শিরোনাম
করোনায় স্থবির উচ্চ-শিক্ষা সচলে জরুরি যা করণীয়
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২০, ২৩:২৯
করোনায় স্থবির উচ্চ-শিক্ষা সচলে জরুরি যা করণীয়
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

করোনাভাইরাস সংক্রমণে এশিয়ার হটস্পটের শীর্ষে এখন বাংলাদেশ।দেশে প্রথম করোনারোগী শনাক্ত হয় এবছর ৮ মার্চ । ১৬ মার্চ সরকার ঘোষণা দিয়ে ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। প্রথম দফায় ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্কুল-কলেজ সহ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ঘোষণা থাকলেও কভিড-১৯ পরিস্থিতির ভয়াবহতায় তা দফায় দফায় বাড়ানো হয়। এমাতাবস্থায় সেশনজট প্রকট হচ্ছে। ঘুরেফিরে অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার কথা এখন সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।


এমনি একটি প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে কিভাবে অন-লাইনে উচ্চ-শিক্ষা কার্যক্রম পদ্ধতি চালু রাখা যায় সে বিষয়ে আমার নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করতেই এ লেখনী। ইতোমধ্যে অর্থনীতির খাতিরে সরকার পোশাক-কারখানা স্বল্প-পরিসরে খুলে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা আমলে নিয়ে শুধু একটি জেনারেশনকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এ তাগিদ অনুভব করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। তার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আপামর জনসাধারণ। গত ২৭ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি দিয়ে কি হবে?


গত ৩০ এপ্রিল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে ইউজিসি সহ দেশের নামী-দামী সরকারি ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার তাগিদ প্রদান করেন। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন-লাইনে ক্লাস শুরুর তাগাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও ৯ দফা দিক-নির্দেশনা দিয়ে এর অধিভূক্ত কলেজসমূহকে সামর্থ্য অনুযায়ী অন-লাইনে ক্লাস পরিচালনার জন্য তাৎক্ষণিক নির্দেশনা প্রদান করে। তবে ইউজিসি'র এ আহবানের পরও বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো বিজ্ঞপ্তি দিয়েই বলে দিয়েছে যে তারা এই মুহূর্তে অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রস্তুত নয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ১৩টি শতবর্ষী কলেজের অধিকাংশই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এরই মধ্যে অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। এখানে ২ লাখ শিক্ষার্থী ও ২ হাজার ২০০ শিক্ষক রয়েছেন। ব্রজমোহন কলেজ বরিশাল, রাজশাহী কলেজ ও পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ এর অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার খবর আমাদের কাছে রয়েছে। তবে তা এখন কোনো পর্যায়ে রয়েছে কিংবা এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া কি তা এখনো জানা যায়নি।


তবে উল্লেখ করার মত একটি বড় পরিসরে অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার উদাহরণ সকলের জ্ঞাতার্থে এ মুহূর্তে উপস্থাপন করতে চাই। তাহলো মহামারীর এই দূরাবস্থার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রফেশনাল লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স কলেজসমূহ বেশ বড় পরিসরে অনেকটা গুছিয়ে ময়দানে নেমেছে। তারা ইতোমধ্যে জুম সফটওয়্যারের একটি লাইসেন্সড ভার্সন ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ৩২টি কলেজের প্রায় পাঁচ হাজার পাঁচশত শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। ২৮ মার্চ থেকে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে খ্যাতিমান শিক্ষকদের দিয়ে কোর্স পরিচালনা করছে। কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা ধীরে ধীরে মোকাবেলা করা যাবে। মনে রাখতে হবে অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম একটি একক কোনো প্রোগ্রাম নয়। কিংবা একক কোনো প্রযুক্তির উপরও নির্ভরশীল নহে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ে সময়ে যাকে আপডেট করার সুযোগ রয়েছে।


প্রশ্ন হলো করোনাভাইরাস যদি কোনোদিনই পৃথিবী থেকে না যায় তাহলে কি হবে? কতকাল বন্ধ থাকবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসতো তাই বলে। তাহলে এই পূর্বাভাস ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। করোনার সাথে অভিযোজিত হতে হবে সবাইকে। ফলে ধরে রাখতে হবে শিক্ষাখাত, অর্থনীতি, রাজনীতি সহ সব কিছু। এতদিন সুযোগ থাকতেও আমরা যে সকল সেক্টরের দিকে মনোযোগ দিইনি, সেগুলোকেই এখন অবলম্বন হিসেবে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম তেমন একটি উপেক্ষিত সেক্টর হিসেবেই এখন পর্যন্ত সর্ব মহলে পরিচিত।


সমস্যাটি কোথায়? সেই ২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে সর্বপ্রথম জাতিকে স্বপ্ন দেখান। তার সেই স্বপ্নের বিস্তার এখন অনেক ম্যাচিউর। বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় তরুন প্রজন্ম আজ অনেকটাই প্রস্তুত। এত কিছুর পরও অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালাতে আদৌ প্রস্তুত কি আমরা? উত্তরে এক বাক্যে বলা যেতে পারে 'না'। আমরা প্রস্তুত নই। প্যান্ডামিকের মধ্যে এর লেজে-গোবরে অবস্থা তাই প্রমান করে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প পরিসরে এ শিক্ষা-কার্যক্রম চালাচ্ছে তাও নামকা-ওয়াস্তে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এখনই তারা এ সেবা প্রদানে একদম প্রস্তুত নয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের বারবার তাগাদা সত্ত্বেও এ কাজে নামতে সাহস পাচ্ছে না। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২.৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী আর ৬০ হাজারের অধিক শিক্ষক নিয়ে এ কার্যক্রম চালানো ‘হাত দিয়ে হাতি ঠ্যালার সামিল’। এর কারণ ব্যাপক। একটু বিশ্লেষণ করা যাক।


অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপেরা, গুগুল ক্লাসরুম, জুম, ইউটিউব, গুগুলমেট, মাইক্রোসফট প্লাগ, অফিস ত্রি-সিক্সটি-ফাইভ ইত্যাদিসহ অনেক ওপেন- সোরস সফটওয়্যার রয়েছে। যেহেতু লাইভে একজন শিক্ষককে ক্লাস নিতে হয় তাই তার লারনিং কন্টেন্টগুলো সেল্ফ-ডেস্কক্রাইপ্টিব হওয়া বাঞ্চনীয়। যাতে শিক্ষার্থীরা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখেই তা বুঝতে পারে।


সমস্যা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাইন্ডসেটের কারণে। শিক্ষক ফেস-টু-ফেস ক্লাসের জন্য যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন-লাইনে তেমনটা সাহস করছেন না। ঠিক যেন ভরসা পাচ্ছেন না। ভয়, জড়তা ও কাজটি করতে না পারার মানসিকতা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকগণ এখনো সেই ৩০০ বছর আগের ‘চক এন্ড টক’ পদ্ধতিতেই ক্লাস নিতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মস্তিষ্কে এ কথা দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে যে, চলুক না যেমনি চলছে। নতুনকে মেনে নেয়ার প্রবণতা একদম নেই। নতুনের সাথে অভিযোজিত হলেই যত ঝামেলা। প্যাডাগোজী তৈরি করতে হবে, তার আবার ডিজিটাল কন্টেন্ট বানাতে হবে, শিক্ষার্থীদের নিকট বোধগম্য করে তুলতে তৈরি করতে হবে নানান রকমের স্লাইড, বর্ণনায় থাকতে হবে সিকোয়েন্সিয়াল এ্যারেঞ্জমেন্ট, জানতে হবে কম্পিউটার, লাগবে ওয়াই-ফাই বা ইন্টারনেট, আরো কত কি! কি দরকার এসবের? নচিকেতার ভাষায়-"এই বেশ ভালো আছি.... কর্ম নেই, কাজ নেই, গাড়ি ঘোড়ার বালাই নেই.....দু নয়নে ভয় আছে, মনে সংশয় আছে... " উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রথাগত পাঠদান পদ্ধতি দিয়েই যদি শিক্ষার্থীদের কাছে, জাতির কাছে তথা রাষ্ট্রের কাছে সুমহান, সুউচ্চ ও সুশিক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা যায় তাহলে আর বাড়তি ঝামেলার দরকারটা কি?


এই মাইন্ডসেটের আরো একটি কারণ রয়েছে। তা হচ্ছে নতুনকে মেনে না নেয়ার একটি মনস্তাত্ত্বিক ভয়। চাকরি হারানোর ভয়ের মতোই এটাকে মনে করেন তারা। একটু বিস্তারিত বললে বিষয়টি পরিস্কার হবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক নিয়োগের যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তা অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ বলেই আমি মনে করি। ভালো ফলাফল করেই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন এটা সত্যি। নর্থ-আমেরিকা বা ল্যাতিন আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেছেন তা নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই। ছাত্র ভালো ছিলেন, ডিগ্রি ভালো। সব সঠিক আছে। পাশ করার পর পরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাও মন্দ নয়। কিন্ত সমস্যা হলো এত কিছু শিখে এসেও কিভাবে প্যাডাগোজী তৈরি করতে হয় তা শিখে আসেননি। অথচ বিদেশে ডিগ্রি নিতে গিয়ে ৮০ ভাগ শিক্ষকই নিজের চোখে দেখেছেন কিভাবে তার গবেষণার সুপারভাইজার বা কোর্স-শিক্ষকগণ প্যাডাগোজী তৈরি করছেন। কিন্ত তিনি তা চর্চায় নেননি না বা নিতে চাননি। তিনি মনে করেন এখানে এতকিছু শিখিয়ে লাভ কি? এ যেন ‘উলোবনে মুক্তো’ ছড়ানোর সামিল। একথা এখন নিজেরাই স্বরণে নেননা যে, প্রযুক্তি নির্ভর শিখন একজন শিক্ষকের কোয়ালিটিকে ইনহেন্স করে। তাকে কখনোই নেগেটিভলি রিপ্লেস করে না। অতএব নতুনকে মেনে নিয়ে পুরাতনকে ত্যাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পরামর্শ হলো অন-লাইনে উচ্চ শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করতে এই মুহূর্তেই দেশের প্রথিতযশা শিক্ষকদের দিয়ে স্ব-স্ব বিষয়ে পঠন-শিখন সামগ্রী তৈরি করে তা একটি বৃহৎ প্লাটফর্মের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দেয়া।


যেটাকে আমরা লারনিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংক্ষেপে এলএমএস বলি। সুবিধা হলো- প্যাডাগোজী তৈরিতে প্রযুক্তির কাজ খুব কম। অথচ অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একবার এটি তৈরি হয়ে গেলে তা প্রযুক্তির কোনো না কোনো মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিকট পৌঁছানো যাবেই। আর শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রয়োজনে বার বার তা রিট্রাইভ করে তার পরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।


প্যান্ডামিকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রতিটি শিক্ষক হোম-কোয়ারেন্টাইনে অবস্থান করছেন। তাই বলছি-ফেস-টু-ফেস ক্লাসের জন্য যে লেকচার আপনাকে তৈরি করতে হতো, অন-লাইনেও অনেকটা তাই করতে হবে। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে শিক্ষকদেরকে একটু বেশি মনোযোগী হতে হয়। বাস্তব উদাহরণ ব্যবহারের নিমিত্তে বিভিন্ন পিক্টোগ্রাফি বা ভিডিও স্লাইড তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মাঝে অন-লাইন ক্লাসটা আকর্ষণীয় করে তুলতে হয়। এখনই সময়। একটু কষ্ট করে কোর্স-কন্টেন্টটা তৈরি করার। এজন্য একজন শিক্ষককে প্রযুক্তি-মাস্টার হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার একটু সময় ও নতুন কিছু করার মানসিকতার। যাকে আমরা ইনোভেশন বলি। ইতোমধ্যে ইউজিসি ৭৪টি প্রশ্নমালা সম্বলিত উচ্চ-শিক্ষায় অন-লাইন কার্যক্রম চালাতে একটি ‘ফিজিবিল্যাটি ষ্টাডি’ করছে। মনে হচ্ছে এর পরের ধাপেই আমরা এমন একটি প্রজ্ঞাপন পাবো যেখানে সব শিক্ষক তার স্ব-স্ব কোর্সের কন্টেন্ট তৈরির নির্দেশনা পাবেন।


প্যাডাগোজী, প্লাটফর্ম ছাড়াও অন-লাইন ক্লাসের জন্য ভালো স্পিডের ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন বা ভালো মানের একটি ট্যাবলেট দরকার হয়। অনেক সময় শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান এগুলো সহজ লভ্যে কিনতে শিক্ষারথীদের সাবসিডি দিতে পারে। পরবর্তীতে মাসিক বেতন বা ফর্ম পূরণের অর্থ মওকুফের মাধ্যমে তা সমন্বয় করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের অনেক উপকার হবে।


বাংলাদেশের উচ্চ-শিক্ষায় অন-লাইন কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করতে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এটুআই সহ আগ্রহী বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। প্যান্ডামিকের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে একাধিক সামিট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি যুত্সই সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে এমনি একাধিক সামিটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হিসেবে আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল।


সম্পূর্ণ এক না হলেও এটুকু মানতেই হবে যে ফেস-টু-ফেস ক্লাসের পরিপূরক হচ্ছে অন-লাইন ক্লাস। ইউনেস্কো দূর-শিক্ষন পদ্ধতিকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। আর অপ্রিয় হলেও সত্যি প্যান্ডামিক অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের বাস্তবতাকে ত্বরান্বিত করেছে। তাই এর কোনো বিকল্প নেই। চ্যালেঞ্জ থাকবেই। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এ বিষয়ে তিনটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। তা হচ্ছে- ক). শিক্ষক প্রস্তুত কি-না? খ). শিক্ষার্থীরা প্রস্তুত কি-না? এবং গ). প্রযুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি প্রস্তুত রয়েছে কি-না?


শিক্ষক ও শিক্ষারথীদের মাঝে এনগেজমেন্ট ও কোলাবোরেশান সঠিকভাবে না হলে লাইভ ক্লাস পরিচালনায় আউটপুট ভালো হয়না। আর এগুলোর একটিরও অভাব থাকলে নলেজ ট্রান্সফার যথাযথভাবে ঘটবে না। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর সাথে নলেজ ট্রান্সফার করে তাকে দিয়ে উচ্চতর কিংবা প্যারালাল নলেজ কো-ক্রিয়েট কিংবা রি-ক্রিয়েট করাতে না পারেন তাহলে কখনোই অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের ফলপ্রসুতা অর্জিত হবে না। এটাই সত্যি।


গ্রামের শিক্ষার্থীদের সাথে শহরের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইড এমনিতেই প্রকট। প্যান্ডামিকের এই নিদারুণ ভয়াবহতায় তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে, সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ বাণী "যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে এই ক্রাইসিস মোকাবেলা করতে হবে।" সময় এসেছে-এখন থেকে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। প্যান্ডামিকের সংক্রমণ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় কতটা সক্ষম আর কোথায় কতটা অক্ষম আমরা। যে গতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে যদি তার এক'শ ভাগের এক ভাগ গতিতে অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রম ছড়াতো তাহলে হয়তো এই দুর্যোগে অন্তত সক্ষম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমুহকে এ কাজে এতটা বেগ পেতে হতো না।


অন-লাইন ক্লাসের সুবিধা অনেক। আবার অসুবিধাও কিছু রয়েছে। যেমন ধরা যাক ফেস-টু-ফেস ক্লাসে শিক্ষক শুধু কন্টেন্ট বলে যাচ্ছেন কিন্ত বাস্তবে তা দেখাতে পারছেন না। ফলে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নিকট অনেকটা বায়বীয় থেকে যায়। অন-লাইন ক্লাসে কিন্ত সে সুযোগ থাকছে। শিক্ষার্থীদের জীবনে যদি কেউ কখনো ‘এভারেস্ট’ নাও দেখে থাকে, অন- লাইন ক্লাসের মাধ্যমে কিন্তু একজন শিক্ষক তা খুব সহজ করেই উপস্থাপন করতে পারেন। অর্থাৎ ভারচুয়াল ক্লাসে একজন শিক্ষক সারাবিশ্ব পরিদর্শন করতে পারেন এবং সঙ্গে নিজের মতো করে অডিও-ভিজ্যুয়াল ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করে পুরো শিক্ষার্থীদের নিকট তা আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন। আর এর প্রভাবেই শিক্ষার্থীদের ভেতরে জড়তা কেটে জন্ম নেয় আগ্রহের। তারা স্বপ্ন দেখে এবং স্ব-প্রণোদিত হয়ে ইনোভেশন এর দিকে ঝুকে পড়ে। এটাই হলো ‘মেটা-কগনিশন’। যেখানে একজন শিক্ষার্থী নিজের থেকেই তার পঠন-পাঠনে আগ্রহী হবেন। শিক্ষক শুধু তাকে একটি অন্য-জগত তৈরি করে দিবেন। ফলে সে আর থেমে থাকবে না। শিক্ষার্থীরা তখন প্রো-এক্টিভ হবে এবং এগিয়ে আসবে। আর তখনই অন-লাইন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য “লারনিং টু লারন; এবং থিংকিং টু থিংক” সফল হবে।


অসুবিধার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো-মেডিক্যাল শিক্ষার ব্যবহারিক ক্লাসে এটি খুব একটা কাজ দেয় না। এ্যানাটোমী বুঝাতে কংকাল আবশ্যক। আর তাতে ফেস-টু-ফেস না হলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আসে না। গনিত বা ফাইন্যান্স এর ক্লাসেও তাই। এখানে শিক্ষক ম্যানুয়াল বোর্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে অভ্যস্ত। যেটা ফেস-টু-ফেস ক্লাসে তারা ভালো পারেন। বিকল্প অবশ্যই রয়েছে কিন্তু ঐ যে মাইন্ডসেট!! কিছুই বদলাবেন না। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ'র ইভিনিং প্রোগ্রামের উপর এক জরিপে দেখা গেছে ইএমবিএ'র শিক্ষার্থীরা যারা একটু বেশি অর্থ ব্যয় করে এখানে ভর্তি হয়েছে তাদের অন-লাইনে ক্লাস করতে চরম অনীহা রয়েছে। তাদের মাঝে ধারণা হলো এতে সঠিক এ্যাসেসমেনট হয় না। গ্রেডিং কম আসে। তাছাড়া এত টাকা দিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে কি অন-লাইন ক্লাস করার জন্যে? তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে যে, প্রয়োজনে তারা প্যান্ডামিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। তবুও অন-লাইন শিক্ষা-কার্যক্রমে অংশ নিবেন না। আইবিএ'র ফ্যাকাল্টি মেম্বাররাও এ ব্যাপারে তাদের বুঝিয়ে রাজী করাতে পারেননি। উল্লেখ্য, বেশ কিছু দিন যাবত আইবিএতে অন-লাইন ক্লাসের পরীক্ষামূলক প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে।


অন-লাইনে উচ্চ-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় কিছু চ্যালেঞ্জতো অবশ্যই রয়েছে। মোটা দাগে সেগুলো নিম্নরূপ: যথাযথ কন্টেন্ট নেই; সার্বিক প্রস্তুতি নেই; স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-কানুন-পলিসিতে অন-লাইন ক্লাসের বিষয়ে বিস্তারিত না থাকা; প্রযুক্তি অভিযোজনে সমস্যা; নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা যার ফলে অনেক সময় পুরো ক্লাসের ২০ ভাগ সময় অযথা ব্যয় হয়; ক্লাস রুটিন তৈরি ও পরিবর্তনে ঝামেলা; ফেস-টু -ফেস ক্লাসকে দ্বিমূখী এবং অন-লাইন ক্লাসকে একমুখী মনে করা হয়; কন্টেন্ট সেফটি বা অন-লাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনায় নিরাপত্তার প্রশ্মে সমস্যা; তবে এক্ষেত্রে সরকারের ই-নথি প্রটেকশন পলিসি অনুসরণ করা যেতে পারে।


সিলেবাস অনুযায়ী বই/ জার্নাল বা অন্য কোনো রেফারেন্স সামগ্রী সরবরাহের জন্য শিক্ষকগণ নির্বাচিত রিডিং ম্যাটেরিয়ালস ই-মেইল করতে পারেন। যদিও অনেক শিক্ষার্থী রিমোট এক্সসেস সফটওয়্যার এর মাধ্যমে ই-লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে তার কাংখিত তথ্য খুঁজে নিতে পারেন।


অনেকেরেই প্রশ্ন অন-লাইনে পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন হবে তার কোনো নির্দেশনা বা গাইডলাইন রয়েছে কিনা? এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ হলো-পরীক্ষা পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যেখানে শিক্ষকগণ প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ করে প্রেজেন্টেশন নিতে সক্ষম এবং তাদের প্রেজেন্টেশনের তথ্য–উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে নম্বর দিবেন। তাছাড়া এ্যাসাইনমেনট, রিসার্চ পেপার বা টার্ম পেপার অফার করে তার ওপর ভিত্তি করে নম্বর বণ্টন করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে নকল করা বা প্লেজিয়ারিজম থেকে শিক্ষারথীদের অবশ্যই সতর্ক করতে হবে। বেশি ভালো হবে যদি পরীক্ষা পদ্ধতিতে সিলিবাসের ওপর এমসিকিউ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। বেশি নম্বরের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হবে যাতে উত্তর প্রদানে সরাসরি কোনো বই বা গাইড দেখে কেউ লিখতে সমর্থ না হয়। তাকে নিজের চিন্তা-শক্তি কাজে লাগিয়ে উত্তর দিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীর মেধা ও বিচক্ষণতার প্রসার ঘটবে। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের ডিপারটমেনটাল পরীক্ষা এ পদ্ধতিতে হয়। শিক্ষারথীদের ভাষায় একে ‘সিন পেপার এক্সাম’ বলে। লিখিত উত্তরপত্র নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ক্যান করে বা ছবি তুলে ইমেইল বা অন্যকোনো পোর্টাল/মাধ্যমে আপলোড করে পাঠানো যেতে পারে। সবশেষে অন-লাইনে সাক্ষাৎকার নেয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা পদ্ধতি শেষ করা যেতে পারে। সর্ব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালা/আইনকানুন অটুট রাখতে হবে।


করোনা প্রতিরোধে বা করোনা থেকে জীবন বাঁচাত যেমননি প্রতিক্ষণ-প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন ওষুধ আর ভ্যাকসিনের কথা শোনা যাচ্ছে। ঠিক করোনার প্রভাবে স্থবির শিক্ষাখাত রক্ষার্থেও তেমনি নানামুখী পদক্ষেপের কথা সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। করোনার গতি-প্রকৃতি যেমন ভ্যাকসিন রুখে দিতে পারে। উচ্চ-শিক্ষায় সেশনজটের গতিও তেমনি অন-লাইনের মাধমে রুখে দেয়া সম্ভব। তাই মহাপরিকল্পনা নিয়ে এখনই সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। বিলম্বে বিপদ বাড়বে।


লেখক: ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/জাহিদ


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com