‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’; মঙ্গল শোভাযাত্রায় বর্ষবরণে প্রস্তুত চারুকলা
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ২১:৫৩
‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’; মঙ্গল শোভাযাত্রায় বর্ষবরণে প্রস্তুত চারুকলা
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। আর এই উৎসবের প্রাণভোমরা হয়ে উঠছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য, একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’র প্রবর্তন হয়। বছর ঘুরে এসেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব। রাত পোহালেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বরণ। এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্য ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। এই প্রতিপাদ্যের আলোকে সাজবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বাঙালির প্রাণের উৎসবের পোস্টারও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়েছে।


আয়োজকরা জানায়, মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্যটি যুদ্ধ নয়, শান্তির পৃথিবীর প্রত্যাশার বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পঙ্ক্তি থেকে নেওয়া হয়েছে। আর এটিকে সামনে রেখে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বরণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এবারের শোভাযাত্রার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন চারুকলার নতুন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও।


এরআগে প্রতিবারের মতো এবারও প্রায় ১৫ দিন আগে অর্থাৎ শুক্রবার, ৩১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিপর্বের উদ্বোধন করা হয়। এরপর যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই প্রস্তুতির কাজ জোরেশোরে চলছে।


১২ এপ্রিল, বুধবার সরেজমিনে চারুকলা অনুষদে দেখা যায় মহাকর্মযজ্ঞের প্রতিচ্ছবি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দম ফেলার সময় নেই। যে যার কাজে মহা ব্যস্ত। এতো কাজের মাঝেও তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার ঘাটতি নেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হৈ-হুল্লোড়, গল্প, আড্ডায়ও চলছে তাদের। ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির আগে সব ধরণের প্রস্তুতি শেষ করে ১৪ এপ্রিলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকবে চারুকলা, এমনটাই প্রত্যাশা আয়োজকদের।


মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ওম প্রকাশ বিবার্তাকে বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করছে। সেই আয়োজনের অংশ হিসেবে চারুকলা প্রাঙ্গণে চলছে শিল্পকর্ম তৈরি ও বিক্রয়। বরাবরের মতো পেইন্টিং, সরা, মুখোশ পাখি তো আছেই। সেইসাথে এবারের নতুন সংযোজন কাগজের ফুল, তালপাতার পাখা, রোদচশমার মতো রোজকার অনুষঙ্গ। এবারে ছয়টি কাঠামো নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্যান্য বারের তুলনায় উৎসবমুখর ও জমজমাট হবে। তাই, এ আয়োজনের অংশ হতে পেরে আমরা ২৪তম ব্যাচ গর্বিত।


এবারের প্রতিপাদ্যের বিষয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির আরেক আহ্বায়ক অচিন্ত্য সাহা রায় বিবার্তাকে বলেন, আমরা চাই পৃথিবীতে যুদ্ধ নয়, বৃষ্টির মতো শান্তি বর্ষিত হোক। এজন্য এই প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। তাছাড়া এই প্রতিপাদ্য অসাম্প্রদায়িক বার্তাও বহন করে।


এদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারও চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে আয়োজিত গত ৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল দুইদিনব্যাপী নকশা প্রণয়ন কর্মশালা শেষে এবারের পোস্টার চূড়ান্ত করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালায় সারাদেশ বাছাইকৃত ২০ জন শিল্পী উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সেখান তিনজনের চিত্রকর্ম বাছাই করা হয়। কর্মশালাটি পরিচালনা করেন শিল্পী তরুণ ঘোষ- যিনি মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি পোস্টারের নকশা প্রণয়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের সভাপতি আবুল বারক আলভীসহ বিশিষ্ট শিল্পীরা কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন।


এরআগে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার কর্মশালায় অংশ নিতে আগ্রহীদের ১২ চৈত্র ১৪২৯ (২৬ মার্চ ২০২৩) তারিখের মধ্যে http://[email protected] ই-মেইলে নিজেদের শিল্পকর্ম পাঠাতে বলা হয়।


বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪৩০ পোস্টারের জন্য একটি লে-আউট (২০*৩০ সে.মি. পরিমাপের) jpg নাম ও মোবাইল নম্বরসহ পাঠাতে হবে। জমাকৃত লে-আউটের ভিত্তিতে অনধিক ২০ জন এই কর্মশালায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পাবেন।


এই কর্মশালা থেকে একটি নকশাকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হবে আসন্ন পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারের জন্য। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সকল নকশার একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হবে এবং নকশাসমূহ মঙ্গল শোভাযাত্রার গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে।’


আয়োজক সূত্রে জানা যায়, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারের জন্য সারাদেশ থেকে অসংখ্যা ই-মেইল এসেছে। বিচারকমণ্ডলীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত কর্মশালার জন্য ২০ জনকে নির্বাচন করা হয়। দুইদিনব্যাপী কর্মশালার মাধ্যমে সেখান থেকে তিনজনকে চূড়ান্ত করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা প্রথম স্থান অর্জন করেন। ফলে তার চিত্রকর্মটি এবারের পোস্টারের জন্য নির্বাচিত হয়। কর্মশালায় ইমরান হাসান দ্বিতীয় ও নামিরা ফারজান তৃতীয় স্থান অর্জন করেন।


বর্ষবরণের অন্যতম অন্যতম আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রার নকশা প্রণয়ন বিজয়ীদের অভিনন্দনপত্রও দেওয়া হয়েছে। এ পত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক গ্রুপ ‘Mangal Shobhajatra’-তে প্রকাশ করা হয়েছে।


প্রথম স্থান অর্জনকারীকে নিয়ে পোস্টে লেখা হয়েছে-


অভিনন্দন পত্র


শিল্পী আয়েশা সিদ্দিকা,


শুভকামনা জানবেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পোস্টারের নকশা প্রণয়ন কর্মশালা ১৪২৯এ সাফল্যের সাথে আপনার অংশগ্রহণে ও পোস্টারের নকশা প্রণয়নের জন্য অভিনন্দন জানাই।


আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে- বিচারকবৃন্দ আপনার সৃজিত নকশাকে প্রথম সম্মানসূচক পদকে ভূষিত করেছেন।


আপনাকে অভিনন্দিত করে আগামীর আলোকিত শিল্পীজীবন ও সাফল্য কামনা করি।


আবুল বারক আলভী


সভাপতি


মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র


২৫ চৈত্র, ১৪২৯


প্রথম স্থান অর্জন করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় চূড়ান্ত পোস্টারে স্থান পাওয়ার বিষয়ে অনুুভূতি প্রকাশ করে শিল্পী আয়েশা সিদ্দিকা বিবার্তাকে বলেন, আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের প্রতি- আমার শিল্পকর্মকে সন্মানসূচক স্থান দেয়ার জন্য। আমি আজ সত্যিই অনেক আনন্দিত এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত হলাম।


মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল পোস্টার চূড়ান্তকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের সম্পাদক আমিনুল হাসান লিটু বিবার্তাকে বলেন, সারাদেশের শিল্পীদের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্পীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা আশা করি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি শিল্পীদের এই ভালোবাসা বরাবরের মতো অটুট থাকবে।


তিনি বলেন, কর্মশালায় আঁকা শিল্পীদের শিল্পকর্ম বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় প্রদর্শন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানসহ মান্যবর অতিথিগণ এই সময় উপস্থিত থাকবেন। তাছাড়া এই প্রদর্শনীতে বিজয়ী শিল্পীদেরও পরিচয় করানো হবে।


এ বিষয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্রের সভাপতি আবুল বারক আলভী বিবার্তাকে বলেন, নকশা প্রণয়ন কর্মশালায় সারাদেশ থেকে চিত্রশিল্পীরা এসে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করেছে। আর তাদের মধ্য থেকে নানা মাপকাঠির বিবেচনার একটা সিলেক্ট করা হয়েছে।


তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রায় নিজেদের পোস্টার নির্বাচিত হওয়া অনেক শিল্পীরই কাঙিক্ষত লক্ষ্য থাকে। কিন্তু এরপরেও প্রতিযোগিতা বলে কথা। অংশগ্রহণকারীদের সবাই যোগ্য। তারপরেও প্রতিযোগিতার নানা ক্র্যাইটেরিয়া বিবেচনা করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান ঠিক করা হয়েছে।


কর্মশালা পরিচালনাকারী শিল্পী তরুণ ঘোষ বিবার্তাকে বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে আমরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পোস্টার নির্বাচন করে থাকি। আর এর জন্য প্রথমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সারাদেশ থেকে চিত্র সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্তকরণের জন্য কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।


তিনি বলেন, সারাদেশ থেকে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছে। যেমন কেউ রাজশাহী থেকে, কেউ খুলনা, কেউ কুমিল্লা আবার কেউ ঢাকা থেকে এই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। আমরা তাদেরকে কর্মশালায় বিভিন্ন ডিজাইনের আদিম মোটিভগুলো দেখিয়েছি। এখানে আদিম বলতে অনেক পুরনো লোক সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে।


তিনি আরো বলেন, এই বিষয়গুলোর উপরে একটা স্লাইড শো করা হয়েছে। এরপর তাদের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, আমাদের যে মোটিভগুলো আছে সেখান থেকে পোস্টারের চিত্র তুলে ধরতে হবে। তারপর তারা নিজেদের পছন্দমতো মোটিভের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজগুলো করেছেন। যেমন- একটা পাখির সাথে উপরে পেইন্টিং দিয়ে নানা কারুকাজ করে একটা কাজ করা হয়। এটি প্রথম স্থান অর্জন করে। আর এই ডিজাইনটা আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারের জন্য সিলেক্ট করি।


এই শিল্পী বলেন, সারাদেশ থেকে অনেকে ইমেইলে তাদের চিত্র পাঠিয়েছে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে মূল কর্মশালায় ২০ জন অংশগ্রহণ করে ৷ আর সেখান থেকে মূল পোস্টার সিলেক্ট করা হয়। চারুকলার তত্ত্বাবধানে সবকিছু করা হয়েছে।


এই বিষয়ে নববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, প্রতি বছরই আমরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল পোস্টার চূড়ান্ত করি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাছাড়া এবার সারা বিশ্বের বিষয় মাথায় নিয়ে প্রতিপাদ্যও ঠিক করা হয়েছে। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। তাছাড়া মানুষের মাঝে হানাহানি, অস্থিতিশীলতাও বাড়ছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও চরম ধস নেমেছে। তাই আমাদের এবারের কামনা পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক। সেজন্যই এই প্রতিপাদ্য ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’।


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/নয়ন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com