করোনা কোনো সাধারণ ফ্লু না.. প্রচন্ড জ্বর.. দম বন্ধ হয়ে ডুবে যাওয়ার মত শ্বাস কষ্ট! এভাবে চোখের সামনেই চলে যেতে দেখছেন উন্নত বিশ্বের ডাক্তারগণ। অবশ্যই আক্রান্ত উন্নত বিশ্বের সব সুযোগ সুবিধাপ্রপ্ত দেশের ডাক্তার তারা। কিছুদিন আগে হয়ত তারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশের মতো (এখন আমরা যা ভাবছি) কিছুই হবে না।
ইতালিয়ান একজন ডাক্তার বলছিলেন, আমাদের দেশে এখন ঘটে চলছে ভয়াবহ এক ট্রাজেডি। বৃদ্ধ রোগীরা মারা যাবার আগে চোখের পানি ফেলছেন। কাছের মানুষদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার সৌভাগ্যও পর্যন্ত তাদের নেই। তারা একা একা মরতে চাননি, কিন্তু তাদের বিদায় জানাতে হচ্ছে ক্যামেরায়। তারা সজ্ঞানে, সমস্ত কষ্টকে সহ্য করে মারা যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রী একই দিনে মারা যাচ্ছেন। বৃদ্ধ দাদা-দাদি, নানা-নানীর তাদের নাতিদের মুখ শেষবারের মতোও দেখতে পাচ্ছেন না। এই রোগ ফ্লুর (সংক্রমিত) চাইতেও ভয়াবহ। বিশ্বাস করুন ফ্লুর চাইতে অনেক ভিন্নরকমের অসুখ এটি। এই রোগকে দয়া করে তাই ফ্লু বলবেন না। জ্বর অসম্ভব বেশি, রোগীর দম এমনভাবে বন্ধ হয়ে আসতে চায় যেন সে ডুবে যাচ্ছে। রোগীরা হাসপাতালে আসতে চায়না। শুধু একটু অক্সিজেন পাবার জন্য তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এই রোগের বিরুদ্ধে খুব সামান্য কিছু ওষুধ কাজ করে। আমরা সাহায্য করার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে রোগীর অবস্থার উপর। বৃদ্ধ রোগীরা এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠছেন না।
আমরা কাঁদছি। আমাদের নার্সরা কাঁদছে। সবাইকে বাঁচিয়ে তোলবার সামর্থ্য আমাদের নেই। চোখের সামনে মেশিনে তাদের জীবন থেমে যেতে দেখছি প্রতিদিন। প্রচুর রোগী আসছেন। অতি দ্রুত আমাদের আরো অনেক বেড প্রয়োজন হবে। সবার একই সমস্যা। সাধারণ নিউমোনিয়া। প্রচণ্ড শক্তিশালী নিউমোনিয়া। আমাকে বলুন কোন ফ্লু এই ট্রাজেডির জন্ম দেয়? এই ফ্লু অত্যন্ত সংক্রামক। এই ভাইরাসটি একেবারেই অন্যরকম। কোনো কোনো মানুষের জন্য ভয়ংকর।
স্পেন থেকে বাঙালি ডাক্তার তাহসিনা আক্তার জানাচ্ছিলেন, আমাদের হাতে তিন মাসের লম্বা সময় ছিল। যা আমরা হেলায় হারাচ্ছি এবং সে সময়ে তাসের ঘরের মত থুবড়ে পড়বে স্বাভাবিক প্রতিরোধ টুকুও। বিপদের আন্দাজাও করতে পারছি না, এত ভয়াবহ হবে সেটা!
স্পেন হল ইউরোপের উষ্ণতর, আলোকোজ্জ্বল দেশ। রোদে খটখট সারা বছর। মরুভূমির মত ভুপ্রকৃতি। লোকজনের আয়ুস্কাল দীর্ঘ। গড় আয়ুর দিক দিয়ে জাপানিদের পরেই স্পেনের অবস্থান। দেশটির ৯০ ভাগ মানুষ সুস্থ ভাবে বিচরণ করেন। সামনেই গ্রীষ্মকাল। পর্যটন নির্ভর সুন্দর দেশটির আয়ের অন্যতম সময়। এ সময়ে করোনা নিয়ে মাতামাতি করতে কারোই ভালো লাগছিল না। করোনা যখন ইতালিতে বিষবাষ্প ছাড়ছে তখনো স্পেন ছিল নির্বিকার!! অথচ করোনা হাটিহাটি পা পা করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই হানা দিলো রাজধানি মাদ্রিদে!!
তখন দেশ পরিচালনাকরীরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকছিলেন!! সেরে যাবে! চলে যাবে! ছুহ ছুহ করছেন!
এক সপ্তাহ পরেই বোঝা গেলো, করোনা না গরম মানে, না সুস্থ শরীর মানে, না নারী শিশু মানে!! করোনা কোনো করুনা করছে না, বিদ্যুৎ বেগে ছড়াচ্ছে, যাকে বাগে পাচ্ছে আইসিইউ অবদি টেনে নিয়ে মেরে ফেলছে! মরার পর কেউ ছুতে পারছে না। দেখতে পারছে না। মরার বুকে আছরে পরে কাঁদতে পারছে না। জানাজায় লোক হচ্ছে না, ফিউনারেল হচ্ছে না। দাফন হচ্ছে না। সরাসরি ক্রিমেশনে পুড়িয়ে ফেলছে!
সেই স্পেনে গত ছয়দিন হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রাস্তায় সেনা ও পুলিশ ঘুরছে। আপনি কেবল তিন কাজের জন্য সেখানে বের হতে পারবেন!
১. খাদ্য কেনা
২. ওষুধ কেনা এবং
৩. গ্রেফতার হওয়ার শখ হলে।
যদি কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম না মানেন তবে জরিমানা গুনবেন ২০০ ইউরো। খোলা আছে শুধু ব্যাংক, মুদি দোকান আর ফার্মেসি। বাকিরা সিল গালা তালা। দূর পাল্লার বাস ট্রেন ৭৫ ভাগ বন্ধ করা হয়েছে। শহরের সিটি সার্ভিস ৫০ ভাগ কমানো হয়েছে। যেখানেই যাবেন যুক্তি দেখাতে হবে। কেন কিসের তাড়া! এই হলো কোয়ারেন্টাইন। সকল সরকারি তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক নেয়া হয়েছে সরকারের আওতায়। সব নিয়ন্ত্রণ সরকারের। সকল ইন্টার্ন এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যে কোনো ডিসিপ্লিনের চিকিৎসক হলেই প্রস্তুত করা হচ্ছে করোনা সৈনিক হিসেবে! শেষ বর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের যুক্ত করা হচ্ছে চিকিৎসক কাতারে! এরপর যুদ্ধ চলছে। হাসপাতালে হাসপাতালে। তবুও কমছে না মৃত্যু মিছিল। হাত কামড়াচ্ছে সরকার, দুয়ো দিচ্ছে একে অন্যকে! আহা! আর একটা সপ্তাহ! আর দিন দশেক আগেও যদি সবাইকে খেদিয়ে ঘরে ঢুকাতাম, তো এই দাবানল রুখে দেয়া যেত! যেমন, চায়না রুখেছে, সাউথ কোরিয়া, সিংগাপুর রুখেছে।
বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থাগুলোতে ইতোমধ্যে প্রবেশ সীমাবদ্ধ করে দিয়ছেন সেদেশগুলোর কর্তাব্যক্তিরাই। সৌদির হারাম শরীফে ও মসজিদে নববীতে কোলাহলপূর্ণ এলাকাগুলোতে এখন সুনশান নিরবতা। সহজে মিলছে না মানুষের দেখা। বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে কর্মকর্তাদের বাসায় বসে কাজ করার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। ২৫ জনের বেশি কোথাও সাধারণের সমবেত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও মানছেন না কেউ। ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা কমাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ ব্যাপারে আমাদের হাসপাতালগুলোকে সরকারের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবাসিক এলাকাগুলো/স্থানসমূহে যেমন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের আবাসিক হলগুলো খালি করে করেন্টাইন সেন্টার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ভালো থাকুক, সেটা কে না চায়! তবে বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে নিজের দেশের কথা চিন্তা করে নিজেদের খুব অসহায় লাগছে! করোনা ভাইরাস! যাকে বেঁচে থাকার জন্য একটা মাধ্যম লাগে। শুধু ১৫ দিন সব কিছু কমপ্লিট শাট ডাউন এর মাধ্যমে আমরা যদি এর ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে পারি তাহলে খুব সহজেই লাখ লাখ প্রাণ হানি থেকে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে। কতই না সহজ পদ্ধতি, কিন্তু প্রয়োগ করা আসলেই কষ্টকর? বীর বাঙালিরে কেউ কখনো দাবায়ে রাখতে পারেনি, আর এখনো পারবে না বলেই বিশ্বাস করি।
লেখক: বিল্লাল বিন কাশেম, কবি, সাংবাদিক ও গল্পকার
বিবার্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]