শিরোনাম
বইয়ের মতো এমন বন্ধু আর কে আছে!
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৭:০২
বইয়ের মতো এমন বন্ধু আর কে আছে!
অনামিকা রায়
প্রিন্ট অ-অ+

পাতার পর পাতা উল্টে হরফের উপরে চোখ, চলতে থাকে নতুন জগতের খোঁজ। মনখারাপের কুয়াশা কী ভাবে কাটাতে পারে বিবলিয়োথেরাপি?


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে প্রিয়জনের কাছে ফিরে এসেছেন সৈনিকরা। শরীরের ক্ষত তত দিনে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে মনে। শরীরের ক্ষতে ওষুধ পড়ছে। কিন্তু মনের ক্ষত? তা সারবে কীসে? বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে অনেকেই আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। এমন সময়ে কিছু চিকিৎসক এগিয়ে এলেন বই হাতে। যুদ্ধ ফেরত সেনাদের হাতে তুলে দিলেন নানা বই। ধীরে ধীরে মনের ক্ষতে প্রলেপ পড়ল। অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের যুদ্ধ অভিজ্ঞতাও লিখতে শুরু করলেন। মিলিটারি হাসপাতালেও তৈরি করা হল লাইব্রেরি ও নিয়োগ করা হলো লাইব্রেরিয়ান। দেখা গেল, বই পড়ার মাধ্যমে চিকিৎসায় সাড়া মিলছে দ্রুত। এ সবই সম্ভব হয়েছিল বিবলিয়োথেরাপির জন্য। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি অবস্থায় হতাশা কাটাতে কাছে টেনে নিতে পারেন বই। শুরু করতে পারেন লেখালিখি। অতিমারি বিধ্বস্ত সময়ে আমাদের ‘যুদ্ধ’ কিন্তু নথি হয়ে থেকে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।


বিবলিয়োথেরাপি কী?


বইয়ের মাধ্যমের মনের হতাশা কাটানোর এই চিকিৎসাই পরিচিত বিবলিয়োথেরাপি নামে। গ্রিক শব্দ ‘বিবলিয়ো’ মানে বই আর ‘থেরাপিয়া’মানে চিকিৎসা। সহজ করে বললে বুক থেরাপি। তবে তা নতুন নয়, বরং ওল্ড স্কুল মেথড বলা যায়। বহু যুগ ধরে এই বুক থেরাপি চলে আসছে। মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস একটি চেম্বার তৈরি করে তার মধ্যে মজুত রাখতেন বই। সে কালে তা প্রচলিত ছিল ‘দ্য হাউস অব হিলিং ফর দ্য সোল’ নামে। তখনও বই-ই আলো দিত মনের অন্ধকার গলিতে।


মন ভাল রাখতে বই পড়ুন


মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন বুক থেরাপির মতো না হলেও বই প্রেসক্রাইব করা হয়। রোগীর আগ্রহ অনুযায়ী বই পড়তে বলা হয়। মন খারাপ হলে যে হাসির বই পড়তে হবে, এমনটা নয়। রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি বা কবিতার বই ভাল লাগলে সে ধরনের বইও পড়তে পারেন। উদ্দেশ্য হল মনের বিকেন্দ্রীকরণ। বই মনকে সেই পথ দেখায়। মনখারাপের দিনে একটা ভাল বই পড়তে শুরু করলে সেই বইয়ের চরিত্র অনেকটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে মনকে। তখন সেই উপন্যাসের গতিই কিন্তু পড়ুয়ার মনের গতি পরিচালনা করে। তাই ইতিবাচক বই পড়লে তার সুফল মিলবেই।


তৈরি হোক পড়ার অভ্যেস


• পড়তে হবে বলে একসঙ্গে পাঁচটা বই নিয়ে বসে পড়বেন না। পাঁচটা বই নাড়াচাড়া করে একটি বই বেছে নিন


• কোনো বই শুরু করছেন মানে জোর করে শেষ করতে হবে, তা নয়। পছন্দ না হলে সেটা ছেড়ে অন্য বই ধরুন। এমনও হতে পারে, যে বইটা আজ ভাল লাগছে না, দু’দিন পরে ভাল লাগল


• বই পড়ে তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। ভার্চুয়াল বুকক্লাবে যোগদান করতে পারেন


• বাড়ির বয়স্করা অনেক সময়ে চোখের সমস্যায় বই পড়তে পারেন না। তাঁদের বই পড়ে শোনান। বয়সজনিত কারণেও মানুষকে অবসাদ গ্রাস করে। এতে তাঁদের হতাশা কাটবে


কী ভাবে হয় বুক থেরাপি?


কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপি ও ভিসুয়াল বেসড মেটিরিয়াল... এই দুই পদ্ধতিতেই মূলত করা হয়।


কগনিটিভ:


এ ক্ষেত্রে কোনো মানুষের কষ্ট, হতাশা কাটাতে এমন বই পড়ার পরামর্শ দেয়া হয়, যা তাকে উত্তরণের পথ দেখাবে। হয়তো একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে তার মাকে হারিয়েছে। কিছুতেই সেই কষ্ট সে ভুলতে পারছে না। তখন তার হাতে যদি এমন একটা বই তুলে দেওয়া যায়, যার চরিত্রও একই ঘটনার সম্মুখীন, তখন সেই চরিত্রের সঙ্গে সে নিজেকে মেলাতে পারবে। মনে হবে না যে, সে একা এই কষ্টের ভাগীদার। গল্পে চরিত্রের উত্তরণ থাকতে হবে। তবে সেই বাচ্চাটিও তার কষ্ট কাটিয়ে উঠবে। অনেক সময়ে সেল্ফ-হেল্প বইয়ের সাহায্যও নেওয়া হয়ে থাকে।


ভিসুয়াল:


উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকায় জনস্বার্থে প্রচার করার উদ্দেশে পাবলিক হেল্থ বিষয়ক কমিক বই (কম পাতার) ছাপা শুরু হয়। প্রথমে তা বারো পাতার ছিল ও শিশুদের স্বাস্থ্য বিষয়ে নিয়মানুবর্তিতা শেখানোর জন্য বার করা হত। পরে প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও তা ছাপা শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও ছবি দেখে তা সকলে বুঝতে পারবেন। উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়। ছবি থাকায় তা মানুষের মনে গেঁথে যায়। ফলে নেশা ছাড়াতে বা শিশুদের মধ্যে সুঅভ্যেস গড়ে তুলতে এমন কমিক বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ক্রমশ গ্রাফিক নভেলও জায়গা করে নিল পড়ার বইয়ের তাকে। পড়ার ফাঁকে এই কমিক বুক মস্তিষ্ককে বিরাম দেয়। আবার ‘অনিচ্ছুক পাঠক’কেও কাছে টেনে নেয়।


ইম্যাজিনারি:


এই পদ্ধতিও খুব সহায়ক। ধরুন, আপনি বহু দিন কোথাও ঘুরতে যেতে পারছেন না। বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা আছে, এমন বই পড়ুন। দেখবেন কিছুটা হলেও অবসাদ কাটছে। পুরনো দিনের উপন্যাসে ভৌগোলিক বিবরণও থাকত, যা পাঠককে আকর্ষণ করত। কবিতার বইও ম্যাজিকের মতো কাজ করে।


তবে শুধু বই পড়েই হতাশা কেটে যাবে এমন কিন্তু নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বই প্রেসক্রাইব করার আগে রোগীকে স্টাডি করে। তাঁকে যে বইটি পড়তে বলেন তা আদৌ তিনি উপভোগ করবেন কি না, সেটাও দেখে নেন। বই পড়াটা যদি টাস্ক হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে নির্যাসটা তাঁর কাছে পৌঁছবে না। যাঁরা বই পড়তে ভালবাসেন, কিন্তু অনেক দিন তা থেকে দূরে, তাঁদের বই পড়ার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। তখন চিকিৎসা শুরু করা সহজ হয়। বুক থেরাপি মনের চিকিৎসা শুরু করার ভিত তৈরি করে দেয়।


সৃজনশীলতা বাড়ে


বিষয়বস্তু দেখে বই বাছতে হবে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মন ভাল রাখার বিষয় আছে, এমন বই বাছতে হবে। বই যিনি লিখছেন তিনিও যেমন সৃষ্টি করছেন, যিনি পড়ছেন তিনিও ক্রিয়েট করছেন। কোনও বই পড়ার সময়ে আমরা ভাবি। চরিত্রের বর্ণনা অনুযায়ী নিজের মতো করে ভিসুয়ালাইজ় করি। পড়ার সময়েও আমরা ক্রিয়েট করতে থাকি সেই গল্প।” এখানেই মন ভাল করার রসদ মজুত। যে কোনও ক্রিয়েটিভ কাজ মস্তিষ্ক ও মনকে সচল রাখে। তাকে ঝিমিয়ে পড়তে দেয় না। তাই হতাশা গ্রাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে।


ছেলেবেলার স্মৃতি


ছোটবেলা বেশির ভাগের কাছেই ভারী মিষ্টি। যার পরতে আছে মন ভাল করার রসদ। কখনও তা প্রিয়জনদের গায়ের গন্ধ নিয়ে আসে, কখনও পুরনো বইয়ের। নতুন বই পড়ার এক আনন্দ। আর ছোটবেলায় পড়া বই আবার পড়তে বসার আনন্দ অন্য। ছেলেবেলার প্রতি সকলের টান থাকে। পুরনো বইয়ের পাতায় পুরনো দিনগুলো বাঁচিয়ে তুললে মনে আনন্দ আসবে বইকি! নিজের ছোটবেলার বই সন্তানকে পড়ে শোনানোর আনন্দও কিছু কম নয়।


শিশুদেরও বই পড়া জরুরি


মোবাইল, ল্যাপটপের যে রেডিয়েশন হয়, সে দিক থেকেও বই নিরাপদ। বিশেষত শিশুদের হাতে মোবাইলে কার্টুনের পরিবর্তে অনায়াসেই তুলে দেওয়া যায় দুটো বই। খুব ছোট হলে সে বই পড়তে পারে না। কিন্তু তার আগ্রহ থাকে গল্পের প্রতি। তখন মা-বাবা বা বাড়ির অন্য সদস্যরা যদি বই পড়ে গল্প শোনান, সেই বইটির সঙ্গে যেমন তার সখ্য গড়ে উঠবে, সেই গল্প-বলা মানুষটাও কাছের হয়ে উঠবে। সে বড় হলে নিজেই বই পড়বে। এতে ধৈর্য ও মনোযোগও বাড়বে। সে চিন্তা করতে শিখবে। জানার আগ্রহ বাড়বে।


বই মানুষকে যত্নশীল করে


ছোটবেলার কোনও জন্মদিনে পাওয়া 'ঠাকুমার ঝুলি', ‘ক্ষীরের পুতুল’বা ‘টুনটুনির বই’অনেকেই সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন। তার পাতা হলুদ হয়ে গেলেও বই অক্ষত রয়েছে। বই আমাদের যত্নশীল হতেও শেখায়।


‘সেন্স অব বিলংগিং’তৈরি করে বই। দশটা বইয়ের পিডিএফ কাছে থাকা আর দুটো বই সংগ্রহে থাকা এক নয়। বইয়ের স্পর্শ, হরফের উপর দিয়ে হাত বোলানো, বইয়ের গন্ধ এ সবই মন ভাল করে। হতাশাও কাটে। অতিমারির রুক্ষ ভূমিতে বই-ই কিন্তু প্রাণের স্পন্দন। সে-ই সাহস জোগায় নতুন স্বপ্ন দেখার।


বিবার্তা/অনামিকা/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com