সেই একই দেশের মাটিতে যখন পদার্পন করলেন তিনি তখন চির-চেনা শহরটির রূপ গেছে পাল্টে। রাস্তা-দালান-নিয়ন বাতির রূপ পাল্টেছে তো বটেই কিন্তু এর চেয়েও ভয়ানক এক অদৃশ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে দেশ জুড়ে – মানুষের মনোজগতে। বিগত কয়েক বছর ধরে একাদিক্রমে দেশটির কাঁধে ইস্কান্দার মির্জা-আইয়ুব-ইয়াহিয়ার মতন উর্দিধারী রাজন্যরা সওয়ার থেকে দেশের মানুষকে বেশ তাদের পরিকল্পনামত গড়ে নেবার সুযোগ পেয়েছেন। এমনকি শ্রেণীকক্ষে এসে ‘রাজনীতি কাহাকে বলে, কিভাবে রাজনীতি করিতে হয়’ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ক্লাশ নিচ্ছেন উর্দিধারী নেতা এবং তার ধামাধরারা। ঠোটের কোণে লেপ্টে থাকা ঈষৎ বাঁকা হাসি হেসে নির্ভুল ইংরেজিতে ঐ উর্দিধারী নেতা এর মধ্যে জোর গলায় বলেছেন, “I will make politics difficult for the politicians”। তিনি নিছক বলার জন্য তা বলেননি – তা করে দেখাবার শতভাগ অঙ্গিকার নিয়েই বলেছিলেন এবং তা করেছিলেন।
একইভাবে নিছক পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার মানসে পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেনি ঘাতকেরা – বঙ্গবন্ধুহীন অবারিত দেশের খোলনলচে পালটে দেবার অঙ্গিকার করেই ঘটিয়েছিল সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড। ঘাতকেরা জাতির পিতাকে নৃশসভাবে হত্যাই শুধু করেনি –যেন কেউ কোনোদিন এই হত্যার বিচার করতে না পারে, শাস্তি দিতে না পারে সেজন্যে সংবিধানে শাস্তি এড়াবার আইন যুক্ত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জিরো আওয়ার থেকেই তারা সক্রিয় থেকেছে দেশকে মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী অবয়বে সাজাতে। ফলে সংবিধান, প্রশাসন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, শিক্ষাংগন, বিদেশনীতি – সর্বত্র রাতারাতি এমন সব সাংঘাতিক বীজ রোপন করেছে এই ঘাতকেরা যা সময়ান্তে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। সেই বিষবৃক্ষের ছায়ায় লালিত-পালিত হওয়া তরুণ প্রজন্মের এক বড় অংশ বিশ্বাস করেছে এ-ই বুঝি বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে কারা কক্ষে বন্দী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের চার দেশপ্রেমিক নেতাকে হত্যা করে ঘাতকেরা তাদের পল্লবিত হবার জন্য আরো সহায়ক আবহ তৈরি করে নিয়েছে। সেই উপযোগী পরিবেশে একে একে প্রকাশ্যে এসেছে গর্তে লুকিয়ে থাকা একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা আর দুই হাত প্রসারিত করে উর্দিধারি নেতা তাদের সকলকে পদ-পদবী-অন্ন-বস্ত্র-অর্থ দিয়ে ঘাড়ে-গর্দানে মোটা হবার সুযোগ করে দিয়েছেন। অতঃপর উর্দিধারি বিশেষ মানুষেরা, উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক আর ঘাতক-দালালের দল ক্ষমতাকে ঘিরে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যের মতো একাত্ন হয়ে শহীদের রক্তে অর্জিত এই বাংলাদেশে পরমানন্দে ‘দিন গুজরান করা আরম্ভ করেছে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই। একই সাথে দূরে ঠেলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগে সংশ্লিষ্ট সকল কিছুকে।
এই সকল যোগ-বিয়োগের ফলে ইতোমধ্যেই টেক্সটবুক থেকে উধাও করে দেয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান নামে এক অবিসংবাদিত নেতার নাম – যাকে হৃদয়ে ধারণ করে জীবনপণ লড়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো এদেশের দেশপ্রেমিক মানুষেরা। সেখানে নেই কাদের সাথে একাত্তর সালে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল সে কথা, নেই কারা এই যুদ্ধে আমাদের হত্যা করেছিল। আরও নেই শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে সঠিক তথ্য, নেই শহীদ বুদ্ধীজীবীদের নাম, এমনকি কারা তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল সেইসব ঘাতকের নাম, ঘাতক সংগঠনের নাম। সব মিলিয়ে আমাদের ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধ-ঘনিষ্ট সব নাম, ইতিহাস মুছে দেবার ব্যাপক আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের মুলচেতনা বিরোধী ক্ষমতাধারীরা। তাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিতে দেশের বাইরের নানা শক্তি নানাভাবে সহায়তা দিতে থাকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই তখন ব্যস্ত দেশের নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী শক্তি। ছাত্র-জনতাও এক অদ্ভুত ধোয়াশাচ্ছনতার মধ্যে যেন ক্রমশই পথ হারিয়ে ফেলতে থাকে। তরুণ প্রজন্মের মন দেশে চলমান ‘ডিফিকাল্ট পলিটিক্স’-এর নির্যাসে পুষ্ট হতে থাকে। এর মধ্যে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর প্রায় ছয় বছর গত হয়েছে। এমনই এক পালটে যাওয়া সমাজে – যেখানে অপহৃত হয়ে গেছে আমাদের জাতির ইতিহাস, চেতনা ও নানা অর্জন সেই স্বদেশভূমি বাংলাদেশে এলেন তিনি আজ – শেখ হাসিনা – বঙ্গবন্ধু-কন্যা। বলছি আজ থেকে ৩৯ বছর আগের কথা। কিন্তু কেন বলছি, কেন স্মরণ করছি সেদিনের কথা?
এর উত্তর একেবারেই সহজ – বলছি কারণ তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে আমাদের আবার মুক্তিযুদ্ধের স্বদেশের স্পর্শ পাওয়া, স্বাদ নেয়ার দ্বারোন্মোচন হয়েছিল। শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন বলেই তো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে পারলো। সম্ভব হলো যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারিদের বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ করা ও তা চলমান রাখা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণতান্ত্রিক, আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লব্ধি ফল। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তির যুক্ততা ছিল সবচেয়ে বেশী প্রত্যাশিত। গোলাম আজমের প্রতীকী বিচারের জন্য গণআদালতের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল – সেখানে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম নেতৃত্ব দিয়েছেন সত্য – সেই আন্দোলনকে সফল করার ক্ষেত্রে নানা সংগঠন ও ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন সত্য কিন্তু এ ক্ষেত্রে তদানীন্তন সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানিকারী রাজনৈতিক দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার যুক্ততার গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশী।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এই দেশ থেকে সম্পূর্ণ নির্মুল করার অভিপ্রায় সেই পাকিস্তান আমল থেকেই সামরিক শাসক, তাদের তাবেদার এবং বাম-ডান নানা মহলের রয়েছে। কে না জানে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই আওয়ামী-বিরোধিতার নামে নানা অপরাজনীতি, অপচেষ্টা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে। এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার নানা চেষ্টা নেবার পরও এর প্রাণ-প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলে থাকার কালেই এর হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা, এবং তার নেতৃত্বে নব-উদ্যমে এদেশে আবার আওয়ামী লীগ রাজনীতি শুরু করে। কিন্তু বারে বারেই আঘাত এসেছে বিশেষত তার ওপরে। শেখ হাসিনার প্রাণ সংহারের জন্য অগণিতবার অপচেষ্টা করলেও জাতির জন্য সৌভাগ্য যে তিনি বারবারই রক্ষা পেয়েছেন।
বিগত ২০০৪ সালে বিএনপি আমলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপরে গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি মানব ইতিহাসের ঘৃন্যতম এক প্রচেষ্টা ছিল। সেসব আঘাত সামলাবার অব্যবহিত পর তাকে মোকাবেলা করতে হয় ‘মাইনাস টু’ চক্রান্তের। ২০০৮ সালে ভূমি-ধস জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরপরই বিডিআর বিদ্রোহ মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠে। ২০১০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধ ও মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠনের পর থেকে অভ্যন্তরীণ। জাতি সংঘের প্রধান বান কি মুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন কেরি বা ষ্টিফেন জে র্যাপসহ অন্যান্য দেশের নেতা/সংগঠনের অন্তহীন প্রবল চাপ সামলে এদেশের হেভি ওয়েট যুদ্ধাপরাধী/মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার প্রক্রিয়া শুধু এগিয়ে নেয়া নয়, বিচার পরবর্তী রায় বাস্তবায়নে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন।
এই বিচার চলাকালীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে খালেদা জিয়ার আহবানে দেশজুড়ে কয়েক মাসব্যাপী পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস শুরু হয় – সরকার প্রধান হিসেবে তাকেই সতর্কতার সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভূমিকা রাখতে হয়। অন্তবিহীন এই সব নানা পরিস্থিতির মধ্যে থেকে এগিয়ে যাবার কালে তিনি একজন ঋজু নেতার গুনাবলী অর্জন করেছেন – যা এইসকল অপ্রত্যাশিত নানা আঘাত সামলাতে জরুরি। তবে তার এই এগিয়ে চলা সহ্য করতে না পারার মত মানুষেরও কমতি নেই এই দেশে। যত ভাল কাজই করুন না কেন শেখ হাসিনা – তাদের কাছে তিনি কখনোই গ্রহণযোগ্য নেতা নন। ‘যারে দেখতে নারি – তার চলন বাঁকা’ প্রবাদের অনুসারী এ ধরনের মানুষেরা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তাদের যত ক্ষোভ, রাগ, দ্বেষ তারা প্রতি নিয়তই উগরে দেয় টিভি টক শো’তে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মনে রাখা দরকার যে পৃথিবীর কোনো মানুষই শতভাগ পারফেক্ট নয়, হতে পারে না।
এই দেশের রাজনৈতিক সাগরে নানা ডিরেকশনের স্রোত সতত বহমান – এর মধ্যে দিয়েই নাবিকের সিটে বসা শেখ হাসিনা পাড়ি দিচ্ছেন এই উত্তাল সাগর। তার কৃত সকল কিছুই সমালোচনার উর্ধে – তা দাবি করছি না। এই লেখায় মুলত বলতে চাইছি যে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি এদেশের মৌলিক অনেক বিষয়ে সাহসের সাথে কাজ সম্পন্ন করেছেন, এবং আরো করবেন বলেই বিশ্বাস করি। শেখ হাসিনাকে সেই পৌরাণিক ‘ফিনিক্স পাখী’র তুলনা করা যায় – যে পাখীকে নিঃশেষ করতে চাইলেও নিঃশেষ হয় না বরং নব শক্তিতে পুনরায় জেগে ওঠে।
বিাবর্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]