শিরোনাম
ফেসবুক সমাচারঃ একটি রম্য রচনা (পর্ব-১)
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:২৬
ফেসবুক সমাচারঃ একটি রম্য রচনা  (পর্ব-১)
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

প্রতিদিন প্রায় এক’শ কোটিরও বেশি মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক ব্যবহার করেন। ফেসবুকে চার ক্যাটাগরীর দর্শক থাকে। প্রথম ক্যাটাগরীর দর্শকগণ সবকিছু শুধু ওয়াচ করেন। এদের বলে সাধারণ দর্শক বা সিম্পল ভিউয়ার। এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। এরা কারো পোষ্টে কোনো মন্তব্য, লাইক, শেয়ার কিছু করেন না। শুধু ওয়াচ করেন আর পোষ্টটি মজার হলে মুচকি মুচকি হাসেন।


কখনো কখনো দুঃসংবাদ দেখে মন খারাপের আগেই ড্রপডাউন করে প্রসঙ্গ পাল্টান। কাছের কেউ হলে আবার কান্নাও করেন। দেখুন, সব যে অনুমান নির্ভর বলছি, তা কিন্তু নয়। জীবন থেকে নেয়া। তাছাড়া জানবো কি করে উনাদের প্রতিক্রিয়া? এ ক্যাটাগরীর ফেসবুক ইউজার যারা, তারা তো আপনার পোষ্টের বিপরীতে কোনো চিহ্ন রেখে যাননা। তবে এটুকু জানি, সংখ্যায় এরাই সবচেয়ে বেশী এবং যিনি কোনো কিছু পোষ্ট করেন তখন অধিক সংখ্যক সাধারণ ভিউয়ারের কথা মাথায় রেখেই পোষ্টটি করেন। আমার মতে ফেসবুকে সাধারণ ভিউয়ারের এই আচরণ অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগনের সাথে মিলে যায়। কেন প্রফেসর এর সঙ্গে তুলনা করছি? পরে বলছি। লেগে থাকুন। বুঝতে পারবেন।


দ্বিতীয় ক্যাটাগরির দর্শকগণ শুধু লাইক, লাভ, স্যাড, রাগ ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দুঃখের কাহিনী হলে কান্নার ইমোজি ‘স্যাড’আর সুখের হলে উঁচু দাঁতের হাসির ইমোজি ‘হ্যাপী’মারেন। এটা দিয়ে সম্পর্ক মাপা যায়। তবে খুব একটা তৃপ্তির সম্পর্ক নয়। মিশ্র সম্পর্ক। এদের ওপর আপনি রাগ-ক্ষোভ ঝাড়তে পারবেন না। এদের অবস্থান সাধারণ ভিউয়ার এর পরের ধাপে। আছেন আবার নেই। সম্পর্কটা যেন সুতোয় বাঁধা। সেলিব্রেটি বা ডাকসাইটের কেউ আপনার পোষ্টে লাইক বা রিএ্যাকশন দিলে আপনি গর্বিত হন। এছাড়া বাকিরা আপনার কাছে ঠুনকো। আবার ক্ষেত্র বিশেষে ঠুনকোও নয়। ঠিক আপনিও তাদের কাছে তাই। তবে সম্পর্কটা আঁশে বাঁধানো বুঝা যায়। মন চাইছে না তবুও আপনার সামনে যখন পুশ নোটিশটি এলো, তখন আর কি করার? তাকে একটু-আধটু স্মরণ করবেন, এই-যা। এর বেশি কিছু না। অন্ততঃপক্ষে আপনি জানলেন, সে আপনার সংস্পর্শে আছে। মন্দ নয়। ফেসবুকে তাদের এই আচরণ অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর এর সাথে মিলে যায়। কেন বলছি? দয়া করে উত্তেজিত হবেন না। লেগে থাকুন। আমার সঙ্গেই থাকুন। জানতে পারবেন।


তৃতীয় ক্যাটাগরির দর্শকগণ আপনার আপন মানুষ। আপনার সুখে সুখী, দুখে দুঃখী হন। আপনার পোষ্টে যাই উপস্থাপিত হোক না কেন, ভেবে-চিন্তে সম্পর্কের রশি টেনে ধরতে ছোট-বড় একটা মন্তব্য এরা করবেনই। যদিও এদের সংখ্যাটা খুব বেশি হয় না। ৫ হাজার যদি আপনার ফ্রেন্ড-লিস্ট হয় তাতে একশ এর উপরে কমেন্টস পড়লেই আপনি ধন্য। কমেন্টস কম পড়লে মনটা একটু খারাপ হয়। আপনার স্ট্রেচ হরমোন ‘করটিসল’টা তখন একটু বেড়ে গিয়ে সরাসরি ‘সেলিব্রেল কর্টেক্স’এর সামনের অংশে আঘাত করে যা আপনাকে প্রতি ২০ সেকেন্ড অন্তর-অন্তর মোবাইলে পুশ-নোটিফিকেশন দেখতে বাধ্য করে। ফলে আপনি অন্য বিষয়ে আর মনোনিবেশ করতে পারেন না। সব সময় খানিকটা উত্তেজিত থাকেন। আবার বেশি কমেন্টস পড়লে আপনি তখন খানিকটা উতরে যান। ধরেই নেন উপস্থাপনাটা সঠিক ছিল। তাই এই আদলে আগামীতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন মর্মে মন স্থির করেন।


এই ক্যাটাগরিতে যারাই আছেন সবাইকে আপনার অতি আপনজন মনে হবে। কেউ কেউ বিরাগভাজন মন্তব্য করলেও উত্তরে পাল্টা-উত্তরে ব্যাপারটা যখন ফয়সালা হয়, তখন কমেন্টস এর সংখ্যাও বেড়ে যায়। আর আপনার মনেও বাড়ে প্রশান্তি। এককথায় যখন অসংখ্য কমেন্টস আসে তখন আপনিও একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। মনে মনে একটা হালকা সেলিব্রেটি- সেলিব্রেটি ভাব আসে। সেই ভাবের মধ্যেই ঠাওরে নেন উপস্থাপনাটা একদম ঠিক আছেতো? আর যদি কোনো কারণে নাম করা কোনো সেলিব্রেটি আপনার পোষ্টে ধনাত্বক মন্তব্য করেন তখন আপনি আরো বেশি উৎরে যান। সুযোগ পেলেই তখন এটাকে রেফারেন্স আইটেম হিসেবে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সবার নজরে নিয়ে আসার চেষ্টা চালান। পরবর্তী পোষ্টে আপনি ধরেই নেন যেন ওনারা আপনার ঘনিষ্ঠজন। তাই সবসময় ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস মানোন্নয়নের চেষ্টা আপনার মনে গেঁথে যায়। সার্বক্ষণিক আপনার প্রচেষ্টা থাকে এদের নজর কাঁড়ার। এরা কষ্ট করে দু’কলম লিখে আপনাকে উৎসাহ জোগায়। এটা কিন্তু কম নয়। ফেসবুকে তাদের এই আচরণটি বহুলাংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। ব্যাপারটা খোলাসা করছি। আরেকটু অপেক্ষা করুন।


চতুর্থ ক্যাটাগরির দর্শকগণ ফেসবুকে আপনার পোষ্টটি শেয়ার করেন এবং শুধু লাইক কিংবা রিএ্য্যকশন দিয়েই ক্ষান্ত হন না। শেয়ার করেন। শেয়ারের সঙ্গে আবার জুড়ে দেন একটা ধনাত্বক কিংবা ঋনাত্বক মন্তব্য। ব্যাপারটা কিন্তু নেহায়েত কম নয়। এরাই আপনার আপনের মধ্যে অতি আপন। আপনার আত্মার-আত্মীয়। আপনি ধন্য হয়ে যান যখন দেখেন, তারা একাধারে লাইক-কমেন্টস উভয়ই করেছে আবার তা শেয়ার-ও করেছে। শুধু কি তাই, ইনবক্সে আবার ওয়েব দিয়ে বলছে, ‘ফ্রেন্ড, শুধু লাইক আর কমেন্টস-ই করিনি, দু’কলম লিখে নিজ প্লাটফর্ম থেকে শেয়ার করে দিয়েছি কিন্তু’। মানে হলো এরা আপনার জন্য নিবেদিত প্রাণ। শেয়ারের সংখ্যা যত বেশি হবে আপনিও তত বেশি শূন্যে ভাসবেন। এরা প্রকৃতপক্ষেই আপনার অতি কাছের মানুষ।


আবার কিছু শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন যারা মুখে সারাক্ষণ আপনার নানান প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন। অথচ ফেসবুকে আপনার পোষ্টে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার কিচ্ছু করেননি। এটা আপনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তাহলে কি ইচ্ছে করে আপনাকে উপেক্ষা করেছে, নাকি বিষয়টি নোটিশে আসেনি। সমস্যা কি? মেরে দিলেন ফোন। একথা ও কথা বলে সহসাই প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ‘আমার পোষ্টটি চোখে পড়েনি বুঝি’? আর যায় কোথায়? বেচারা বাধ্য হয়েই তখন উত্তরে শুধাবে, ‘উহ! হো! আমিতো কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে ঢুকছি না। আচ্ছা, ঠিক আছে। এক্ষুনি দেখছি’। ব্যাস। আপনার উদ্দেশ্য সফল। ফোন ছেড়ে দিতেই দেখলেন, দারুণ মন্তব্য দিয়ে আপনার পোষ্টটি শেয়ার করে দিলো। আপনিতো মহাখুশি। ফেসবুকে এমন আচরণ দেখে এদেরকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ক্যাটিগরীর অন্তর্ভুক্ত বলেই মনে হয়। কেন বলছি? শুনুন তাহলে.........


সেই ছাত্রজীবন থেকে লোকমুখে শুনে আসছি সচিবালয় চালান সহকারি সচিব ও উপ সচিবগণ; সেনাবাহিনী চালান ল্যাপ্টেটেনেন্ট, ক্যাপ্টেন ও মেজর পদবীর কর্মকর্তাগণ আর বিশ্ববিদ্যালয় চালান লেকচারার ও এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসরগণ। পরবর্তীতে আমি নিজেই একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে যোগদান করি ও এ সত্যের মুখোমুখি হই। দেখলাম আসলে কথাটা একেবারে অমূলক নয়। আমার সেই সময়ের পর্যবেক্ষণ থেকে এটুকু আমি বুঝতে পারলাম যে, লেকচারাররা পড়েন এবং পড়ান। এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসরগণ পড়েননা, কিন্তু পড়ান। এ্যাসোসিয়েট প্রফেসরগণ পড়েননা, পড়ানও না। আর প্রফেসরগণ আসেন-ই না। এটা কিন্তু একেবারেই আমার তৎকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণিত। কেউ নিজের করে নিয়ে কষ্ট পাবেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই আমার লার্নিংটুকু শেয়ার করছি। সবক্ষেত্রে এমনটি হবে তা বলছি না। ব্যতিক্রমকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এবার তাহলে কেন ফেসবুকে ইউজারের ভিন্ন ভিন্ন আচরণকে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষকদের সাথে তুলনা করেছি তার একটি ফিরিস্তি তুলে ধরতে চাই। বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে।


[বিঃদ্রঃ এটি একটি রম্য রচনা। এতে উল্লিখিত পদ-পদবি গুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক। দয়া করে অযথা নিজের সাথে তুলনা করে কষ্ট পাবেন না। এদতসত্ত্ব্বেও কারো সাথে ঘটনাক্রমে রচনাটির কোথাও মিলে গেলে ক্ষমা করবেন।]


লেখক : ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com