শিরোনাম
ক্রিমিনোলজি-- একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২০, ১৬:৫১
ক্রিমিনোলজি-- একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা
সোহানী পূষণ
প্রিন্ট অ-অ+

গত কয়েকদিন ধরে হুমায়ূন আহমেদ এর মিসির আলি সমগ্র পড়ছি ।আগেও পড়েছি ।তবে সমগ্র একসাথে কখনো পড়া হয়নি ।আলাদা আলাদা বই আলাদা আলাদা সময়ে পড়েছি।কেন জানি হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার কিছু বই আর মিসিরআলী ছাড়া পরের দিকের অন্য কোন লেখা ভাল লাগেনা আমার।


যাই হোক মুল বিষয় অন্য কিছু । বইগুলো পড়তে পড়তে মনে হলো তিনি কীভাবে প্যারানরমাল এক্টিভিটি বা প্যারাসাইকোলজির বিষয়গুলো অত্যন্ত যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা হত্যা সম্পর্কিত। যেগুলো আমাদের বিচারক জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পড়তে পড়তে ক্রিমিনোলজি ,ক্রিমিনাল সাইন্স , প্যারাসাইকোলজি সম্পর্কে আগ্রহ হলো। মনে হলো আমরা অনার্সে যখন ক্রিমিনোলজি পড়েছি তখন ক্রিমিনাল সাইন্স এর উদ্ভব ,বিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে হয়েছে।


ঘাটাঘাটি করলাম কিছুটা।অপরাধ বিষয়টি সৃষ্টির শুরু থেকে থাকলেও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এর আলোচনার ইতিহাস খুব বেশি নয় বলে মনে হল।(Cesare Lombroso)


আমার মনে পড়ে ক্রিমিনোলজি বইয়ে আমরা সিজার লমব্রসোর তত্ত্ব পড়েছি। উনি মনে করতেন ক্রিমিনাল হয় মানুষ ( by born )জন্মগতভাবে ।ওই সময় ধারণা করা হতো যেসব ব্যক্তিদের চোয়াল অত্যন্ত শক্ত বা যাদের হাড়ের গঠন শক্ত, মজবুত বা দাঁত একটু ভিন্ন ধরনের তারা উগ্র প্রকৃতির হয় এবং অপরাধ সংগঠনের প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি থাকে। যদিও পরে এই বিষয়টি ১৮০০ শতকের মধ্যে আর প্রতিষ্ঠিত হয়নি।(Richard Speck)


এরপর আসি ষাটের দশকে একটি ঘটনা যা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা হয়েছে। এটাও স্টুডেন্ট অবস্থায় পড়েছি। ষাটের দশকে আমেরিকান গবেষকরা মনে করতেন যে, যারা উচ্চ পর্যায়ের ক্রিমিনাল তাদের এক্স-ওয়াই-ওয়াই সিনড্রোম(XYY Syndrome) আছে। এ বিষয়ে একটি ঘটনা মনে পড়ে।পরবর্তীতে ওই একই ঘটনা নিয়ে একটি মুভি দেখছিলাম।


১৯৬৬ সালে সংঘটিত এই মাস কিলিংয়ের বিষয়ে ( mass killing) তখন একটি অবৈজ্ঞানিক ধারণা পোষণ করা হতো । সেটা হচ্ছে একজন মানুষের শরীরে স্বাভাবিক ক্রোমোজোম সিস্টেমে এই ধরনের ক্রিমিনাল বা অপরাধকারী শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা বেশি।অর্থাৎ যেখানে এক্স ওয়াই হওয়ার কথা সেখানে তাদের একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজোম আছে, যা হচ্ছে এক্স-ওয়াই-ওয়াই (XYY) । এই বিষয় নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত অপরাধী হচ্ছে Richard Speck.


Richard Speck এমন একজন ব্যক্তি তিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকার একটি হসপিটালে ০৮ জন নার্সকে অত্যন্ত হিংস্রভাবে অর্থাৎ ব্রুটালি রেপপূর্বক হত্যা করে। এ ব্যক্তিকে নিয়েও গবেষণা করা হয় । ধারণা করা হয় যে তার শরীরে একটি ওয়াই ক্রোমোজোম বেশি থাকায় সে এই ধরনের কাজ করেছে।Cook county court তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে পরে Illinois supreme court তা পরিবর্তন করে কারাদণ্ড দেয়।


অবশ্য পরে অনেক গবেষণা পূর্বক এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে এক্স-ওয়াই-ওয়াই সিনড্রোম বিষয়টি ভুল ছিল।এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে 2007 সালে তৈরি হওয়া ওই মুভিটি দেখে আমার এতোটুকু মনে পড়ে যে আসলে Richard Speck এর মূল সমস্যা ছিল অন্যখানে।


সে ছিল এককথায় এতিম। শৈশবে তাকে অনেক নির্যাতন করা হয়। সিনেমায় যেভাবে দেখেছিলাম, সে তার সৎপিতা দ্বারা দিনের পর দিন বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়। যার মধ্যে যৌন নির্যাতন ছিল উল্লেখযোগ্য। শিশু অবস্থায় সে যেখানে সুরক্ষা পাবে সেখানেই সে প্রধান ভিকটিম হয়ে যায় ।



শৈশবের এই দুঃসহ স্মৃতি বা অত্যাচারের কারণে মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। অর্থাৎএকজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে সুস্থ দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার অন্তর বা চেতন মন বা অবচেতন মন পুরোটাই অসুস্থ। সে চিন্তা করছে কিভাবে খুব নিষ্ঠুর ভাবে এবং যৌন নির্যাতনপূর্বক কাউকে মেরে ফেলা যায়। Richard Speckকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে এই কাজ কেন করেছে ।তখন সে বলেছিল ,"আসলে আমি কেন করেছি । এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে" ,যেন কিছুই হয়নি ।


বেশ কয়েক বছর পর ঐ বন্দী অবস্থায় তার হার্ট অ্যাটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় । যেসব কারারক্ষীরা খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছিল তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বোঝা যায় যে, সে কারাবন্দি থাকা অবস্থায়ও খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল।প্যারানরমাল একটিভিটি বা প্যারাসাইকোলজি।


ভয়


একটা হত্যা মামলার ঘটনা পড়লাম । সেখানে ভিকটিমকে ভয় দেখিয়ে হত্যা করা হয়। ভিকটিমের মেডিকেল রিপোর্টে আসে যে তার স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তদন্ত করে দেখা যায় যে খুব পরিকল্পিতভাবে তাকে এই ভয় দেখানো হয়েছে । ভয় দেখানোটা ছিল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। হাই স্কুলে পড়ার সময় আমরা খুব জোরেশোরে একটি সিরিয়াল দেখতাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। সিরিয়াল এক্স ফাইলস। সেখানে নায়ক ছিল মোল্ডার আর নায়িকা স্ক্যারলি । এই জুটি ছিল আমাদের কাছে তখন ভীষণ জনপ্রিয়। তখন বুঝতাম না। এখন বুঝি সেটা ছিল প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটির তদন্ত নিয়ে। এই বিষয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করলাম। বোঝা গেল যে এটা নিয়ে বিভিন্ন রকমের মতবাদ আছে।


কেউ যুক্তি দিয়ে সেগুলোর সমাধান করার বা শেষ নামানোর চেষ্টা করেছেন আবার কেউ সেটাকে প্যারানরমাল বা অসমাধিত হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই পজিটিভ বিষয়ে চর্চার পাশাপাশি নেগেটিভ বিভিন্ন বিষয়ের চর্চা ছিল। যার মধ্যে বারবার ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর কোনো ধর্মই অনৈতিকতা বা কালো শক্তির চর্চাকে সমর্থন করে না।


ভয় ,প্যারাসাইকোলজি ,কুসংস্কার , জিন


আমার কাছে মনে হয় সবকিছুর মূলে মানুষের মন। গবেষণা অনুযায়ী মানুষ সৃষ্টির শুরুতে ছিল গুহায় ।সেখানে থাকত অন্ধকার আর অন্ধকারের এই বীজ মানুষের জিনের মধ্যে বংশপরম্পরায় আমরা আজও বহন করছি । এই কারনে যখন ঘর অন্ধকার হয় আমাদের ভয় লাগে ,যখন অন্ধকার কোন বাথরুমে যাই আমরা ,আমাদের ভয় লাগে। যেসব বিষয়ে আমরা দিনের আলোয় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখি ,সেগুলো স্বাভাবিকভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয় আবার ওই একই বিষয় রাতের অন্ধকারে দেখলে অস্বাভাবিক মনে হয়।


এছাড়া মানুষের মনের কুসংস্কার তো আছেই ষোল কলা পূর্ণ করার জন্য। কেউ যদি পারিবারিকভাবে বিভিন্ন রকমের কুসংস্কারের সাথে বড় হয় দেখা যায় যে ,সে যখন পূর্ণাঙ্গ যুবক-যুবতী হয় তখন তার দিনের রাতের 24 ঘন্টার মধ্যেই তার এই কুসংস্কার বিভিন্ন বিষয়ের সাথে কানেক্ট করার চেষ্টা করে এবং সেই ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে সে অনুযায়ী। এরকম করতে করতে অনেকে অসুস্থ হয়ে যায় ।


প্যারানরমাল এক্টিভিটি আসলে তখন মূলত শুরু হয় ।একটা দড়ি দেখে সে ভাবছে সাপ দেখা যাচ্ছে। এসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এই পৃথিবীতে বহু হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। যেগুলোর অনেক কিছুর রহস্য উদঘাটন হয়নি । কোন মানুষের ভিতরে অজানা ভয় বা কোন ধরনের অযৌক্তিক বিষয় মস্তিষ্কের নিউরোনে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেয়ার মতো ভয়ঙ্কর কাজটি করতে পারলে অন্য কেউ ওই মানুষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।


দেখা গেছে এ ধরনের কাজ দিয়ে সম্পত্তি কুক্ষিগত করা হয়েছে ,হক নষ্ট করা হয়েছে । শিক্ষা সংস্কারের আবির্ভাব হওয়ার পর আস্তে আস্তে এই বিষয়গুলো অনেকাংশে কমেছে। যুক্তি দিয়ে মনকে বোঝানো হয়েছে।তারপরেও ভয় নামের এই বস্তু মানুষকে ছেড়ে যায় না । আসলে মানুষ নামের এই জাতি হাজার বছরের ডিএনএ মানচিত্রে তা বহন করে আসছে। তাই হয়তো যৌক্তিক মন বলছে ভয়ঙ্কর কিছু নেই, অযৌক্তিক মনে বলছে , না না কিছু একটা আছে।



যারা কুসংস্কারমুক্ত , মানসিকভাবে শক্তিশালী তারা এ ধরনের বিষয় থেকে অনেকাংশে মুক্ত। মানুষের শৈশব, বড় হয়ে ওঠা ,চারিপাশের পরিবেশ সবকিছু একজন মানুষকে অপরাধী করে তোলে। জন্মগতভাবে বা শারীরিক গঠন এর সাথে সম্পৃক্ত নয়, ব্যতিক্রমী কিছু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য ছাড়া। তাই যুক্তি হোক শুদ্ধ মুক্তির উপায়।।


লেখক:যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, মাগুরা


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com