
আমরা মেয়েরা যারা কর্মজীবী তারা এই শব্দ দুটোর সাথে খুব ভালো ভাবে পরিচিত। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার জন্য বেশ শক্তিশালী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। প্রাইমারি লেভেলে যেন বাচ্চারা স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে ।এছাড়া মেয়েদের উপবৃত্তিসহ ফি মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফলে গত ৩০ বছর যাবৎ এ দেশে নারী শিক্ষার বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার হার অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে যা রীতিমতো আকর্ষণীয়।
নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে নারীরা বিভিন্ন কর্মমুখী কাজে এগিয়ে আসছেন। যার ফলে তারা উদ্যোক্তা হচ্ছেন, অনলাইন বিজনেস এর সাথে জড়িত হচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের ক্রাফ্টিং, ছোট ছোট ব্যবসা করতে পারছেন। যেগুলো দেশের গড় জিডিপির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখন। এসব কাজ নারীরা গৃহকর্মের সাথে সাথে বাসায় থেকেও করতে পারছেন। পেশার ধরন বদলাচ্ছে। যা অত্যন্ত পজিটিভ বিষয়।
এই ধরনের অগ্রগতি ছাড়াও আজ থেকে বেশ কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নারী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কাল হতে এখন পর্যন্ত ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে চলেছে। এ উন্নয়ন এসেছে বিভিন্ন ভাবে।এরকম একটি দেশে নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় বিশেষ করে কর্মমুখী কাজে অংশগ্রহণে একটি বিষয় বিশেষ বাধা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়।
সেটা হলো একজন নারী যখন সম্পূর্ণ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কর্মে প্রবেশ করেন তখন তার ব্যক্তিগত জীবনে সংসার নামক শব্দটি বাদ পড়ে না। সংসারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাকে কর্ম ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হয়। এটা তার জন্য আরো নাজুক হয়ে যায় যখন সে সন্তানের মা হয়। সন্তানকে বাসায় রেখে তাকে মোটামুটি ভোর থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করতে হয়। আমার মনে হয় যে কোনো উচ্চশিক্ষিত নারী একদম ছোটবেলা থেকে যে দৃঢ় মনোবল ও সক্ষমতা নিয়ে বড় হন, এই পরিশ্রম তারা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সফলও হন। শুধু তখনই অসহায় হয়ে যান যখন তারা তাদের অসহায় ছোট্ট শিশুকে বাসায় অনিরাপদ হাতে ফেলে রেখে যান। শুরু হয় তখন শ্বশুরবাড়ি বা নিজের বাড়ির আত্মীয় স্বজন বা মা শাশুড়ি ধরনের মুরুব্বিদের সহযোগিতা কামনা করা।
প্রত্যেকের জীবনে স্বাধীনতা আছে, সংসার আছে। অনেকেই এক্ষেত্রে সহযোগিতার হাতটা নিষ্ঠুরতার সাথে গুটিয়ে নেন। আবার অনেকে ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেননা ।
তার নিজের সংসার, নিজের জগৎ, নিজের স্বাধীনতা বর্জন করে মেয়ে বা ছেলের বউয়ের পাশে সাপোর্ট হয়ে দাঁড়াতে। ফলে কোনো সদ্য মা হওয়া ওই নারী আরো অসহায় হয়ে পড়েন। তাকে পরামর্শ দেয়া হয় তার কর্ম ছাড়তে। এটা কি সম্ভব! একজন মানুষ তার ২৫/২৬ বছরের কঠোর পরিশ্রম কিভাবে মুছে ফেলতে পারেন, ভুলে যেতে পারেন নিজেকে?
কারণ ওই কর্ম তার ছোট্টবেলা থেকে ওই পর্যন্ত পরিশ্রমের চেষ্টার যুদ্ধের একটা সফল সৃষ্টি। ঐ সফল পরিণতি ছেড়ে দেয়া মানে নিজের জগত ছাড়া বা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা । যেটা সম্ভব নয় । আবার সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর নিরাপদ থাকা, তার স্বাভাবিক শারীরিক মানসিক বৃদ্ধি সঠিক থাকাটাও জরুরি। একজন কর্মজীবি মা হিসেবে দীর্ঘদিনের হয়রানি ভোগ করে আমার এটা মনে হয়েছে যে একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী মা নিজের খুবই কষ্টে অর্জিত সক্ষমতা অনেকটাই সঠিক উপায়ে ব্যবহার করতে পারেন না শুধু এই কারণে যে তিনি যখন মা হন তখন তার পাশে সঠিক কেউ সমর্থন হয়ে দাঁড়ায় না।
যেটাকে আমরা সাপোর্ট সিস্টেম বলি।সঠিক উপায়ের একটি সাপোর্ট সিস্টেম বা স্বাভাবিক সমর্থন পেলে একজন মা তার পূর্বে অর্জিত এই সক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
ওই সময়টা যদি একটা বারের জন্য তিনি কাউকে পাশে পান তাহলে তিনি তার সক্ষমতাটাকে আরও সফলভাবে চরম শিখরে তুলে নিতে পারেন। এটা হয় না দেখে তাকে থাকতে হয় মানসিক যন্ত্রণায় ।সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হয় এই নিয়ে যে তার সন্তানেরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে বা সঠিক খাবার পাচ্ছে না বা তার মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। সাথে থাকে কর্ম পরিবেশের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে তিনি অসফল হয়ে যান কিনা সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা।
একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট পরিমাণ সক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সেটা নারী-পুরুষ , শিশু, বৃদ্ধ যেই হোক না কেন। অথচ একজন কর্মজীবী মাকে বাধ্য হয়ে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হয়। এতকিছুর পরও পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে তার কোনো মানসিক তৃপ্তির জায়গাটা কাজ করে না।এই সমস্যার ১০০ ভাগ সমাধান না থাকলেও সমাধান সম্ভব। সেটা সম্ভব শুধু শিশু সন্তানের লালন-পালনের ওই সময়টুকু যদি এক বা একাধিক ব্যক্তি স্বাভাবিক, শক্তভাবে তার পাশে দাঁড়ায়। তাহলে তিনি এই চরম বিপর্যয় সময়টুকু পার করে আসতে পারেন। সেটা যে কেউ হতে পারেন। আত্মীয় বা স্বজন হতে পারেন।
তবে সবচেয়ে ভালো হয় পেশাগতভাবে লালন পালনের এই বিষয়টি গড়ে তুলতে পারলে। যখন একজন উচ্চশিক্ষিত নারী একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আয় করেন তখন তিনি উন্নত ডে কেয়ার সেন্টার বা ভালো করে ট্রেনিং প্রাপ্ত হেল্পিং হ্যান্ড পেলে সহজেই বর্তে যাবেন। কাজকর্মে অভিজ্ঞ হবেন ও বাচ্চা নিরাপদ থাকবে, যদি এমন ধরনের ব্যক্তির সার্ভিস চালু হয় তাহলে আর্থিক সামর্থ্য এর মধ্যে অনেকেই তা গ্রহণ করবেন। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রধান।
সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আত্মীয়-স্বজনের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করা আর প্রতিদিনের রুটিন টেনশন এর মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি নেয়া সম্ভব।
তাই সাপোর্ট সিস্টেম বা উপযুক্ত হেল্পিং হ্যান্ড অনেক আগে থেকেই সময়ের দাবি।
আমার মনে হয় যে কোনো সেক্টর থেকে এটা শুরু হতে পারে। এনজিও বা যেকোনো উদ্যোক্তা এগিয়ে আসতে পারেন।
উপযুক্ত পরিচয় ভেরিফাই করে স্থানীয় থানার সহযোগিতার মাধ্যমে এ ধরনের সার্ভিস চালু করা যায়। প্রত্যেক জেলা শহরে প্রথমে শুরু করা যায়।
সাপোর্ট সিস্টেম উন্নত হলে আমার মনে হয় যে, হাজারো ভুক্তভোগী নারী তাদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় শুধু হয়রানি, ভোগান্তি এবং টেনশনের মাধ্যমে নিজের সফল সক্ষমতাকে অসফল অবস্থায় কাটিয়ে দিতে বাধ্য হবেন না।
আপন আত্মীয় স্বজনদের সাথে স্বাভাবিক সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। সন্তান লালন পালন ও কর্মক্ষেত্রে সকল স্থানে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে তিনি বাঁচতে পারবেন। সাথে সাথে একজন স্বামী বা পিতাও স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারবেন ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা বহু পূর্ব থেকেই ডেভেলপ করেছে। যার ফলে কর্মজীবী নারীগণ অনেক স্বস্তিতে, শান্তির সাথে তাদের কর্মক্ষেত্রে আরও সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন।
আমি বলব আমাদের দেশে শিক্ষা ও কর্ম ক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়া যে হারে হয়েছে তার সামান্য হলেও এই সাপোর্ট সিস্টেম বা ডে-কেয়ার সেন্টার বা অভিজ্ঞ কর্মী দ্বারা সন্তান লালন পালনের জন্য সহযোগিতা, কোনো কিছুই উন্নত হয়নি। যা সময়ের দাবি। এখন আর না হলেই নয়।
অনেক নারী আছেন যারা সামাজিক, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। অথচ তাদের এসব সামান্য কাজ করার সামর্থ্য আছে। অনেকেই সম্মানের সাথে কর্মের মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। শুধু একটু সুযোগের অভাব। ডে কেয়ার বা চাইল্ড কেয়ার সিস্টেম ডেভেলপ করার মাধ্যমে সেসব নারীদের একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে দেয়ার সুযোগের সাথে সাথে কর্মজীবী নারীর সন্তানের স্বাভাবিক লালন পালনের একটি ভালো কম্বিনেশন হতে পারে এ দেশে।
যার ফলে অনেক অর্থের অপচয় রোধ হবে। অনেক পারিবারিক অশান্তি দূর হওয়াসহ অনেক সমস্যার সহজ স্বাভাবিক সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব।
উন্নত দেশ বিশেষ করে কানাডা, আমেরিকা, সাউথ আফ্রিকা, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড বা ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশের সাপোর্ট সিস্টেম অর্থাৎ ডে কেয়ার বা চাইল্ড কেয়ার সিস্টেম রীতিমতো প্রশংসনীয় ও অনুসরণীয়।
কানাডায় বিশেষ করে কিউবেক প্রদেশে low fee universal system আছে। যেখানে কম আয়ের মায়েরাও এই ডে কেয়ার সুবিধা তাদের সামর্থ্যের মধ্যে পেতে পারেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই না। আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ নারীর স্বাভাবিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সম্পূর্ণ বিরোধী। কর্মজীবী নারী মা হলেই তারা ইস্যু পেয়ে যান।
অথচ একজন নারী যখন একাধিক শিশুসন্তানসহ বিধবা হন বা তার কোনো ভরসা করার জায়গা থাকে না বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হন বা তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামী অসুস্থ থাকে বা অন্য যে কোনো কারণ হোক না কেন তিনি পরিবারসহ অসচ্ছল থাকেন তখন এসব নারী উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারী ধার্মিক জ্ঞানীরা উধাও হয়ে যান। অথচ ধর্মীয় দোহাই দিয়ে তারা সবসময়ই একটি সক্ষম জাতিকে তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি ও সক্ষমতার বিকাশকে প্রতিরোধ করার অন্যায় চেষ্টা করেন।
শুধু সেই ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে বা নিজের উপর ঘটা নির্যাতন প্রতিরোধ করার জন্য হলেও স্বাবলম্বী হওয়া দরকার একজন নারীর।
এটা সেসব ব্যক্তিগণ বুঝতে চান না। আশা করা যায় তারা বুঝবেনও না। এই বিষয়ে আর বলতেও চাই না।
পরিশেষে বলবো সাপোর্ট সিস্টেম বা সুপরিকল্পিত সহযোগিতা পদ্ধতি শুরু হওয়া এখন অন্যতম দরকারি একটি সেবা। যেটার অন্যথা হওয়ার কারণে দেশের সার্বিক অগ্রগতি পরোক্ষভাবে হলেও পিছাচ্ছে। যা আদৌও কাম্য নয়। শুরু হোক এই অগ্রযাত্রা। এগিয়ে যাক বৃহত্তর পরিসরে নারী ও শিশুসহ পরিবার ,সমাজ ও রাষ্ট্র।।
লেখক: যুগ্ম জেলা জজ, মাগুরা
বিবার্তা/জাই
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]