লালনের গান, আমাদের সংবিধান এবং অনুভূতির মাপকাঠি
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৪, ১৯:০৫
লালনের গান, আমাদের সংবিধান এবং অনুভূতির মাপকাঠি
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দু’টি ঘটনা ঘটেছে- যদিও কোনটি খুব বেশি আলোচিত হয়নি, যতটা চর্চিত হচ্ছে ঢালিউড নায়ক শাকিব খানের তৃতীয় বিয়ে নিয়ে।


দুইটি ঘটনার প্রথমটি হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়। অন্যটি হচ্ছে লালনের গানের দুইটি লাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্টের দায়ে শরীয়তপুরে সঞ্জয় রক্ষিত নামক এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দুইটি ঘটনা একটির সাথে অন্যটি কোন ভাবেই সম্পর্কিত নয়।


ফেসবুকের স্টোরিতে লালন সাঁই এর বিখ্যাত ও বহুল প্রচলিত গান ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’- গানের দুটি লাইন, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী জাতির কি হয় বিধান’ পোস্টকে ঘিরে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি দাবি করেছেন, এই লেখার মাধ্যমে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তারা মৌখিক অভিযোগ করেছেন। তাই সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে সঞ্জয়কে আটক করে শরীয়তপুর জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ। যদিও পরে মুচলেকা দিয়ে তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।


সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাকিব হোসেন তার জামিন মঞ্জুর করেন। সংবাদ বিবরণে জানলাম, পুলিশ জানিয়েছে ফেসবুক স্টোরিতে স্ট্যাটাসকে ঘিরে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার ইউনিয়নের হরি নারায়ণ রক্ষিতের ছেলে সঞ্জয় রক্ষিতকে ভেদরগঞ্জ থানা পুলিশ রোববার আটক করে। সঞ্জয় পেশায় স্বর্ণকার। ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ (১) ধারায় তাকে আটক করা হয়েছিল। পরে অঙ্গীকারনামায় এই মর্মে স্বাক্ষর করেন যে, ভবিষ্যতে তিনি এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।


একই ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত ২৫ এপ্রিল ময়মনসিংহের এক কলেজের জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক সুনীল চন্দ্র ঘোষকে আটক করেছে পুলিশ। শম্ভুগঞ্জ বাইতুল আমান জামে মসজিদের ইমাম মো. কাইয়ূম বাদী হয়ে কোতোয়ালী মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করে। পরে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে সুনীল চন্দ্র ঘোষকে গ্রেফতার করে। তিনি এখনো জেলে।


প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত৷ বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারার আইনে এ সংক্রান্ত অপরাধ এবং শাস্তির বিধান আছে৷ মোটা দাগে এই অপরাধগুলো হলো:



  • ২৯৫– কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্মবোধে অবমাননা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উপাসনালয়ের ক্ষতি সাধন বা অপবিত্র করা৷

  • ২৯৫ (ক)– কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে উক্ত যে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজ৷

  • ২৯৬– ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি৷

  • ২৯৭– সমাধিস্থান ইত্যাদিতে অনধিকার প্রবেশ৷

  • ২৯৮– ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশে শব্দ উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি৷


এর বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ এই আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে৷ এ সব অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান আছে৷ যদিইও আইনে বলা আছে কোনো বিশেষ ধর্মের জন্য বা একক কোনো ধর্মকে সুরক্ষা দিতে এই আইন নয়৷’


নতুন করে সংযোজিত হয়েছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা নামে আরেক শব্দ।


একই দিনে পত্রিকা মারফত জানলাম প্রায় ৩৭ বছর (১৯৮৮ সালে) আগে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করা রিট আবেদন সরাসরি খারিজের রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করে না।


রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে সংবিধানে বলা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নীতি বাস্তবায়ন (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।


আবার সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহিদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল– বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।


এই মন্তব্যটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কী না, সেটি সংবিধান বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে সহজ যুক্তিতে আমি যা বুঝি, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সাবেক সবকিছু যদি অবৈধ হয়ে যায়, শুধুমাত্র এই একটিমাত্র বিষয় রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণাটি আলাদাভাবে আলোচনা হওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু? সেই রায়ে তো রাষ্ট্রধর্ম বিষয়টি স্বয়ংক্রিয় ভাবেই অবৈধ হয়ে যায়।


বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিষয় দু'টি ছিল না৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করা হয়৷ আর ১৯৮৮ সালে সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়৷ কিন্তু সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফেরার কথা বলা হয়৷ ২০১১ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফেরার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখে৷ এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ কিন্তু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকেই যায়৷ আরও মজার বিষয় হলো সেই সময়, বাংলাদেশে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতির আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল হাই কোর্ট।


হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে ওই আবেদন করেছিলেন সেই সময়ের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যখন এরশাদ ঘোষণা করেন, সেটির বিরোধিতা করেছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াত ইসলাম পর্যন্ত। রিটটি খারিজের সিদ্ধান্তের সঙ্গে বেঞ্চের তিন বিচারপতি একমত পোষণ করেছেন।


বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দারের লেখা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত শুধু মৌলিক নীতিগুলো অন্য কোনও বিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবিধানে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম মর্যাদা’ প্রদান করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। অনুচ্ছেদ ২(ক) অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পড়তে হবে এবং পড়লে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ধারণার সন্নিবেশ কোনোভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে না। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে না এবং সংবিধানে বাহুল্যও সৃষ্টি করে না।


রায়ে বলা হয়েছে, তর্কিত সংশোধনী সংবিধানে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকেও প্রভাবিত করে না। অতএব, আমরা মনে করি যে, তর্কিত সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২(ক) সন্নিবেশ করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানবিরোধী নয়। বিষয়টিকে সহজ করার প্রয়াস হিসেবে, উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক আমরা আমাদের রায়ে আলোচনা করেছি।


তবে, রায়ে পৃথক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তিনি বলেছেন, পঞ্চম সংশোধনীর মতোই সপ্তম সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসন বৈধ করা এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে রক্ষা করা। এই সংশোধনীতে দেশ অথবা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ কোথায়?


'সামরিক স্বৈরশাসন সংজ্ঞাগতভাবেই ধর্ম, নীতি ও আদর্শের তোয়াক্কা করে না। অথচ তারা অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করল। দেশে কোনও ধর্মীয় সংকট ছিল না, ছিল না কোনও সাংবিধানিক সংকট। তাছাড়া, এ বিষয়ে জনগণের পক্ষ থেকে কোনও দাবিও উত্থাপিত হয়নি। আশির দশকের স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করা ব্যতিরেকে যা কিছু করেছেন, তার সবই অধর্ম, অন্যায়, নীতিহীনতা, প্রতারণা, লুটতরাজ এবং বল্গাহীন দুর্নীতি। সন্ত্রাস এবং কুশাসন এ সব কিছু মিলেই এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে এ দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ দীর্ঘ ৯ বছর ধরে এই স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ করেছে।


আবার হাইকোর্টের এই বেঞ্চে ভিন্ন ধর্ম বা সম্প্রাদায়ের কোন বিচারপতির অংশগ্রহণ ছিল না। তাহলে যাপিত জীবন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রধর্ম কীভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে চিহ্নিত করে তার আভ্যন্তরীণ বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচনা বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ ছিল। রাষ্ট্রধর্মের সাংবিধানিক এই স্বীকৃতি আদতে কাগুজে বাঘ মনে হলেও এর শক্তি বিশাল, মানসিকভাবে মানুষকে সবল করে দেয়।


দুইটি বিষয় আলোচনার কারণ বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন এক ধরনের বাড়তি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই রামু, নাসিরনগর থেকে শুরু করে শাল্লার নোয়াগাও কিংবা শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলসহ অসংখ্য উদাহরণ। এর পিছনে ধর্মীয় কারণ ছাড়াও নেপথ্যে বেশিরভাগ জুড়েই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, জমি দখল, নারী সংক্রান্ত ধর্মান্তকরণ কাজ করে। এখন সেই ধর্মীয় অনুভূতি বা সামাজিক বিশৃঙ্খলার মাপকাঠি নির্ধারণের পরিমাপযন্ত্র তো এখনো আবিষ্কার হয়নি।



লালনের গান কিংবা বাউল শাহ আ. করিমের গান কালকে যদি কোন শিল্পী গায় ‘তন্ত্রমন্ত্র পড়ে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই, শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই’ অথবা মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের গান, ‘মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না ওরে মৌলানা’। এমনই দেশজুড়ে হাজারো গান কবিতা ছড়িয়ে আছে। সামাজিক বিশৃঙ্খলার নামে একে একে এসব বাউল গান, মাটির গানের একদিন গলা টিপে ধরবে মৌলবাদীরা।



ধর্মের নামে, সংবিধানের নামে, সংখ্যাগুরুর প্রভাবে এসব থামিয়ে দিতে বাধ্য করা হবে। সংবিধান সেখানে অন্তত রক্ষাকবচ হিসাবে থাকত। আদালতের রায়ের পর কিন্তু সেই পথও বন্ধ হয়ে গেল।


আমি সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন বা মানুষের আর্থিক সক্ষমতা লক্ষণীয় ভাবে উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও মানুষের ভিতরে দেশত্যাগের এক ধরনের তাড়না ব্যাপকাভবে কাজ করছে। লোকজন সরকারি চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে মনে হচ্ছে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভিতর সেই প্রবণতা আরও বেশি। এখন আর ভারত নয়, যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে তারা সন্তানদের নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাতে চায়। সেটা যেভাবেই সম্ভব। আমি অনেকের সাথেই কথা বলেছি। তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝার চেষ্টা করেছি। বুঝাতে চেয়েছি এইভাবে যদি দেশ ছেড়ে চলে যায় সবাই তাহলে তো এমনিতেই এই দেশে ৫০ বছর পর ইসলাম ছাড়া ভিন্ন ধর্মের কোন মানুষ থাকবে না। কোন ধরনের নির্যাতন নিপীড়ন ছাড়া এ তো এক ধরনের পলায়ন।


একেকজনের একেক ধরনের বক্তব্য মতামত। কিন্তু দিনশেষে মোটাদাগে যা দাঁড়ায়- সেটি হচ্ছে আতঙ্ক! কখন কি হয়, ছেলে মেয়ে যদি কিছু লিখে বসে, বা কখন কোথায় যদি চক্রান্তেও কোনোভাবে ফেঁসে যায়- এই এক ভয়। দ্বিতীয় ভয় সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ দিনদিন বাড়ছে। ধরে নিলাম শেখ হাসিনা যতদিন আছেন কোন না কোন ভাবে আমরা নিরাপদ, এরপর কী হবে? আমরা না হয় আমাদের জীবন কাটিয়ে দিব, পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভাল ভাবে থাকতে পারে এই জন্যই ইউরোপ আমেরিকাতে পাঠাতে চান তারা।


রাষ্ট্রধর্ম এবং ৯০ ভাগ সংখ্যাগুরুর এক ধরনের প্রভাবের উত্তাপ, সমাজের সর্বস্তরেই টের পাওয়া যায়। এর আসলে কোনো উত্তরই আমার কাছে ছিল না আমি ভাবছি নজরুল বেঁচে থাকলে আসলে কি ঘটত , লালন বেঁচে থাকলে কী ঘটত, বাউল করিম বেঁচে থাকল কি ঘটত!


নজরুল লিখেছেন–


বল বীর–


বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’


চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’


ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া


খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,


উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর!


এই আরশ ছেদিয়া উঠার অপরাধে কি ঘটত, কি ঘটত আবার এই কবিতার শেষ অংশে যখন লিখলেন–


আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,


আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী


বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!


আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!


আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!


এই সময়ে তিনি কি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন আঁকার সাহস দেখাতে পারতেন? মনে মনে সাধক উকিল মুন্সির গানের সুর আওড়ালাম, 'আমি ভাবছিলাম কি এই রঙে দিন যাবে রে সুজন ও নাইয়া, পাড় করো দুঃখিনী রাঁধারে'।


লেখক: সম্পাদক ব্রিকলেন, যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকণ্ঠ


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com