শিরোনাম
নারী মুক্তিযোদ্ধা জোহরার খবর কেউ রাখে না
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৫
নারী মুক্তিযোদ্ধা জোহরার খবর কেউ রাখে না
নুরুল করিম আরমান, লামা
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে, আমার বয়স তখন ১৪ বছর। সব কিছু এখনো মনে পড়ে। হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারির গুলির শব্দে কেঁপে উঠে চট্টগামের হাটহাজারির আকাশ-বাতাস। সবাই দিক বেদিক ছুটাছুটি করলে, আমার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন ট্রেনিং নিতে ভারতে যান। তখন তিনি চট্টগ্রামের বিহারী কলোনী ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বাবা আবদুল আজিজ ও আমাকে হাটহাজারির একটি হাই স্কুলমাঠে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে রেখে যান।


আমি ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর রান্না করতাম, পানি গরম করে দিতাম, গুলিবিদ্ধ মুক্তি সেনাদের সেবাযত্ন করতাম। বাবা বাইরে ঘুরে ঘুরে পাকিস্তানি মিলিটারির গতিবিধির ওপর নজর রাখতেন; আর মুক্তিবাহিনীকে তথ্য দিতেন। যখন যুদ্ধের ভয়াবহরূপ ধারণ করলো, তখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মুক্তি সেনাদের পাহারায় রাতভর পায়ে হেঁটে কালুর ঘাট ব্রীজের দক্ষিণ পাড়ে; ভোরের আলো ফুটতেই আবার আমরা গাড়ি যোগে লোহাগাড়া উপজেলার ফকিরহাঠ গ্রামে যাই, পরে সেখান থেকে বাবাসহ বান্দরবানের লামা উপজেলার আজিজনগরের পূর্বচাম্বী আমতলী গ্রামে আশ্রয় নিই। ভারত থেকে অস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। মঙ্গলবার সকালে লামা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদেরকে এসব কথা বলেন, নারী সহ-মুক্তিযোদ্ধা জোহরা খাতুন।


জোহরা খাতুনের যাবতীয় ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ৬৭ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা কর্তৃক ইস্যুকৃত সনদ নং: খ/১২২৩১ ও একটি মুক্তিযোদ্ধা মহিলা কমান্ড পরিচয় পত্র- কার্ড নং- ৩২৪২৫। জাতীয় বীর আলহাজ্ব এমএ সামাদ সরকার (স্বাধীনতার সূর্য) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল এবং মুক্তিযোদ্ধা ছায়া প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ১ মার্চ ২০১০ সালে স্বাক্ষরিত সনদে উল্লেখ রয়েছে ‘মিসেস জোহরা খাতুন পূর্বচাম্বী আমতলীপাড়া, এমচর হাট, লামা, বান্দরবান একজন যুব কমান্ড সৈনিক। তাহার পিতা ও ভাই বাংলাদেশের ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাহার পরিবারের অবদান ছিল বিরল। মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরী যুব কমান্ড রাষ্ট্রীয় সকল দাবিদার হিসেবে চিহ্নিত হবেন’।


তিনি আরো জানান, ৭১’র রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করে ৪৫ বছরে কপালে একটি সনদ ছাড়া আর কিছুই জুটেনি। নারীর ক্ষমতায়ন কি ও নারীর উন্নয়নে সরকার কি কি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, এসবের কিছুই জানে না তিনি। পনের বছর আগে স্বামী মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রতি মাসে মাত্র চারশত টাকা করে বিধবা ভাতা পান তিনি। এ ভাতা দিয়েতো আর দিন কাটে না। তাই স্বামী ও নিজ নামীয় চার একর পাহাড়ি জমিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে কোনোমতে অনাহারে জীবিকা নির্বাহ করছেন মুক্তিবাহিনীর সহযোদ্ধা এই জোহরা খাতুন। চার ছেলে দুই মেয়ে, ছেলেদের মধ্যে তিনজন দিন মুজরী করে জীবন চালায়। ছোট ছেলে হাফিজুর রহমান (শান্ত) এসএসসি পরীক্ষার্থী, মেধাবী ছাত্র হয়েও উপবৃত্তি পাচ্ছে না। দুই মেয়ে বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছে, দৈন্যদশায় থাকা ছেলেরা ও জামাতাদের সহযোগিতায় বেঁচে আছেন এ নারী মুক্তিযোদ্ধা।


বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পূনর্বাসন সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মাধ্যমে একজন সহযোদ্ধা তথা মুক্তিযুদ্ধা উত্তরসূরী হিসেবে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারমতে বেঁচে থাকার জন্য সামান্যতম সুযোগ-সুবিধা দাবি করছেন মুক্তিযোদ্ধা জোহরা খাতুন।


তিনি সরকারের কাছে দাবি করে বলেন, সুযোগ-সুবিধার জন্য আমার স্বীকৃতি আর প্রয়োজন নেই। ‘অন্তত আমার ছোট ছেলেটির জীবনে যেন মুক্তিযোদ্ধা কৌটা নিশ্চিত হয়, আমি সে দাবি করছি সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে’।


এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার আবদুল আজিজ জানান, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হয়ে জোহরা খাতুন এখনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ বঞ্চিত থাকায় সংশ্লিষ্টরা লজ্জা পাওয়া উচিত। এ ব্যপারে তিনি স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকার প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেন।


বিবার্তা/আরমান/জেমি/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com