শিরোনাম
নূরে আলম সিদ্দিকী’র অগ্নিঝরা মার্চ নিয়ে জাসদ ধান ভানতে শিবের গীত: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২০, ১৭:০৫
নূরে আলম সিদ্দিকী’র অগ্নিঝরা মার্চ নিয়ে জাসদ ধান ভানতে শিবের গীত: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
সাজ্জাদ হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+

গত ৪ মার্চ ২০২০ একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক অগ্নিঝরা মার্চ নিয়ে লিখতে গিয়ে জনাব নূর আলম সিদ্দিকী কোনো কারণ ছাড়াই তার স্বভাবসুলভ ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ ও জাসদ বিরোধীতার বিদ্বেষের প্রকাশ করতে গিয়ে জাসদ বিরোধী ধান ভানতে শীবের গীতের মতো প্রলাপ বকেছেন। জনাব নূর আলম সিদ্দিকী তার বক্তব্যে ৭০ এর নির্বাচনের পূর্বে ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা- ইয়াহিয়ার দালাল তারা’, ‘মুক্তির একই পথ-সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’ ইত্যাদি শ্লোগানকে তৎকালীন ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশের শ্লোগান হিসাবে চাপিয়ে দিয়ে স্বাধীনতাপন্থীদের ৭০ এর নির্বাচন বিরোধী অতিবিপ্লবী হটকারী হিসাবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস পেয়েছেন। ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ ও ‘জাসদ’ এর বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষ তাকে এতটাই উন্মাদ করে রেখেছে যে, তৎকালীন চীনপন্থী হিসাবে পরিচিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশ ও চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন অংশের দেয়া শ্লোগানগুলোকে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থীদের শ্লোগান বলে চালিয়ে দিতে ডাহা অসত্য বলতে তার সামান্যতম বাধেনি।


ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী তথা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ পন্থীদের ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করার কোনো প্রশ্ন কখনই আসেনি। বরং ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী এবং নিউক্লিয়াসপন্থী অংশের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিতভাবে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের এ অংশই ১৯৭০ সালে নির্বাচনে গ্রামে গ্রামে মাটি কামড়ে পরে পরে থেকে বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-নৌকার পক্ষে গণরায় অর্জণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।


ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশ তথা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’পন্থীরা জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে স্বাধীকার সংগ্রাম, স্বাধীকার সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধের পথে পরিচালিত করতে অগ্রসর ও মূলচালিকা শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিল। এ কাজগুলোর কোনোটিতেই বঙ্গবন্ধু বিরোধীতার প্রশ্নই অবান্তর। বরং সব কিছুতেই অনুমোদন-সমর্থন দিয়ে বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। ৬৯ সালে জয় বাংলা শ্লোগান চালু করা, শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া, ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ১৯৭১ সালের মার্চে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের সদস্যদের প্রকাশ্য সামরিক প্রশিক্ষণ ও মার্চপাস্ট, ২৩ মার্চ সামরিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকহানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথেই ঢাকাসহ সারা দেশে প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধকে একটি রাজনৈতিক জনযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদী জনযুদ্ধের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনী গড়ে তোলা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশ তথা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াসের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।


জনাব নূর আলম সিদ্দিকী ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি হিসেবে এ সকল ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ ঘটনায় কোথাও কোথাও উপস্থিত থাকতে বাধ্য হলেও তার যে স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রলীগের আপোসহীন বিপ্লবী অংশের ভূমিকার প্রতি কখনই সমর্থন ছিল না তা তৎকালেও সকলের সামনে প্রকাশিতই ছিল। ৬৯ সালে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন জয় বাংলা শ্লোগান দিতেন, তখন জনাব নূর আলম সিদ্দিকী বহু চেষ্টা করেও জয় বাংলা শ্লোগান দেয়া বন্ধ করতে পারেনি। ৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগানও জনাব নুর আলম সিদ্দিকী বাধা দিয়েও আটকাতে পারেননি। ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের স্বাধীনতার পক্ষে জোয়ার তোলায় তার মনে যে হীনমন্যতা তৈরি হয়েছিল তা আজও ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ ও ‘জাসদ’ বিদ্বেষ হিসেবে প্রকাশ পায়।


মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টরে গণবাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ তখন জনাব নূর আলম সিদ্দিকীর ভূমিকা কি ছিল অথবা তিনি কোলকাতায় কেমন বিলাসী জীবন কাটাতেন সেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এ লেখায় নাইবা উল্লেখ করলাম। তবে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর জনাব নূর আলম সিদ্দিকী তার কয়েকজন সশস্ত্র অনুসারী নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক ভবনে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে বঙ্গবন্ধু উপাধিটি ব্যবহার না করার জন্য হুমকি দিয়েছিলেন। খুনী খন্দকার মোশতাকের সাথে হাতও মিলিয়ে ছিলেন। মোশতাক পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়ার সাথেও হাত মিলিয়ে ছিলেন। এখানেই শেষ নয়- ১৯৭৬ সালে জিয়ার প্রবর্তিত কুখ্যাত পিপিআর(রাজনৈতিক দলবিধি-১৯৭৬) এর অধীনে মূলধারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যেন রাজনীতি করার সুযোগ না পায় তার জন্য মিজান চৌধুরীকে সভাপতি করে আওয়ামী লীগ (মিজান) গঠনের পিছনে মূল হোতাও ছিলেন জনাব নূর আলম সিদ্দিকী।


জিয়ার শাসনের পরবর্তীতে সামরিক শাসক এরশাদের সাথে হাত মিলিয়ে ডলার-পাউন্ডের ব্যবসায় এবং গুলশানসহ অভিজাত এলাকায় স্বনামে-বেনামে প্লট নিয়ে প্লট বাণিজ্য করে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক বনেছেন। সেই ইতিহাস আড়াল করা অন্যায় হবে।


১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর যারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন করেছেন তারা ৬০ দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম-স্বাধীকার সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। আদর্শিক প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিরোধ থেকে জাসদের প্রতিষ্ঠাতারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু খন্দকার মোশতাক-তাহের উদ্দিন ঠাকুর-নূরে আলম সিদ্দিকীরা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করেছিলেন।


জাসদ রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-নির্যাতনে দূর্বল হয়েছে। আবার জাসদের প্রতিষ্ঠাতা নেতাকর্মীরা অনেকেই দলও ত্যাগ করেছেন। এ সবের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে নিউক্লিয়াসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানে সামান্যতম স্থান হয় না।


জনাব নূর আলম সিদ্দিকী, জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমদের অল্প বয়সের কথা বলে তার নিউক্লিয়াসের সদস্য হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে যে তাচ্ছিল্য করেছেন সেটাও জনাব সিদ্দিকীর হীনমন্যতা ও মনোবৈকল্যেরই বহিঃপ্রকাশ। জনাব নূর আলম সিদ্দিকীর বিদ্বেষ ও হীনমন্যতা থেকে ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করে প্রলাপ বকা, ইতিহাসকে সঠিক ও সত্য করে চলা থেকে বিরত করতে পারেনি, পারবেও না।


লেখক পরিচিতিঃ সাজ্জাদ হোসেন, দফতর সম্পাদক, জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি।


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com