শিরোনাম
অধিকার আদায়ের কারিগর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২০, ২০:২৪
অধিকার আদায়ের কারিগর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ
শামস-ঈ-নোমান
প্রিন্ট অ-অ+

একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, একটি ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে এবং দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ এগিয়ে এসেছে আলোক মশাল হাতে, তার জন্মদিন আজ। ১৯২১ সালের আজকের এই দিনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো শত আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী, অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সদা বলীয়ান, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ আজকের দিনে ৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পা রাখলো।


বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি জাতিকে এতটা দিতে পারে, সেটা আসলে বিশ্বে বিরল। আমরা আজকে বাংলা ভাষায় নিজেদের ভাব আদান প্রদান করতে পারছি মূলত এই প্রতিষ্ঠানটির অনবদ্য ভূমিকার কারনেই। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় থেকেই বাংলা ভাষাকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে পাকিস্তানি শাসকেরা। এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টির এক মাস আগে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, "ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা হতে চলেছে, পাকিস্তানেও তেমনি রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হওয়া উচিত।" সেদিন জিয়াউদ্দিনের সেকথার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।


সেদিন তিনি বলেছিলেন, "অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত।" বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মিছিল হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন মাস পরেই। বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল হক ভূইয়ার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় 'রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ' নামে একটি সংগঠন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন যখন ঘোষণা করেন- "উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা", তখন রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করে। এমনকি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শপথ গ্রহণ করে যে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবে না।


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শিক্ষার্থীরা জমায়েত হতে থাকে। সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ করে তারা বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। তখন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকত সহ আরো অনেকেই। আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। ভাষার দাবিতে নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার এমন নজির আসলে বিশ্বে বিরল। সেদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা যেখানে নারীদের ঘরের কোণে আবদ্ধ রাখতে সদা তৎপর থাকতো, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীর পরস্পর কথা বলাতেও একটি অলিখিত বিধিনিষেধ কাজ করতো, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের এমন অবাধ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আসলে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নেতৃত্ব ও নারীর প্রগতির উন্মেষ ঘটেছিলো; সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শুধু নিজেরাই অংশগ্রহণ কতে ক্ষান্ত হননি, বরং ঢাকায় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতো৷ অবশেষে সকল চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম, যার নেপথ্যের কারিগর বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।


১৯৬১ সাল! তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি চলছে। সেই প্রস্তুতিতে বাধা আসে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী থেকে। কিন্তু সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে আইয়ুব সরকারের ভয় ভীতি উপেক্ষা করে গঠিত ডু কেন্দ্রিক রবীন্দ্র জন্ম-শতবার্ষিকী কমিটি মহাসমারোহে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করে। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানের দুই অংশে পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তনের কথা প্রচার করেন। ১৯৬২-৬৩ সালের ছাত্র বিক্ষোভেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্ব দেয়।


১৯৬৭ সালে তৎকালীন পশ্চিমা শাসকঘোষ্ঠি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করলে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। অতপর তারা ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সহ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুণ্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৯ সালে চাঁনখারপুল এলাকায় এক মিছিলে গুলিতে প্রাণ যায় ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আসাদের। আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে উনসত্তরের একুশে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে কর্মসূচি পালন করা হয়৷ সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক সভায় ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।


অবশেষে গণভ্যুণ্থানের প্রবল চাপের মুখে আইয়ুব খান পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনবদ্য ভূমিকা পালন করে; একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।


১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সাথে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন, অনেক শিক্ষক মুজিবনগর সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই দেশের জাতীয় পতাকা তৈরি করা হয় এবং সর্বোপ্রথম জাতীয় পতাকার উত্তোলনও হয় এখানেই। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় এ দেশের স্বাধীনতার জীবন্ত দলীল। পাকবাহিনী 'অপারেশন' সার্চ লাইট' এর মাধ্যমে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীও এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২৬ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। তারপরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন মাথা নত করেনি। বীরদর্পে লড়ে গিয়েছে তারা নিজেদের বুকের রক্তে ঢেলে দিয়েও।


স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়েও যেকোনো ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদে ফুসে উঠেছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮'র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ 'র গনঅভ্যুণ্থান, ৭০'র নির্বাচনে ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এই বিশ্ববিদ্যালয় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়। তখন ফখরুদ্দিন-মঈনের শাসনামলে সারাদেশে কালো বুটের যে কর্কশ পদচারনা চলছিলো, জ্ঞান চর্চা ও সংস্কৃতি বিকাশের পাদপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তার প্রথম প্রতিবাদ জানায়।


একটি রাষ্ট্র গঠনে, একটি রাষ্ট্রের জন্মলাভের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে তা আসলে বিশ্বে বিরল ঘটনা। রাষ্ট্র মূলত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যা রাষ্ট্র গঠন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পনের দিনে আমি তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চশিক্ষাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর করে উদার, মানবিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ ঘরে তুলবে এবং গবেষণার দ্বারা নতুন নতুন দিক উম্মোচন করবে; আমি সেই প্রত্যাশা করি।


লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সাবেক ছাত্র পরিবহন সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।


বিবার্তা/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com