
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় বিএনপির সাবেক সভাপতি এহসান এ খানের মায়ের জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে একই দলের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-১৩) সরওয়ার জামাল নিজাম। এতে মুহূর্তের মধ্যে দলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে একজন সাংবাদিকসহ ছয় জন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) সকাল ১১টার দিকে কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ডাকপাড়ায় জানাজা শেষে এই সংঘর্ষ ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানায়, সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজামের উপর দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিনের অনুসারী কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়ার নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে দলে তাঁদের নেতৃত্ব নিয়ে উত্তেজনা চলছিলো, যার ফলস্বরূপ এ সংঘর্ষ বাধে। যদিও এসএম মামুন মিয়া তা অস্বীকার করেন।
ঘটনার পর, সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মামুন গ্রুপের কর্মী আতাউল্লাহ গুরুতর আহত হন এবং সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম গ্রুপের দুইজনও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বলে জানা গেছে। ঘটনার সময় ছবি তুলতে গেলে দৈনিক আজাদীর কর্ণফুলী প্রতিনিধি সাংবাদিক মহি উদ্দিনের ওপর হামলা চালায় মামুন গ্রুপের লোকজন, যাদের মধ্যে জুয়েল নামে এক যুবক সাংবাদিক কে মারধর করে এবং তার মোবাইল কেড়ে নেন। পরে কর্ণফুলী যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম এগিয়ে এসে সাংবাদিককে রক্ষা করেন বলে জানা গেছে।
অনেকেই জানান, ঘটনার সূত্রপাত জানাজার আগেই ঘটে। সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজাম শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এহসান এ খানের বাড়িতে একটি ব্যানার টাঙান। কিছুক্ষণ পর, কর্ণফুলী ছাত্রদলের আহ্বায়ক প্রত্যাশী মিশু ও যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীমের নেতৃত্বে একদল যুবক সাবেক এমপির ব্যানারটি ছিঁড়ে পুকুরে ফেলে দেন। স্থানীয়রা আরো জানান, মিশু ও শামীম এস এম মামুন মিয়ার অনুসারী। এর আগেও মিশু নামের ওই যুবক বিএনপির বিভাগীয় সম্মেলনে মইজ্জ্যারটেক আবাসিক মাঠে সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজামকে অপদস্ত করার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
অপর একটি সূত্রে জানায়, জানাজার নামাজ শুরুর মুহূর্তে আনুমানিক দেড় শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজাম মাঠে প্রবেশ করেন। নামাজ শুরু হওয়ার পর, তার অনুসারীরা তাকে সামনের কাতারে দাঁড়ানোর জন্য জোর করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
তবে এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও কর্ণফুলীতে সম্প্রতি দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলহাজ্ব আলী আব্বাস ও কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়া গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে। দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা একে অপরকে ঘায়েল করতে মাঠে তৎপর। এ ঘটনায়ও নানা জনে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে মরিয়া বলে প্রচার রয়েছে। বড়উঠান ইউনিয়নের ডাকপাড়া এলাকার সাধারণ লোকজন জানায়, জানাজার নামাজে যে কেউ আসতে পারে। মানবিক কাজ এটি। তাই বলে জানাজায় আসলে কাউকে হামলা চালানো ঠিক হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক বিএনপি নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সাবেক এমপি সরওয়ার জামাল নিজাম জানাজা শেষে তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের নিয়ে দ্রুত রাস্তায় থাকা গাড়িতে উঠতে গেলে, মামুন গ্রুপের লোকজন পিছন থেকে হামলা চালায়। যদিও সাবেক এমপি দ্রুত গাড়িতে উঠে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন, তিনি কোন ধরনের আঘাত পাননি। তবে তার অনুসারি কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় কর্ণফুলী-আনোয়ারা সড়কে চাতরীর উত্তর পাশের এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দুই গ্রুপ একে অপরকে লক্ষ্য করে ঢিল, ইট ও পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এতে পথচারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং পরিস্থিতি চরম উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি। তবে ঘটনার পরপরই বিএনপির নেতাকর্মী এবং কর্ণফুলী থানার ওসি আহত সাংবাদিক মহি উদ্দিনের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
সাংবাদিক মহি উদ্দিন বলেন, 'আমি জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলাম। পরে দেখি দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ছবি তুলতে গেলে কর্ণফুলী বিএনপির নেতাকর্মীরা আমার উপর হামলা করে এবং মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এরপর বিষয়টি লক্ষ্য করে আমার এলাকার লোকজন এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা সরে যায়।'
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাজী মো. ওসমান বলেন, 'সাবেক এমপি নিজাম সাহেব জীপ গাড়িতে করে লোকজন নিয়ে এসেছিলো এবং তাদের গাড়িতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এ বিষয়ে ভিডিও ফুটেজে প্রমাণ মিলবে। তারা সংঘর্ষ বাধাতে আনোয়ারার লোকজন এখানে এনেছিলো। আর সাংবাদিক মহি উদ্দিনের বাসায় আমি গিয়েছি। বিষয়টি আমি দেখছি। জুয়েল নামে যে যুবক তার উপর হামলা করেছে তার খোঁজ খবর নিয়ে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।'
কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়া বলেন, 'আমরা জানাজার নামাজ শেষ করে মোনাজাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তবে ওই সময় সাবেক এমপি সাহেব হয়তো চলে গেছেন। পরবর্তীতে রাস্তায় কিছু হামলার ঘটনা ঘটে, যা আমি জানি না। কারণ আমরা তখন জানাজার মাঠে ছিলাম। পরে জানতে পারি যে, সাংবাদিককেও মারধর করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে খবর পেয়েছি, যুবদলের শামীম তার লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সাংবাদিক মহি উদ্দিনকে রক্ষা করেছেন।'
দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'আমরা জানাজার নামাজের মাঠেই ছিলাম এবং পরবর্তীতে ঘটনাটি জানতে পারি। যতটুকু জানি, নামাজ শেষে সাবেক এমপি নিজাম সাহেব গাড়িতে উঠতে যান। তখন কিছু নেতাকর্মীরা তাকে হামলা করেন। সাবেক এমপি নিজাম দীর্ঘদিন মাঠে উপস্থিত ছিলেন না এবং বিএনপির অনেক নেতাকর্মী মামলা হামলায় নির্যাতিত হলেও তাঁর কাছে কোনো সহায়তা পাননি। হঠাৎ তিনি জানাজায় এসে উপস্থিত হলে, কিছু নেতাকর্মী হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালিয়েছিল। আমরা জানাজার মাঠে ছিলাম, ঘটনা রাস্তায় ঘটে, তাই আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। তবে পরবর্তীতে হামলার কথা শুনেছি।'
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম বলেন, 'আমি জানাজার নামাজে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে যখন আমি আমার নেতাকর্মীদের নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ করে কিছু লোকজন পিছন থেকে হামলা করে। হামলাকারীরা ছিল মামুন গ্রুপ এবং লায়ন হেলাল গ্রুপের সদস্য। এ হামলায় আমার দুজন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তারা বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি।'
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ বলেন, 'আমরা ঘটনাটি জানার পর দ্রুত দুটি পুলিশের গাড়ি পাঠিয়েছিলাম। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আহত সাংবাদিকের বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেব।'
বিবার্তা/জাহেদ/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]