিসটা দ্রুত প্রয়োজন সেটিকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলা দেয়া ঠিক না। পরিকল্পনা করতে করতে বিষয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে, অপরিহার্যতা রয়েছে, সেটিও অনেক সময় ফুরিয়ে যায়। এ জায়গাগুলোতে কাজ করার অনেক কিছু আছে। কিন্তু কোথায় জানি শিক্ষাব্যবস্থা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বড় ও মহাপরিকল্পনার জন্য পলিসি মেকারদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার উচিত। এক্ষেত্রে তাদের দেখা উচিত, শিক্ষা প্রকৃত অর্থে অগ্রাধিকার পাচ্ছে কিনা?


আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের বিশাল মানবগোষ্ঠী এই প্রজন্মকে যদি দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, যোগ্য মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা যায়, তাহলে তারা দেশ-বিদেশে অনেক বড় রকমের ভূমিকা পালন করবে। আর সেটি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। সুতরাং আমি মনে করি যে, একটি সমন্বিত ব্যবস্থা থাকা উচিত, যেখানে উপর্যুক্ত শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর তাদের ক্লাস রুমে পাঠাতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষা দিতে হবে। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলি। এই শিল্পবিপ্লবে উপর্যুক্ত শিক্ষা, বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা, অনেক বেশি ল্যাবকেন্দ্রিক শিক্ষা দিতে হবে।


বেকারত্ব দূরীকরণের বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও উপসচিব সুব্রত পাল বিবার্তাকে বলেন, 'কারিগরি কথাটির অর্থ হলো- শিল্প প্রণালীর দক্ষতা সম্পর্কিত। যে বিশেষ শিক্ষা দ্বারা এই প্রণালীগত দক্ষতার বিকাশ ঘটানো হয়, তাই কারিগরি শিক্ষা। আর এ শিক্ষায় যে দেশ যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। বেকারত্ব দূরীকরণ ও দেশের উন্নয়ন নিশ্চতকরণের এ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের চাহিদা বেশি এবং তাদের আয়ও অনেক ভালো। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। জনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।


এদিকে শিক্ষার্থীদের টেকনিক্যাল পড়াশোনায় অর্জিত জ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য চাকরি করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বিবার্তাকে বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, আমি যে বিষয়ে লেখাপড়া করে বিদ্যা অর্জন করেছি সেটাকে কাজে না লাগিয়ে বিসিএসসহ ভিন্ন দিকে ছুটছি। তাহলে এতো বছর আমার এই পড়াশোনার মানে কী? তবে এটাও ঠিক যে, যেখানে সুযোগ সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা সেখানে যেতে চাইবে।


তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের টেকনিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবন শেষ করে যদি টেকনিক্যাল কাজ করতে না চায় তাহলে তার ৪ বছরের অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ কিভাবে হবে? আমি এই ক্যাডার হচ্ছি, ওই ক্যাডার হচ্ছি। কিন্তু যে বিষয়ে ক্যাডার হলাম সেটা নিয়ে তো আগে থেকে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ করান হচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক মর্যাদাসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা আজ টেকনিক্যাল কাজ না করে ক্যাডারসহ অন্যান্য লোভনীয় চাকরি করতে চায়।


সার্বিক বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, নানা কারণে উচ্চ শিক্ষিতরা বেকার হচ্ছেন। এর মধ্যে বড় কারণ হলো কারিগরিসহ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা দিতে না পারা।


শিক্ষার্থীদের টেকনিক্যাল কেন্দ্রিক ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে অনাগ্রহী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে বেশ অসমতাও রয়েছে। সব চাকরির সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা এক রকম নয়। যেমন একজন বিসিএস ক্যাডার যে সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পান শিক্ষকসহ অন্য পেশার লোকেরা সাধারণত তা পান না। আমরা সব পেশাকে সম্মান জানাতে পারলে এমন হতো না। মানুষের নিজস্ব পছন্দ-স্বাধীনতা থাকতেই পারে। তাই বলে কোন কিছুর প্রতি একেবারে ঝুঁকে পড়ে নিজের টেকনিক্যাল জ্ঞান বাদ দিতে থাকি, আর এভাবেই যদি চলতেই থাকে, তাহলে তো মেধার অপচয় অবশ্যই হবে। তবে এটার সমাধানের জন্য আমাদের প্রতিটি সেক্টরে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে।


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com