এসএসসির ফলাফলে এবারও এগিয়ে মেয়েরা
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ২৩:৪১
এসএসসির ফলাফলে এবারও এগিয়ে মেয়েরা
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষাতে জিপিএ-৫ ও পাসের হারে ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে অবস্থান মেয়ে শিক্ষার্থীদের। উল্লেখ্য, বিগত বছরেও এগিয়ে ছিল তারা।


মেয়েদের এই সাফল্যের বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের নারী উন্নয়নমুখী নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে মেয়েদের এই সাফল্য ধরে রেখে ছেলে শিক্ষার্থীদেরও পিছিয়ে পড়ার কারণ বের করে সেই বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।


২৮ জুলাই, শুক্রবার সকাল ১১টা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। এরআগে এদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফলের উদ্বোধন করেন। প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, এবারের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছেলে ১০ লাখ ৯ হাজার ৮০৩ জন ও মেয়ে ১০ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৭ জন। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করেছেন ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। তাদের মধ্যে ছেলে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৪ জন ও মেয়ে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৬ জন। এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও মেয়েদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।


এদিকে চলতি বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। তাদের মধ্যে ছেলে ৮৪ হাজার ৯৬৪ জন ও মেয়ে ৯৮ হাজার ৬১৪ জন।


গত বছরও জিপিএ-৫ ও পাসের হারে এগিয়ে ছিল মেয়ে শিক্ষার্থীরা। ফলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সাফল্যের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরাও বলছেন, এই সাফল্য প্রশংসনীয় এবং একইসাথে খুবই ইতিবাচক দিক। আগামী দিনেও নারীদের এগিয়ে যেতে এই সাফল্যগুলো অনুপ্রেরণা জোগাবে। তবে বিশিষ্টজনেরা সতর্কও করেছেন এই বলে যে, সাফল্য ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। সেক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন থেকে সাফল্য পাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোতে কাজ করে যেতে হবে। এদিকে ছেলেদের বিষয়েও সজাগ ‍দৃষ্টি রাখার পরামর্শ তাদের।


এসএসসিতে মেয়েদের সাফল্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, এসএসসির ফলে মেয়েদের এভাবে এগিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় দিক। এখনো এই দেশের অনেক মেয়েরা নিপীড়িত,নিগৃহীত এবং নির্যাতিত। মেয়েদের এই অর্জন তাদেরও সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাছাড়া এখন শুধু এসএসসি পরীক্ষা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গায় মেয়েদের সাফল্য ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা খুবই শুভ লক্ষণ, শুভ সূচনা। তবে আমাদের অর্জনের এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে।


শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি সাধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক জোর দিয়েছেন। এমনকি নারী শিক্ষার উন্নয়নে তিনি উপবৃত্তিসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বাস্তবায়নও করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছেন। যার ফলে আজকের মেয়েরাও নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেদের সাফল্যের প্রমাণ দিয়েই চলেছে।


মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বর্তমানে অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে অনেক ছেলে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে। এদিকে মেয়েদের মধ্যে বাল্য বিবাহসহ নানা কারণেও এখন অবধি অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হচ্ছে। এই বিষয়গুলোর দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মোটকথা, মেয়েদের অর্জনের ধারা অব্যাহত রেখে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বিবার্তাকে বলেন, এসএসসির ফলে মেয়েরা জিপিএ ৫ ও পাসের হারে এগিয়ে যাওয়া খুবই ইতিবাচক দিক। আমি এই অর্জনের জন্য মেয়েদের অভিভাবক তথা পিতা-মাতাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। একইসাথে মেয়েদের এই অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অভিনন্দন জানাই। এটা এজন্য যে তিনি মেয়েদের এগিয়ে যেতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। উপবৃৃত্তি, শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা, মধ্যাহ্নভোজসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন। এছাড়া সরকারি বেসরকারি নানা কার্যক্রমও মেয়েদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। মোটকথা, সবকিছুর সামষ্টিক প্রতিফলন মেয়েদের এই অর্জন।


বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বিভাগে (সমাজবিজ্ঞান) একটা ডাটাবেজ করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখলাম বিভাগে ১ম ও ২য় বর্ষে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু আপেক্ষের বিষয় হলো এম এ ( মাস্টার্স) এ গিয়ে দেখা যায়- মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম অর্থাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে এখানে অংশগ্রহণ কমছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। মোটকথা, মেয়েদের সাফল্যের কাহিনীগুলোসহ ছিটকে পড়ার বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।


উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী কিছু সফলতা দৃশ্যমান। সবার জন্য বিনামূল্যের বইসহ শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অভিন্ন পাঠ্যসূচি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শিশুদের মধ্যে গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানোর তাগিদে ২০১০ সাল থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ সময়েই মাধ্যমিক শ্রেণিতে নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি চালু করা হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস এবং করোনাকালীন সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদান শিক্ষাক্ষেত্রে একটি কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচিত। মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি প্রদান এবং দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স সমমান প্রদান করে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে বর্তমান সরকার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।


তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগের এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ও ক্লাস শুরু এবং ফলাফল প্রকাশের অপরিকল্পিত সময়ের প্রক্রিয়াকে অনলাইনের আওতায় এনে রুটিনমাফিক সল্পসময়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে নতুন পর্যাপ্ত সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ফলশ্রুতিতে গবেষণায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা খাতের অগ্রগতির এরূপ মহাপরিকল্পনা শিক্ষিত জাতি গঠনে টেকসই ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে বলেই তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। মেয়েদের জন্য উপবৃত্তিসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে।


শিক্ষায় মেয়েদের এই সাফল্য ও সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বিবার্তাকে বলেন, দেখুন-মেয়েদের অর্জন তো হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু এতোদিন তারা সুযোগ-সুবিধা পায়নি, এজন্য পিছিয়ে ছিল। তবে একটা আক্ষেপের বিষয়- এখনো অনেকক্ষেত্রে মেয়েদের মেয়ে বা নারী হিসেবে চিন্তা করা হয়। এটা ঠিক না। এক্ষেত্রে আস্তে আস্তে এটারও পরিবর্তন হচ্ছে। আজকে শহরের ন্যায় গ্রামেও মেয়েদের চিন্তাভাবনা, চালচলনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক।


তিনি বলেন, আগে গ্রামের মানুষকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়া লাগত। কিন্তু যুগ বদলে গেছে। এখন গ্রামের মেয়েরাও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও কম নয়। নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে মেয়েদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। এখন গবেষণায়ও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। সামনেও আরও এগিয়ে যাবে। মোটকথা, মেয়েদের সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com