পাল্টাপাল্টি অভিযোগে গণঅধিকার পরিষদে ভাঙনের সুর
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৩, ২০:২৭
পাল্টাপাল্টি অভিযোগে গণঅধিকার পরিষদে ভাঙনের সুর
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

গণঅধিকার পরিষদ আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নুরুল হক নুর একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছেন। দলটির শীর্ষ এ দুই নেতার দ্বন্দ্বে যে কোনো সময় ভাঙতে পারে গণঅধিকার পরিষদ। একে অপরকে সরকারি এজেন্ট বলেও তারা আখ্যা দিচ্ছেন।


দলটির একটি সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই দলের কাউন্সিলের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে। সেখানে নেতাকর্মীরা সিদ্ধান্ত নেবেন কে দলে থাকবেন, কে থাকবেন না।


গণঅধিকার পরিষদের একটি সূত্রে জানা গেছে, রবিবার রাতে গুলশানে রেজা কিবরিয়ার বাসায় গণঅধিকার পরিষদের বৈঠক হয়। সেখানে রেজা কিবরিয়া কেন ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদের ইনসাফ কায়েম কমিটির অনুষ্ঠানে গেছেন তা জানতে চান নুর। তখন রেজা কিবরিয়া নুরুল হকের কাছে জানতে চান, গণঅধিকার পরিষদের নামে প্রবাস থেকে আসা টাকার হিসাব কোথায়? কেন তিনি ইসরায়েলি মেন্দি এন সাফাদি ও তার ‘বাংলাদেশি বন্ধু’ শিপন কুমার বসুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন? এসব নিয়ে বৈঠকের পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এসব বিষয় নিয়ে আবারও গণঅধিকার পরিষদের মিটিং ডাকা হয়েছে। যদিও এ বৈঠকে রেজা কিবরিয়া থাকবেন না। জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, নুর কিছুটা ঝামেলা করছেন। তবে সেটা ইনসাফ কায়েমে যাওয়া নিয়ে নয়। নুরের টাকার লেনদেন নিয়ে দলের নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। এটা এড়াতে তিনি ইনসাফে আমার যাওয়া নিয়ে হইচই করেছেন। নুরের বিরুদ্ধে দুই-তিনটা ইস্যু আছে, যেটা দলের নেতাকর্মীরা পছন্দ করেননি।


তিনি বলেন, এক হচ্ছে বিদেশ থেকে যে টাকা-পয়সা আসে সেটার কোনো হিসাব দিতে রাজি নন নুর। এখানে অনেক টাকা আসে। প্রবাসীদের কমিটিতে নিজেকে তিনি প্রধান উপদেষ্টা বানিয়েছেন। সেখানে দলের আর কাউকে রাখেননি। প্রবাসীদের পুরো টাকা তিনি নিজেই রাখেন। দ্বিতীয় হচ্ছে, দলের মধ্যে অসন্তোষ মেন্দি এন সাফাদি ও শিপন বসুর (যারা হিন্দু সমাজের নতুন রাষ্ট্র করতে চায় উত্তরবঙ্গে) সঙ্গে নুরের যোগাযোগটা কেন, সেটা কি আমাদের কোনো রাজনৈতিক সুবিধার জন্য, নাকি টাকা দিয়েছেন। তাকে টাকা দেয়ার বিষয়টা নিয়ে দলের অনেকেরই সন্দেহ আছে।


রেজা কিবরিয়ার অভিযোগ, দুবাইয়ে মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে মিটিং করতে নুর ট্যাক্সি দিয়ে যাননি। তাকে আমাদের লোক (দুবাইয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা) গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তারাই আমাদের কনফার্ম করেছেন যে, এ রকম মিটিং হয়েছে এবং মিটিং শেষে তিনি (নুর) একটা কালো ব্যাগ নিয়ে ফিরেছেন। তবে কালো ব্যাগে কী ছিল সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশ্ন হলো, তুমি ইসরায়েলিদের সঙ্গে মিটিং করছ, এটার কারণ কী? কারণটা আমাদের বলো? তবে তিনি তা বলতে রাজি নন।


তিনি আরো বলেন, শিপন বসুর সঙ্গে বৈঠক করে তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী নিয়ে তারা পৃথক হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করেছেন। এটার পৃষ্ঠপোষক হলো মেন্দি এন সাফাদি। তিনি কেন সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন? কীসের লোভে আমাদের কাছে কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। তখন তিনি এটাকে এড়াতে গিয়ে আমার ইনসাফ কায়েমে যাওয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।


গণঅধিকার পরিষদ আহ্বায়ক বলেন, আমার কথা খুব পরিষ্কার, সরকারবিরোধী মিটিংয়ে আমি যাব। সরকারের বিরুদ্ধে যে দল মিটিং করুক এবং যদি দাওয়াত দেয় তাহলে আমি যাব। কোনো অসুবিধা নেই। আমি তো সরকারের পক্ষে কোনো কথা বলিনি। আমি সরকারের পক্ষে মিটিং করেছি এটা তো হাস্যকর। নুর বলছেন, আমি সরকারের এজেন্টদের পক্ষে কাজ করছি। আমার সন্দেহ তিনি সরকারি দলের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে দলে একটা ভাঙন তৈরি করার জন্য কাজ করছেন। আমি তাকে সন্দেহ করি। তিনি সরকারি এজেন্ট হতে পারেন! যদি আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তবে একদিন প্রমাণ পাব, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন আমি সব খবর পেয়ে যাব। মানুষের সামনে তা তুলে ধরতে পারব। আমার সন্দেহ সরকারি স্বার্থ রক্ষার জন্য দলে একটা ভাঙন তৈরি করার চেষ্টা করছেন নুর।


তিনি বলেন, সমস্যাগুলো হলো- প্রবাসীদের টাকা কোথায় যায়? ইসরায়েলিদের সঙ্গে কেন তিনি গোপন মিটিং করলেন? ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে তার কী আলোচনা হয়েছে? সেগুলো তো আমরা জানি না। এসব জানাতে চাওয়া হলে, কোনো উত্তর নুর দিতে পারেননি। তখন তিনি উল্টো আমাকেই চার্জ করেছেন যে, ইনসাফ কায়েমের মিটিংয়ে গেছি, এটা বিএনপি বিরোধী গ্রুপ। তখন আমি বলেছি, আমি তো বিএনপির এজেন্ট না। বিএনপির সদস্যও না, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে কোনো কিছু স্বাক্ষরও করিনি। আর ইনসাফ কায়েম কমিটিতেও আমি নেই। অতিথি হিসেবে সেখানে গেছি। সরকারবিরোধী যে কোনো চক্রে আমি থাকব। কারণ আমি চাই, এ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হোক। এ ব্যাপারে কারও কাছে জবাবদিহি করা বা কারও হুকুমে আমি চলি না। নুর আমাকে হুকুম দেবে, এভাবে তো চলবে না। আমাকে নিয়ে যে ধরনের প্রশ্ন করেছেন, সেটা খুবই বাজে এবং অসম্মানজনক বক্তব্য। এ ধরনের লোকের সঙ্গে আমি কাজ করতে চাই না। যদি অসৎ লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয় তাহলে আমি তো আওয়ামী লীগে থাকতাম। সেখানে ভালো স্থানে থাকতাম।


তাহলে কি আপনি গণঅধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রেজা কিরবিয়া বলেন, আমি পার্টির সঙ্গে থাকব। তারা যদি বের করতে চেষ্টা করে তাহলে করুক। এটি ছাড়ার কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা দলের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোক আমার পক্ষে। নুরের এ ঘটনায় একটা ছোট গ্রুপ জড়িত। কারণ তারা টাকা-পয়সা সুযোগ-সুবিধা পান।


রেজা কিবরিয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে নুরুল হক নুর বলেন, ইনসাফ কায়েম কমিটি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না। তাদের ব্যানারে প্রোগ্রাম হয় সেখানে হাজার-হাজার লোক অংশ নেয়। এসব প্রোগ্রামের কারা অর্থ দেয়? কেন করে? আসলে তাদের কি সরকার পতনের সক্ষমতা আছে? তাদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো আছে?


তিনি আরও বলেন, ইনসাফ কমিটির অর্থায়নের বিষয়ে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, তার নাম মাসুদ করিম। যিনি আমেরিকাতে সিআইএ হেডকোয়ার্টারে কাজ করেন বলেও জানা গেছে। এই লোক বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পতনে কাজ করছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। এর আগে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে নেপাল, ব্যাংককে বৈঠক করেছেন বলেও শুনেছি। আমরা যখন জানতে পারলাম রেজা কিবরিয়া ২০১৯ সাল থেকে এর সঙ্গে জড়িত, তখন তাকে আমরা এখান থেকে বের করার চেষ্টা করেছি। কারণ এটা তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া তো সরকার পরিবর্তন হবে না। তিনি অনেকবার বলেছেন যে, এখান থেকে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।


নুর অভিযোগ করেন, আমরা শুনেছি রেজা সাহেব তাদের কাছে ব্ল্যাকমেইল হয়েছেন। যার কারণে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তাকে মাসে তিন লাখ টাকা দেয়া হয়। তিনি যেখানে দলের কোনো অনুষ্ঠানে আসেন না, সেখানে ইনসাফ কমিটির অনুষ্ঠানে কীভাবে যান?


রেজা কিবরিয়াকে অনেকবার রাজনীতিতে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে নুর বলেন, কিন্তু তারা একাডেমিশিয়ান লোক, রাজনীতিবিদ না। ড. কামাল হোসেনের ২৬ বছরের গণফোরাম ভেঙেছে তার কারণে। এই কারণে আমরা অলিখিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে অনেক দিন ধরে আহ্বায়ক কমিটি আছে। নতুন কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করব। সেই ক্ষেত্রে দলের অধিকাংশ লোক তাকে সমর্থন করবে না। সেই কারণে তিনি যেহেতু জানেন যে দল পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রণে, সবাই আমার কথা শোনে, তাই যে কোনো মানুষের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে বিতর্কিত করা যায়। সেই কারণে তিনি দলের কিছু লোকজনের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণঅধিকার পরিষদের একজন নেতা বলেন, রেজা কিবরিয়া এবং নুর দুজনই দলের শীর্ষ নেতা। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অবস্থা আছে কি? তাই দলের কাউন্সিল তারিখ দেয়া হবে। সেখানে বোঝা যাবে কে দলে থাকবেন।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com