এতদিন শুধু ছুটির অপেক্ষায় থাকতাম। ছুটি মিলতো না। অফিসের বড় কর্তা বলতেন-"ছুটি-টুটি হবে না। ওসব আবেদন দিয়ে লাভ নেই। এত বিদেশ যাওয়া-যাওয়ি কিসের? এসব চলবে না। কাজ আছে কাজ। একটি ঘন্টাও নষ্ট করার মতো সময় নেই।" মাঝে মাঝে ভাবতাম- মানুষ আর রইলাম কই? যন্ত্রের সাথে থাকতে থাকতে পুরাই যন্ত্র বনে গেছি। এমন কোনোদিন ছিল না যে বাসায় এসে হাজারো অভিযোগের মুখোমুখি না হয়েছি। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া কন্যাতো কথায় কথায় শুধাতো- তুমি কি আমাকে সময় দাও যে পড়াশোনা করি কিনা জানবে? তুমিতো বাসায়ই থাকো না বাবা। জানবে কি করে আমি কখন পড়ি-না- পড়ি?
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিতাম দৌড়! জ্যামের ভয়ে আধা নাস্তা সেড়ে চায়ের গরম মগ নিয়েই গাড়িতে উঠতাম। ইস, ব্যস্ত আমি ভীষণ রকম সময় যে ছিলো না কোনো! প্রতিদিন ৪/৫ ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে অফিস, সিটি অফিস, মিটিং, সিটিং, ক্লাস, কতকি! রাতে ঘরে ফিরেই আবার ব্যাডমিন্টন খেলতে মাঠে দৌড়। বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বউ-বাচ্চার বকা-ঝকাতো আছেই। সাক্ষাৎ মেহমানের মতো অনেক রাতে ঘরে ঢুকতাম, আবার সুবেহ-সাদিকে বিদায় নিতাম। এই ছিলো জীবন। থোরাই কেয়ার করেছি সবকিছু। যাকে বলে কুচপরোয়ানেহি।
কিন্তু কি আশ্চর্য! গতিময় জীবনে একি ছন্দপতন! হঠাৎ করে কে যেন মাথায় সজোড়ে আঘাত করে আমার স্মৃতিশক্তি সব কেড়ে নিল। ঠিক যেনো বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো...... এখন সব আবছা আ...ব....ছা মনে পড়ছে। Once upon a time আমার একটা অফিস ছিল; শেভ-টেভের ব্যাপার ছিল; পোশাক-আশাকের চমক ছিল; রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কোথায় যেনো যেতাম...! পুরোটা ঠিক মনে পড়ছে না...কি যেন গাডড়ি... ড্রাইভার..টং ঘর.. কাশবন..জ্যাম....ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে ঘুমিয়ে যাওয়া...ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা.... । স্বপ্ন ভেঙে গেলে দেখতাম জায়গারটা জায়গায়ই ব্রেক করে বসে আছি। যেন ছিটানো ঔষধে ইদুর আটকে যাবার মতো। বিরক্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। ড্রাইভার ডেকে তুলতো, "স্যার ঘাট আইস্যা গেছে"। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছি। গেইট দিয়ে ঢুকতেই পকেট থেকে চিরুনি বের করে মাথা আঁচড়িয়ে ফিটফাট হতেই মনে পড়তো “বরিশালের লঞ্চ থেকে নামছি বুঝি।” সদরঘাট দেখা দিলেই ‘কেবিন বয়’ এভাবে ডেকে তুলতো। আর তখনি সারারাতের ক্লান্তি ঝেড়ে কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে মুখ হাত ধুয়ে, মাথা আঁচড়িয়ে লঞ্চ থেকে নামার জন্য রেডি হতাম। এমন স্মৃতি যার নেই সে বরিশাইল্যা হতেই পারেনা।
যাকগে ওসব কথা। কাজের কথায় আসি। অফিসে অনেকেই শ্রান্তি বিনোদনের ভাতা আর ১৫ দিনের পাওনা ছুটির আবেদন নিয়ে এলে বলতাম- ভাতা পাবেন ঠিকই কিন্তু ছুটি মিলবে না বাপু। মন খারাপ করে তারা মিন মিন করে বলতো, "স্যার বাচ্চাটা এসএসসি দিবে। দিননা ক’টা দিন ছুটি।" ভাব নিয়ে বলতাম, দেখুন, বাচ্চার পরীক্ষা বাচ্চা দিবে। আপনার সমস্যা কি? আপনারা ছুটি নিলে অফিস চলবে কি করে?
হায়রে জীবন। এখন কে কারে ছুটি দেয়? এত ছুটি পেয়েও আজ আমি বড্ড একা। তাইতো মনে বাজে মিনারের গানের সেই কথাগুলো-
"সাদা রঙের স্বপ্নগুলো দিলো নাকো ছুটি;
তাইতো আমি বসে একা,
ঘাসফুলেদের সাথে আমি একাই কথা বলি
ঘাসফুলগুলো সব ছন্নছাড়া||"
আজ ক'মাস হলো বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, দূরদর্শন আর গোটা বিশেক দেশী টিভি চ্যানেলসহ সোসাল মিডিয়ায় মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে পুরোপুরি খেই হারিয়ে ফেলেছি। লাশের গাডড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, সাদা কাপড়ে মোড়ানো মহাশূন্যের নভোচারীরাই (পিপিই পরিহত স্বাস্থ্য ও সমাজ কর্মীরা) যেন এখন বিচরণ করছে সর্বত্র। যত্রতত্রই চোখে পড়ছে খাদ্যের জন্য খেটে খাওয়া মানুষের হাহাকার!
প্রতিদিন আক্রান্তের খবর আর লাশের সংখ্যা শুনে ভয়ে জড়সড় হয়ে আবার শুয়ে যাই। জেগে উঠেও দেখি সেই একই অবস্থা। আশা নেই, ভরসা নেই। চোখে অমানিশার অন্ধকার। এ এক অন্য রকম নেশার ঘোরে সকাল থেকে রাত অবধি কেটে যাচ্ছে সময়। স্মৃতিশক্তি ফিরে পেতে রোজই টিভি টকশোতে চমৎকার সব দাওয়াই দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা পেশার বাইরের হেকিম সাহেবরা! তাদের কথায় তথাকথিত 'পরিশ্রমের' বদলে 'হাড়ভাঙা বিশ্রামে' আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত-অবসন্ন । কোনো দাওয়াইয়ে কাজ হচ্ছে না। সম্ভিৎ ফিরে পেতে উপায় একটাই। পুনরায় মাথায় আঘাত পাওয়া। কেন? ফিল্মের শেষ ভাগে তো তাই থাকে। দেখেননি? কিন্তু কে করবে সেই মধুর আঘাত? কে ফিরিয়ে দিবে আমার সেই অফিস... ব্যস্ততা....টং ঘর... গৌরবময় অতীত? জানি না। শুধু জানি স্মৃতিশক্তি ফিরে পেতে আবার একটি মাথায় আঘাত আমার বড্ড প্রয়োজন। আমি এই বিভীষিকাময় করোনা মাৎসয়নাকে ভুলে থাকতে চাই। আমি বিশ্বাস করতে চাই একসাথে এতগুলো লাশের মিছিল কোনো সত্যি ঘটনা ছিল না। আমার গ্রহে অদৃশ্য কোনো অনুজীব এভাবে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারে না। ঈশ্বরকে বলবো-পুরো জীবনচক্র থেকে এই দুঃসময়টাকে ‘শূন্য-মান ধরে বাড়িয়ে দিন এ গ্রহের মানুষের গড় আয়ু। আমি বিশ্বাস করতে চাই 'The Corona Era' বলতে কোনো কালেই কিছু ছিল না। পুরো সময়টা ছিল ওই জ্যামে থাকাকালীন কাচাঘুমের এক টুকরো বাজে দু:স্বপ্ন। কিন্তু হায়!! সেই মধুর আঘাতটি পেতেও আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ১২ থেকে ১৮ মাস। মুখাপেক্ষী হতে হবে ধনী রাষ্ট্রসমূহের। ততদিনে মৃতের সংখ্যা কততে গিয়ে ঠেকবে কে জানে? সময়ই তা বলে দিবে।
লেখক: প্রফেসর, ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]