দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধনের অপেক্ষায়
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১০:০৮
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধনের অপেক্ষায়
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশে দিয়ে তৈরি হলো প্রথম টানেল। যার নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ, চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি। ২৮ অক্টোবর টানেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার মধ্যে দিয়ে টানেলের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সাথে যুক্ত করা ছাড়াও কক্সবাজারকে চট্রগ্রামের সাথে সংযুক্ত করবে।


বলছি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম যোগাযোগ পথের কথা। যার নামকরণ করা হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।



‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে টানেলের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। স্বপ্নের টানেল উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে আসায় চট্রগ্রামবাসী ও সংশ্লিষ্টরা উচ্ছ্বাসিত হয়ে এই উদ্দীপনাপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন।



খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তল ছুঁয়ে টানেল নির্মাণের মধ্য দিয়ে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে যে বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে- তা অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী উপজেলা আনোয়ারাবাসীর জন্য। টানেল চালু হলে শুধু আনোয়ারা নয় দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। আবার পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহণ প্রক্রিয়া সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।



বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।


বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস, কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলটি নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে। এটি পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট। টানেলের ভেতরে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার।



কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে টানেলের অবস্থান ১৫০ ফুট গভীরে। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। টানেলের প্রতিটি টিউবের প্রস্থ ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ১৬ ফুট। দুটি টিউবের মধ্যবর্তী ব্যবধান ১১ মিটার।



বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি যখন পাস করা হয়, তখন এই প্রকল্পের খরচ ছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত। পরে যথাসময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম দফা সংশোধন করে খরচ ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। মেয়াদ বেড়ে যায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। পরে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও শেষ মুহূর্তে নতুন কাজ যুক্ত হওয়ায় টানেল নির্মাণ প্রকল্পের খরচ দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হয় ৩১৫ কোটি টাকা। এছাড়া মেয়াদও বাড়ানো হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসেবে দুই শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে প্রকল্পের মেয়াদ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।


টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে চায়না কমিউনিকেশনস কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের জন্য দিতে হবে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা তার চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। ৫ টনের ট্রাক ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাক ৬০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রেইলর (চার এক্সেল) ১০০০ টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলরের জন্য ১ হাজার টাকার সাথে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা বাড়তি টোল দিতে হবে।



সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন (ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট) অনুযায়ী, টানেলের দুই টিউবের ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। এতে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে তিন থেকে চার মিনিট সময় লাগবে। প্রতিদিন ১৭ হাজার ২৬০টি এবং বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি। ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০৬৭ সালে।


সেতু কর্তৃপক্ষ জানান, টানেলের প্রথম উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) স্ক্যানার স্থাপনের বিষয় উল্লেখ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সংশোধিত ডিপিপিতে ৮টি স্ক্যানার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে প্রকল্পের মূল বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর পরিবর্তে টোল আহরণ ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড এই স্ক্যানারগুলো স্থাপন করছে। সরকারের পক্ষ থেকে সেই টাকা পরিশোধ করা হবে।


এদিকে পণ্যবাহী যানবাহনগুলো স্ক্যানার দিয়ে পরীক্ষা করা হলেও টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া কার, মাইক্রোবাস, বাসসহ এ ধরনের পরিবহনের জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। ইউভিএসএস দিয়ে ট্রাক, বাস, মাইক্রোবাস, কারসহ যানবাহনের নিচের অংশে ছবি তুলে বিস্ফোরক জাতীয় সরঞ্জাম আছে কি না, তা যাচাই করা যায়।



এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, টানেল নিয়ে মিথ্যা বা নেতিবাচক প্রচার হতে পারে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। মিথ্যা নেতিবাচক প্রচার চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।


প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিটের মধ্যেই টানেল পার হওয়া যাবে। কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। এ টানেল শুধু দুই পাড়কে সংযুক্ত করবে না, এর মাধ্যমে ওয়ান সিটি টু টাউনের ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছে।


তিনি বলেন, উদ্বোধনের প্রস্তুতি যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছে। আগামী ২৮ অক্টোবর টানেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।


এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহমান তরফদারের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও দেশের প্রথম নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হয়েছে এ টানেলটি। যার নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এখন উদ্বোধনের জন্য নানান কাজ চলমান আছে। টানেলটি প্রস্তুত করা হচ্ছে উদ্বোধনের জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করবেন।


তিনি বলেন, উদ্বোধনের পর কবে গাড়ি চলাচল করতে পারবে তা জানানো হবে। জনসাধারণের জন্য কবে উন্মুক্ত করা হবে তা একটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে সম্ভবত তা উদ্বোধনের পরের দিন বা তার পরের দিন হতে পারে।


কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুন রশীদ চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের শতভাগ কাজ শেষ, এটি পুরোপুরি ব্যবহার উপযোগী হয়ে গেছে। এখন আমরা উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন।


তিনি বলেন, টানেলের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে পারবে।


বিবার্তা/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com