কোটা আন্দোলন
কাঙ্ক্ষিত অধিকার পেয়েও ছাত্রদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ১৯:৩৩
কাঙ্ক্ষিত অধিকার পেয়েও ছাত্রদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে
শফিক সেলিম
প্রিন্ট অ-অ+

যে কোন দেশের তরুণ ছাত্ররাই সে দেশের প্রাণ। আজকে যারা ছাত্র তারা আগামী দিনে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিবেন। দেশ কেমন হবে বা দেশের নাগরিকদের মধ্যে কোন ধরনের প্রবণতা প্রকাশ পাবে, তার জন্য তরুণদের বেড়ে ওঠার পদ্ধতিগত অনুশীলন জরুরি। সুতরাং তরুণ ছাত্রসমাজ কোন ধরনের সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে বড় হচ্ছে- সেটা খুবই গুরত্বপূর্ণ।


আমাদের সময়ের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ছাত্র আন্দোলন শেষ হলো। এ আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। শাসকদল আওয়ামী লীগ বলছে- তরুণ ছাত্রদের সাথে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কোন সম্পর্ক নাই। আমরাও সে কথা বিশ্বাস করতে চাই। তারপরও এই আন্দোলনের কি ধরনের মেরিট ছিল সে দিকে একটু নজর দিতে চাই।


আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড (যে সব পদ ইতোপূর্বে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি বলে পরিচিত ছিল)-এ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন।


নির্বাহী বিভাগের পরিপত্রে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানগণ সংক্ষুব্ধ হয়ে উক্ত পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে অহিদুল ইসলামসহ সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পরিপত্র বাতিল করে রায় দেন ও কোটা পুর্নবহাল করেন।


এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হন সাধারণ ছাত্ররা এবং ৬ জুলাই তারা আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। হাইকোর্টের রায়ের স্থিতাবস্থা চেয়ে ৯ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেন, কারণ কোটা নিয়ে একটা যৌক্তিক সমাধানে সরকার যেতে চান। রাষ্ট্রের যে কোন বিভাগের প্রতি যে কোন নাগরিক সংক্ষুব্ধ হতে পারেন- তার জন্য যথাযথ পথও খোলা রয়েছে। বিচার বিভাগের কোন রায়ের প্রতি কোন নাগরিক সংক্ষুব্ধ হলে কোথায় যাবেন? নিশ্চয়ই বিচার বিভাগের আপিল বিভাগে। ১০ জুলাই সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। আমরা ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় দেখেছি সরকার তড়িঘড়ি করে নির্বাহী আদেশে কোটা বাতিল ঘোষণা করেন।


সরকার বারবার কোটার বিরুদ্ধে খড়্‌গহস্ত হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ কোটা সংস্কারকারীদের পক্ষে। ২০১৮ সালে ছাত্ররা কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু সরকার নারী কোটসহ সব ধরনের কোটা বাতিল করে দিলেন। আবার ২০২৪ সালে ৫ জুন কোটা পুনর্বহালে বিচার বিভাগের রায়ের পরে ৯ জুলাই সরকার আপিল করেন।


আজ থেকে দশ বছর আগে থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের সন্তানসহ সচেতন মহল ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করছেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন চাকরিতেই কাঙ্ক্ষিত কোটা পূরণ করতে পারেনি। যেখানে প্রার্থী নাই, সেখানে কোটা রাখা কার স্বার্থে? ২০১৮ সালে সরকার কোটা সংস্কার না করে বাতিল করে দিলেন। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ২১ জুলাই আপিল বিভাগ রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে আপিল বিভাগের রায় হুবহু বাস্তবায়ন করলেন নির্বাহী বিভাগ! এবার আসি রায়ে কি বলা হলো- শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এখানে শহিদ মানে ১৯৭১ সালে যিনি শহিদ হয়েছেন তার সন্তান। আমার প্রশ্ন তারা কীভাবে চাকরিপ্রার্থী হন। ওই সন্তানের বয়স যদি খুব কম হয় তবু ৫২ বছর হবে।


বীরাঙ্গনাদের বেলায়ও প্রায় একই। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের বিষয়েও একই- কোনোভাবে ৫% মুক্তিযোদ্ধা কোটা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাহলে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটা ১% করে নারী কোটা দেয়া যেতে পারত। কেন তাহলে সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন না? কারণ সরকার কোনোভাবেই বিচার বিভাগের বাইরে গিয়ে কিছু করতে চায়নি। নির্বাহী বিভাগ সব সময় সাধারণ ছাত্রদের সাথেই ছিল।


এত কিছুর পরে সাধারণ ছাত্ররা আদালতে না গিয়ে নির্বাহী বিভাগকে অস্বীকার করে কেন রাস্তায় নামলেন? কেন তারা রাস্তায় নেমে সহিংস হয়ে উঠলেন? সরকারের পক্ষে থেকে বারবার বলা হয়েছে কোটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে। এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়েছিলেন- ২০% কোটা আর ৮০% মেধায় নির্ধারণ করার জন্য আপিল বিভাগকে অনুরোধ করা হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- বিচার বিভাগের কোন কার্যক্রমে নির্বাহী বিভাগ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগের নীতি কী হবে সেটা বিচার বিভাগ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। তবে নির্বাহী বিভাগের কোনো কাজ বা আচরণে কোনো নাগরিক সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতি ন্যায় বিচারের রায় প্রদান করতে পারেন।


আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের জনগণ এবং সরকার জনতুষ্টিবাদী। বেশিরভাগ জনগণ যা বলে সেটাকেই তিনি বা তারা সঠিক মনে করে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে- যদি সেটা ভুল বা ধংসাত্মাকও হয়, তবু তারা পিছ পা হন না।


একটা সভ্য স্বাধীন দেশে বিচার বিভাগের রায়কে আদালতে মীমাংসা না করে কেন রাস্তায় নিয়ে আসবে? কেন তারা আপিল বিভাগে যাবে না? আসলে আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। আমরা সকলেরই আইন অমান্য করাকে বীরত্বপূর্ণ কাজ মনে করি। আমাদের ছাত্রদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে বলে বিশ্বাস করি।


এ আন্দোলনে কোথায় কে বা কারা হত্যা বা খুন হয়েছে সেটা নির্ণয় করা আমার অভিপ্রায় না। আমি শুধু বলতে চেয়েছি- আদালতের বিষয় রাস্তায় নিয়ে আসা শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। সুতরাং আন্দোলনে ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত অধিকার রক্ষিত হলেও আখেরে তাদের নৈতিক পরাজয় ঘটে যায়।


(লেখক: শিক্ষক, কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান)


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com