একুশের বইমেলা, আমাদের প্রাপ্তি কি?
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৫
একুশের বইমেলা, আমাদের প্রাপ্তি কি?
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

চলছে ভাষার মাস, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। পাঞ্জাবি-পায়জামা আর বাসন্তী শাড়িতে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের মাসব্যাপী বইমেলা। লেখক-প্রকাশক সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এই বইমেলার। কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার মানে বাংলাদেশের মানুষ বই পড়েন। নাকি শুধুই বাসার বুকশেলফের শোভাবর্ধনের জন্য বই কেনেন? এবং বই ব্যবসায়ী যারা , তারা সারা বছরের আয় ঘরে তোলেন এক মেলার বাণিজ্য থেকে। এই কোটি টাকার বইমেলায় আদৌ লাভ কি হচ্ছে? শুধুই কি বাণিজ্য? এই প্রশ্নটা বারবার মনে আসছে, বইমেলা কি বাংলা একাডেমি শুধুই বাণিজ্যিক কারণে করে থাকেন?


মোশতাক-তিশা দম্পতি এক অসম প্রেমের আখ্যান। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে যা দেশে-বিদেশে প্রচার পেয়েছে। সেই প্রচারের আলো তাদেরকে রীতিমতো সেলিব্রিটিতে পরিণত করেছে। প্রচারের আলো একবার কেউ পেয়ে গেলে সে আরো প্রচারলোভী হয়ে যায়। অতীতে হিরো আলম কিংবা রাজনীতিতে নূরকে আমরা দেখেছি, যোগ্যতার চেয়ে বেশী প্রচার এদের রাতারাতি তারকা বানিয়ে দিয়েছিল, ঠিক রাতারাতি আবার তাদের হারিয়ে যেতে হয়েছে।


মোশতাক-তিশার মতো হাজার হাজার ঘটনা ঘটে সারাদেশে, সারা পৃথিবীতে। বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিবাহ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হয়নি। মোশতাক-তিশা প্রাপ্তবয়স্ক অসম প্রেম। তাদের সেই অধিকার আছে, প্রেম করার, বিয়ে করার। কিন্ত তাদের নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করার দায় আছে আমাদের ভাইরাল মিডিয়াগুলোর। কিন্ত তার চেয়েও ভয়ংকর হয়েছে বইমেলার আগত দর্শনার্থীরা যেরকম বিশ্রীভাবে তাদের মেলা থেকে বের করে দিয়েছে, তাতে করে মানুষের মূল্যবোধের প্রশ্নটা থেকে যায়।


নাট্যব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশীদ যখন 'রুচির দুর্ভিক্ষ' বলে মন্তব্য করেছিলেন তখন আমরা মানবতার পতাকা তলে দলে দলে এসে সেই বক্তব্যের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মামুনুর রশীদের মানবাধিকার লংঘন করতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। সেই রুচির দুর্ভিক্ষ কিন্ত প্রমাণ হয়েছে । আমার মনে হয়েছে গণমাধ্যমকে থেকে আগে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে হবে। মূলত সৃষ্টিশীল মানুষের অভাবে সহজভাবে শেয়ার লাইক আর ভিউ বাণিজ্যের কারণে গণমাধ্যম তাদের স্বকীয়তা ধরে না রেখে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। আমরা সাধারণ দর্শক পাঠকদের মাঝে প্রতিদিন সেই একই ইস্যু নানাভাবে নানা পদে রান্না করে পরিবেশন করা হয়।


দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে, একুশের বই মেলায় আগত একদল কিশোর কিশোরী বা তরুণদের সাংবাদমাধ্যমকর্মী বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন এবং তারা অনায়াসে ভুলভাল উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। কী ভয়ংকর অবস্থা!


এদেরকে যদি প্রশ্ন করতেন শাহরুখ খানের পাঠান বা জওয়ান সিনেমা কিংবা হালের অ্যানিমেল ছবি পৃথিবীর কোন দেশে কত ব্যবসা করেছে, সিনেমার পরিচালক কে? কিংবা মালায়ালাম, তেলুগে কিংবা কন্নর সিনেমার নায়ক-নায়িকা নিয়ে দিন তারিখসহ কবে কোথায় কখন কোন সিনেমা কত ব্যবসা করেছে, কোন নায়ক-নায়িকার প্রেমের খবর কী সব ওরা গড়গড় করে বলে দিতে পারত বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ওদের মুখস্ত ইউরোপ আমেরিকার সকার আর ফুটবল ক্লাবগুলোর কোন ক্লাবের ম্যানেজারের বেতন কত? কোন খেলোয়াড়ের প্রেমিকা কী করে সব ওদের মুখস্ত, মুখস্ত পৃথিবীর কোন কোম্পানি কোন ব্রান্ডের কাপড় বানায়। স্মার্ট, ডিজিটাল প্রজন্মের নামে আমরা কি তৈরী করছি? শিকড়হীন একটা প্রজন্ম! যাদের নিজের ইতিহাস ,ত্যাগ, সংগ্রাম ,অর্জন সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। ওরা শুধু দেশ ছেড়ে পালাতে চায় ইউরোপ ,আমেরিকা ,কানাডায়। সেখানে ও যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে। যাদের বড় একট অংশই না ইংরেজি ভাষা ভাল করে জানে, না যে বিষয়ে সে পড়াশোনা করেছে সেই বিষয়ে সে কোন জ্ঞান রাখে। ব্রিটেনে এইবার বেশ কিছু তথাকথিত স্মার্ট তরুণের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। যারা কাজের সন্ধানে যোগাযোগ করেছেন, কিন্ত কর্মক্ষেত্রে এরা সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। ভাষার দক্ষতা বাদ দিলেও এই দেশের গতির সাথেই মানিয়ে নিতে পারছে না তারা। এটা অভিযোগ নয়, মূলত তারা আয়েশি, ডিভাইসনির্ভর একটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।


খেলাধূলা নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই। এরা করবে কী? কেউ অধিক হারে ধর্ম-কর্মে নিবেদিত হচ্ছে আর আড্ডাগুলো চলে গেছে রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতিতে। রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বেড়ায়। কেউ কেউ দেশ-বিদেশে ঘুরতে যায়। ১০০ টাকা, ২০০ টাকা চাঁদা তুলে দল বেঁধে মাইক বাজিয়ে পিকনিকের সংস্কৃতিও নেই। কারণ পরিবারগুলো আর্থিকভাবে সাবলম্বী, এখন খরচ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।


এখন এই দায় কার? এই দায় কি এই তরুণদের? না রাষ্ট্রের? না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার? না পরিবারের? আমাদের যাদের আশির দশকে জন্ম, গ্রামে বা মফস্বলের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছেন, আমার মনে হয় আমরা সবাই কম বেশি সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই গিয়েছি। ১০ টা ট্রান্সলেশন আর মুখস্ত ২০ টা ইংরেজি রচনা ৩০ টা প্যারাগ্রাফ আর টুকটাক গ্রামার-এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের ইংরেজি শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থা ও অনেক বেশি আধুনিক হয়েছে, ডিজিটাল সুবিধায় পুরো পৃথিবীর দুয়ার তাদের সামনে খোলা। সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি ভাষা ইতিহাস সব হাতের মুঠোয়। তারা জ্ঞানে, তথ্যে প্রবাহে, আরও বেশি সমৃদ্ধ হওয়ার কথা।


একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় দিবসসমূহে আমাদের লাল সঙ্গে সবুজ বা সাদাকালো পাঞ্জাবি ছিল না, স্কুল ড্রেস কিংবা আগের দিনের ধোয়া পরিস্কার কাপড় পরিধান করতাম, কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ ছিল সেই সময়। একুশের প্রভাতফেরি , স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসগুলো উৎসবের আমজে উদযাপিত হত। এখনো স্কুল-কলেজে দিবসগুলো পালন করা হয়। তখন স্কুল কলেজে ১৫ আগস্ট , জাতীয় শোক দিবস পালন করা হত না। আলাদাভাবে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পালন করত সেই দিবস।


কিন্ত ধরণ ছিল একই, আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই স্কুলের মাঠে মাইক লাগানো হয়ে যেত, রাতভর সেখানে বেজে চলত দেশের গান, স্বাধীন বাংলা। বেতার কেন্দ্রের গানগুলো। স্কুল কলেজে কোন ধরনের আর্থিক অনুদান পাওয়া যেত কি না আমি ঠিক জানি না। তবে আমরা শিক্ষার্থীরা ৫ টাকা ১০ টাকা চাঁদা দিতাম। কিন্তু দিবসগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন না করলেও বিষয়গুলো আমরা জানতাম। অথচ সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এইসব বিষয়ে অনেক বিকৃত প্রচারণা বা ভিন্ন পাঠ্যক্রম ছিল। তব ও ইতিহাসের সেই শিক্ষা আমরা পেয়েছি এই সব দিনগুলোতে শিক্ষক বা নানা জ্ঞানী গুণীদের আলচনায়।


টিপু সুলতান নামের ঐ ভদ্রলোকের বদৌলতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈনতা উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও তাকে নিয়ে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক নেতিবাচক সমালোচনা হয়েছে, বিশেষ করে, বইমেলায় ঘুরতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি শব্দের বানান এবং বাংলা অর্থ জিজ্ঞাসা করে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের বিব্রত এবং হেয় করছেন বলে অনেকে মত দেন।


ঠিক ততটাই আমাদের গণমাধ্যমগুলোও এই মানুষটিকে সমানভাবে বিব্রত করেছেন। উনি যা করেছেন, নিজেও বলেছেন তিনি মূলত কুইজ করতেন, যে উত্তর দিতে পারত তাকে একটি বই তিনি উপহার দিতেন। ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে সেই সেই কুইজে অংশ নিত। এমন তো না যে তিনি কাউকে আটকে জোর করে বাধ্য করেছেন।


কিন্তু একজন সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করেন তখন কিন্ত বাধ্য করেন উত্তর দিতে। শিরস্ত্রাণ বাংলা শব্দটি আমরা কয়জন জানি? ইংরেজিটা কিন্ত সবাই জানে। টিপু সুলতানকে যেভাবে হেয় করে মেলা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, মোশতাক-তিশাকে বের করে দেয়ার চাইতে কোন অংশে কম নয়।


আমরা প্রতিবাদমুখর হচ্ছি ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের, আমরা প্রতিবাদমুখর হচ্ছি টাঙাইল শাড়ির জিআই অধিকার নিয়ে। কিন্তু যা করার তা করছি না। নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে কোনো ধারণা দিচ্ছি না। টাঙাইল শাড়ি যে আমাদের ঐতিহ্যের অংশ সেই তথ্যটুকুই তো আমাদের এই প্রজন্ম জানে না। এখন ভারত যখন তার উৎস মালিকানা দাবি করেছে তখন আমাদের অনেকেই নড়েচড়ে বসেছেন। যে দেশের আগামীর নেতৃত্ব তার নিজের উৎস জানে না, সেই দেশে ঐতিহ্য কীভাবে নিরাপদে থাকবে। ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্র বিজয় সম্ভব হয়েছে, শাড়ির উৎস অধিকার নিশ্চিত করা সেখানে কিছুই নয়।


বাংলা একাডেমির বইমেলা শুধু বাণিজ্য আর উৎসবের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে তথ্যবহুল করুন। নতুন প্রজন্মকে সাদাকালো পাঞ্জাবির ভেতর থেকে টেনে বের করুন। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, শেকড়ের সাথে একাত্ম না করে, শুধুমাত্র স্মার্টফোন দিয়ে আগামীর স্মার্ট প্রজন্ম গড়ে তোলা যাবে না।


লেখক : জুয়েল রাজ, সাংবাদিক কলামিস্ট


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com