কালা ডাক্তারের রোগী
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৮
কালা ডাক্তারের রোগী
সৌরভ হাছান হিমেল
প্রিন্ট অ-অ+

পুরান ঢাকার ডাক্তার আনোয়ার আফসারের বাসায় প্রতিদিনের মত আজকেও আড্ডা বসেছে। ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম, এম ডি, এল আর সি পি, এম আর সি এস মৃত্যুর লক্ষণ সম্বন্ধে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বললেন। চার—পাঁচ ঘণ্টা শ্বাস—রোধের পরেও আবার নিশ্বাস পড়ে, ফাঁসির পরেও কিছুক্ষণ হৃৎস্পন্দন চলতে থাকে। দুই হাত দুই পা কাটা গেলে এবং দেহের অর্ধেক রক্ত বেরিয়ে গেলেও মানুষ বাঁচতে পারে, ইত্যাদি। অতএব রাইগার মর্টিস না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ মরদেহ কুঁকড়ে আড়ষ্ট হয়ে না গেলে মৃত্যু নিয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলমের সহপাঠী সেনাবাহিনীর ডাক্তার কর্নেল আশরাফ আলী বললেন, জাহাঙ্গীর, তুমি বেশী কথা বলছো, আসল কথা হচ্ছে, শরীর থেকে মাথা আলাদা না হলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না যে রোগী মারা গিয়েছে।


ধোলাই খালের আজগর সওদাগরের কথা শোন নি? বুইড়া হাড়—কঞ্জুস, অগাধ টাকা, ছেলে আক্কাস হতাশ। একদিন বুড়োটা মুখ থুবড়ে পড়ল, নিশ্বাস বন্ধ হল, হার্টবিট থামলো,


শরীর ঠান্ডা। ডাক্তার বলল, আর ভাবনা নেই আক্কাস, তোমার বাবা মরেছেন। আক্কাস বাপকে গোসল করাতে যাবে অমনি বুইড়া উঠে বসল। হ্যাঁ… এসব কি?—বলেই মারলো ছেলের গালে এক চড়। সবাই ভূত ভেবে ভয়ে পালাল। বুইড়া গটগট করে বাড়ি ফিরে এসে ঘটককে ডেকে এনে বললে, আক্কাস কে ত্যাজ্য করলাম, আমার জন্যে একটা পাত্রী দেখ।


ডাক্তার আব্দুল মালেক কালা একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। তার বয়স এখন নব্বই কি একানব্বই, শরীর ভালই আছে, তবে কানে একটু কম শোনেন আর মাঝে


মাঝে খেয়ালে বেখেয়ালে আবোল—তাবোল বকেন। ইনি কোথায় ডাক্তারি শিখেছিলেন, কলকাতায় কি করাচি নাকি রেঙ্গুনে, তা কেউই জানে না। কেউ বলে, ইনি সেকেলে ভি এল এম এস। কেউ বলে ওসব কিছুই না, ইনি হচ্ছেন খাঁটি হ্যামার—ব্র্যাণ্ড, অর্থাৎ হাতুড়ে।


নিন্দুকরা যাই বলুক এককালে কালা ডাক্তারের অসংখ্য পেশেণ্ট ছিল, সাধারণ লোকজন তাকে খুব বড় সার্জন মনে করত। স্বাধীনতার কিছু বছর পর থেকে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে ইনি এখন ইবাদত বন্দেগিতে সময় কাটাচ্ছেন। সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করেন, আবার আড়ালে তাকে নিয়ে ঠাট্টাও করেন। হাসির শব্দে কালা ডাক্তারের ঘুম ভেঙে গেল। মিটমিট করে


তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা কি?


হরিশ ডাক্তার বললেন, আশরাফ বলছে, দেহ থেকে মাথা আলাদা না হলে মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। কালা ডাক্তার বললেন, এই আশরাফ বেটাটা মূর্খ। বিদেশ থেকে ফিরে এসে মনে করেছে ও সবজান্তা হয়ে গেছে। জীবন মৃত্যুর তুমি কতটুকু জান হে ছোকরা?


কর্নেল আশরাফ আলী ছোকরা নন, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। হাতজোড় তিনি করে বললেন, কিছুই জানি না সার আমি মজা করে বলেছিলাম।


— মজা ! মরা—বাঁচা নিয়ে মজা!


কালা ডাক্তার চিরকালই দুর্মুখো, তাঁর অত নাম ডাক হওয়ার এটাও একটা কারণ। লোকে মনে করত, রোগী আর তার আত্মীয়দের যে ডাক্তার বেপরোয়া ধমক দেয় সেই আসল ভালো ডাক্তার। বয়স বৃদ্ধির ফলে তাঁর মেজাজ আরও খিটখিটে হয়েছে, কিন্তু এখন তার কটুবাক্যে কেউ রাগ করে না। তাঁকে শান্ত করবার জন্য ডাক্তার নোমান এম বি বি এস বললেন, স্যার আজকের আড্ডায় আপনি কিছু বলুন। কালা ডাক্তার বললেন, “আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে কেন ? আমার তো এখন ডোটেজ, যাকে বলে ভীমরতি”।


ডাক্তার নোমান বললেন, “সাতাত্তর বৎসরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাতের নাম ভীমরথী।


মানে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞবান। আপনার কথা বিশ্বাস করব না—সে কি একটা কথা হল?”


কালা ডাক্তার বললেন “কিন্তু ওই কর্নেল আশরাফ? ও বিশ্বাস করবে?”


কর্নেল আশরাফ হাতজোড় করে বললেন, নিশ্চয় করব স্যার, যা বলবেন তাই মেনে নেব।


কালা ডাক্তার খুশি হয়ে বললেন, যদি শুনতে চাও তো শোনো। কিন্তু তোমরা হয়তো ভয়


পাবে।


কর্নেল আশরাফ বললেন, যদি ভূতুড়ে কাণ্ড না হয় তবে ভয় পাব কেন সার?


—না না, ভূতুড়ে নয়। কিন্তু যে কেস—হিস্টরি বলছি এতে শুধু সার্জারির ক্লাইম্যাক্স নয়


প্রেমের পরাকাষ্ঠা ও পাবে।


কর্নেল আশরাফ বললেন, “সার্জারি আর প্রেম, এর চাইতে ভাল কমবিনেশন হতেই পারে না। আপনি আরম্ভ করুন সার, আমরা শোনবার জন্য ছটফট করছি”।


কালা ডাক্তার বলতে লাগলেন — প্রায় ষাট বছর আগের কথা। তখন তোমাদের লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া না ফেনেস্থেসিয়া—এ সব খুব একটা রেওয়াজ হয় নি। কোথাও অপারেশন হলে


আয়োডোফর্মের ঘ্রাণে হাসপাতাল মাত হয়ে যেত। আমি তখন কেরানীগঞ্জে থাকতাম।


আমার বাড়ির কাছে এক তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষ থাকতেন, নাম মনা তান্ত্রিক, তিনি কামরূপ—কামাখ্যায় আর নেপালে বহুবছর সাধনা করেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে মনা ঠাকুর বলত। বয়স ষাট—পঁয়ষট্টি, লম্বা—চওড়া চেহারা, কালো রং, একমুখ দাড়ি—গোঁফ। আমি তাঁর কার্বংকল অপারেশন করেছিলাম। এক বান্ডিল নোট আমার হাতে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। হাত টেনে নিয়ে আমি বললাম, আপনার কাছে কি আমি ফী নিতে পারি! তিনি একটু হেসে বললেন, তুমি না নিলেও ও টাকা তোমার হয়ে গেছে। কথাটার মানে তখন বুঝতে পারি নি।


বাড়ি ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা ভূর্জপত্রের মোড়কে দশটা গিনি রয়েছে।


বুঝলাম মনা ঠাকুরের দান তাঁর অলৌকিক শক্তিতে আমার পকেটে চলে এসেছে। বছর খানিক পরে তিনি কেরানীগঞ্জ থেকে চলে গেলেন, তাঁর একজন বড়লোক ভক্ত ত্রিশালে একটি আশ্রম বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানেই গিয়ে থাকতেন। তবে ভক্তরা মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে যেত।


তার পর দু বছর তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, খবরও কিছু পাই নি। একদিন বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরে এসেছি, একটা হার্নিয়া, দুটো অ্যাপেনডিক্স, তিনটে টিউমার, চারটে টনসিল, আর গোটা পাঁচেক হাইড্রোসিল অপারেশন করে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছি।


খাওয়ার পর স্ত্রীকে বললাম, আমি বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘুমাব, খবরদার কেউ যেন নাডাকে। ঘণ্টা খানিক পরেই ঠেলা দিয়ে বউ বললেন, শুনছ, জরুরি চিঠি এসেছে। বললাম, ছিঁড়ে


ফেলে দাও। বউ বলল, মনা ঠাকুরের চিঠি।


তখনই রওনা হলাম। ব্যাগটা সঙ্গে নিলাম। কি রকম কেস কিছুই জানা নেই সেজন্য বিশেষ কোনও ওষুধপত্র নিতে পারলুম না। শীতকাল, ত্রিশাল পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মনা ঠাকুরের খুব নির্জন স্থান, কাছাকাছি লোকালয় নেই। গাড়ি থেকে নেমে আশ্রমের দুয়ার ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ঠাকুরের সঙ্গে দেখা। পরনে লাল গেরুয়া কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, হুঁকো হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, এস ডাক্তার। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। জিজ্ঞাসা করলাম পেশেণ্ট কে? কি হয়েছে? বললেন, ঘরের ভেতর আসো, দেখলেই বুঝবে। ঘরটি বেশ বড়, কিন্তু আলো কম, কোণে পিদিম জ্বলছে, তাতে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।


একটু পরে দৃষ্টি খুললে নজরে পড়ল—ঘরের এক পাশে একটা চৌকি, আরেক পাশে মেঝেতে একটা মাদুরের ওপর দুজন পাশাপাশি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে, একটা কম্বল দিয়ে


সমস্ত শরীর ঢাকা, শুধু মুখ দুটো বেরিয়ে আছে। একজন পুরুষ, জোয়ান বয়স, বোধ হয় পঁচিশ, মুখে দাড়ি গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আর একজন মেয়ে, বয়স আনন্দাজ বিশ, কালো কিন্তু সুশ্রী, ঝুঁটিবাঁধা খোঁপা।


জিজ্ঞাসা করল্ম, স্বামী—স্ত্রী?


মনা তান্ত্রিক উত্তর দিলেন, উঁহুঁ, প্রেমিক—প্রেমিকা।


—কি হয়েছে?


—নিজেই দেখ না।


স্টেথোস্কোপটি গলায় ঝুলিয়ে কম্বলটা আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেললাম। তার পরেই এক লাফে পিছনে ছিটকে পড়লাম। কম্বলের নীচে কিছু নেই, শুধু দুটো মাথা পাশাপাশি পড়ে আছে।


ভয়ও হলো রাগও হলো। মনা ঠাকুরকে বললাম, আমাকে এরকম ভয় দেখাবার মানে কি? এ তো ক্রিমিন্যাল কেস, যা করতে হয় পুলিশ করবে, আমার কিছু করবার নেই। কিন্তু আপনিও


বিপদে পড়বেন। তিনি শুধু একটু হাসলেন। তারপর দেখলুম, পুরুষ মাথাটা পিটপিট করে তাকিইয়ে বলছে, মরি নি ডাক্তার। মেয়ে—মাথাটা ডানে বাঁয়ে একটু নড়ে উঠল।


ডিসেকশন রুমে বিস্তর ডেড বডি দেখেছি, নানা রকম বীভৎস লাশ দেখেছি, কিন্তু এমন ভয়ংকর ব্যাপার কখনও দৃষ্টিগোচর হয় নি। আমি আঁতকে উঠে পড়ে যাচ্ছিলাম, ঠাকুর আমাকে ধরে বললেন, ডাক্তার, ভয় নেই, ভয় নেই, মাথা কাটা গেছে কিন্তু আমি এদের বাঁচিয়ে রেখেছি। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শুনেছ? তার প্রভাবে এরা এখনও বেঁচে আছে। সেই শীতে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, এদের দেহ কোথায় গেল?


—ওই যে, ওই কোণায় কম্বলের নিচে পাশাপাশি শুয়ে আছে।


ঠাকুর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই দেহ দুটোও বাঁচিয়ে রেখেছি, দেখ না তোমার স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে। স্টেথোস্কোপের দরকার হলো না। বুকে হাত দিয়ে দেখলাম হার্ট আর লাংস ঠিক চলছে, তবে একটু আস্তে। ঠাকুরকে বললাম, ধন্য আপনার সাধনা, বিজ্ঞানের মুখে আপনি জুতো মেরেছেন। কিন্তু এতই যদি পারেন তবে দেহ আর মাথা আলাদা রেখেছেন কেন? জুড়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।


ঠাকুর বললেন, তা আমার কাজ নয়। আমি মৃতসঞ্জীবনী জানি, কিন্তু খণ্ডযোজনী বিদ্যা আমার আয়ত্ত নয়। ও হল মুচী বা ডাক্তারের কাজ। মুচী আনা যাবে না, তাই তোমাকে ডেকেছি। তুমি দেহের সঙ্গে মাথা সেলাই করে দাও। আমি বললাম, বাইরের চামড়া সেলাই করলেই তো গলার হাড় আর নলী জুড়বে না। সার্কুলেশন রেস্পিরেশন এবং স্পাইন্যাল কর্ডের সঙ্গে ব্রেনের যোগ কি করে হবে? সেরিব্রেশন অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলবে কি করে?


—কেন চলবে না? দুই ভুরুর মধ্যে আজ্ঞাচক্র ঘুরছে, তাতেই পঞ্চেন্দ্রিয় আর মনের


ক্রিয়া চলছে। কাটা মাথা কথা বলছে তা তো তুমি শুনেছ। কোনও চিন্তা নেই, তুমি সেলাই করে ফেলো।


আমি বললাম, সেলাই—এর উপযুক্ত বাঁকা ছুঁচ আর সুতা তো আমার সঙ্গে নেই, আর


সেপসিস অর্থাৎ পঁচা বন্ধ করব কি করে?


— তোমাকে একটা গুনছুঁচ আর সুতলি দড়ি দিচ্ছি। পঁচবার ভয় নেই, সেলাই করে দাও।


— বড়ই ঝামেলায় পড়া গেল। আয়োজন কিছুই নেই, অ্যাসিস্ট্যান্ট নেই, নার্স নেই,


অপারেশন টেবিল নেই, আলো নেই, অথচ ঠাকুর আমাকে এমন সার্জারি করতে বলছেন, যা কস্মিন কালে কোথাও হয়


— আচ্ছা জাহাঙ্গীর, আজকাল বড় অপারেশনের আগে তোমরা নাকি অনেক রকম টেস্ট করাও?


— হ্যাঁ। ব্লাড—প্রেশার, ব্লাড—কাউণ্ট, ব্লাড—সুগার, এক্সরে, কার্ডিওগ্রাম প্রভৃতি রুটিন টেস্ট তো আছেই, তা ছাড়া নন—প্রোটিন নাইট্রোজেন, টোটাল হেভি হাইড্রোজেন, বডি—ফ্যাটের আয়োডিন—ভ্যালু, হাড়ের ইলাস্টিসিটি, দাঁতের রেডিও—অ্যাকটিভিটি, চামড়ার স্পেকট্রোগ্রাম—এসবও দেখা দরকার। অধিকন্তু রোগী আর তার আত্মীয়দের ইনটেলিজেন্স কোশণ্ট টেস্ট করালে খুব ভাল হয়। বড়লোক পেশেণ্ট হলে অন্তত বিশজন স্পেশ্যালিস্টের রিপোর্ট নেওয়া চাই। আর গরিব পেশেণ্টকে বলে দিই উঁচু দরের চিকিৎসা তোমার সাধ্য নয়, দাতব্য হোমিওপ্যাথিক খাও গিয়ে, না হইয় তাবিজ পরো।


কালা ডাক্তার বললেন, আমাদের আমলে অত সব ছিল না, জিহ্বা আর নাড়ি, থার্মোমিটার আর স্টেথোস্কোপ, এতেই যা করে। আর এই দুই পেশেণ্টের তো চূড়ান্ত অপারেশন মুন্ডুচ্ছেদ আগেই হয়ে গেছে, এখন টেষ্ট করা বৃথা। যাক, তারপর যা হয়েছিল শোন।


আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে মনা ঠাকুর আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, অত মাথা ঘামিও না ডাক্তার, শুধু সেলাই করে দাও, বাকিটুকু কুলকুণ্ডলিনী নিজেই করে নেবেন।


আমি বললুম, “ঠাকুর, দেহের সঙ্গে মাথা সেলাই করা সার্জনের কাজ নয়। কিন্তু এই দুজনের হিস্টরি তো বললেন না, এদের এমন দশা হল কি করে?”


ঠাকুর এই ইতিহাস বললেন।—মেয়েটার নাম লতা, ওর বাপ করিমুল্লা লতার বিয়ে ঠিক করেছে একই গ্রামের রইসে সঙ্গে। রইস লোকটা দুর্দান্ত, বদরাগী আর মাতাল। লতা তাকে বিয়ে করতে চায় নি, তার বাপ টাকার লোভে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছে। করিমুল্লা বজ্জাত হলেও আমাকে খুব ভক্তি করে, আমার অনেক ফরমাশও খাটে। সে লতার ওপর অকথ্য অত্যাচার করত, আমি ধমক দিয়েও কিছু করতে পারি নি। এ রকম ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে তাই হল। ওই যে পুরুষটার মুণ্ডু দেখছ, ওর নাম শুক্কুর।


—এই শুক্কুর ছোকরা গায় ভাল, তার জন্য নানা জায়গা থেকে ওর ডাক আসত। শুক্কুর


মাঝে মাঝে এই গ্রামে এলে লতার সঙ্গে দেখা করত, শেষটায় দুজনের প্রেম হল।


করিমুল্লা টের পেয়ে একদিন লতাকে বেদম মারলো, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না।


তারপর গতকাল রাত একটার সময় আমি ঘুমিয়ে আছি এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। উঠে দরজা খুলে দেখি, রাম—দা হাতে করিমুল্লা। আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,


সর্বনাশ করেছি ঠাকুর, এক কোপে দুটোকে সাবাড় করেছি, বাঁচান আমাকে। আগের দিন করিমুল্লা লতাকে বলেছিল, আমি ঢাকা যাচ্ছি, পাঁচ দিন পরে ফিরব, তুই সাবধানে থাকিস।


সব মিথ্যে কথা। রাতে চুপি চুপি বাড়িতে গেলো এবং আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখল লতা আর শুক্কুর বসে গল্প করছে। দেখেই রাম—দায়ের এক কোপে দুজন শেষ। তার পর ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে।


আমি তখনই করিমুল্লার সঙ্গে তার বাড়ি গেলাম। প্রথমেই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে লতা আর শুক্কুরের সূক্ষ্মশরীর আটকে ফেললাম। তার পর করিমুল্লাকে বললাম, তুই দেহ দুটো কাঁধে করে আশ্রমে নিয়ে চল, মাথা দুটো আমি নিয়ে যাচ্ছি। আশ্রমে এসে করিমুল্লা আমার উপদেশ মত দেহ এক জায়গায় আর মাথা আর এক জায়গায় শুইয়ে দিলে।


খণ্ডযোজনের আগে পর্যন্ত এই রকম তফাৎ রাখাই তন্ত্রোক্ত পদ্ধতি।


করিমুল্লা আবার আমার পায়ে পড়ে বললে, ঠাকুর, ফাঁসি হবে আমার, আমাকে বাঁচান। আমি বললাম, তুই এখনি বাড়ি গিয়ে সব রক্ত ধুয়ে সাফ করে ফেল, তোর দা পুকুরে ফেলে দিবি,


তারপর গায়েব হয় থাকবি। এক বছর পরে গ্রামে ফিরতে পারিস। করিমুল্লা বলল, পুলিশ টের পেলেই তদারক করতে আসবে, আপনাকেই আসামি বলে চালান দেবে। আমি বললাম, তোকে তা ভাবতে হবে না, যা বলেছি তাই কর। করিমুল্লা চলে গেল। এখন আর দেরি নয়, রাত আটটায় অশ্লেষা পড়বে, তার আগেই সেলাই করে ফেলো, নইলে জোড় লাগবে না।


সুই আর সুতা নিয়ে আমি সেলাই করতে যাচ্ছি, অগত্যা খণ্ডযোজনের জন্য প্রস্তুত হলাম।


অ্যানাস্থেটিক দরকার হল না, ঠাকুর মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অসাড় করে দিলেন।


কিন্তু ভোঁতা সুই আর খসখসে পাটের সুতা দিয়ে চামড়া ফোঁড়া গেল না। ঠাকুর বললেন, এই বাতি থেকে তেল নিয়ে সুই আর সুতোয় মাখিয়ে নাও। লুব্রিকেট করার পর কাজ সহজ হল, আধ ঘণ্টার মধ্যে মাথার সঙ্গে দেহ সেলাই করে ফেললুম। তার পর ঠাকুরকে বললাম, এখন এদের শরীরে কিছু তাজা রক্ত দেওয়া দরকার, অভাবে পাঁশ সিসি গ্লুকোজ—স্যালাইন। কিন্তু এই পাড়াগাঁয়ে যোগাড় হবে কি করে? যদি নেহাতই বেঁচে থাকে তবে এর পর কিছুদিন লিভার এক্সট্রাক্ট, ব্লডস পিল আর ভিগারোজেন খাওয়াতে হবে, নইলে গায়ে জোর পাবে না। ঠাকুর বললেন, ওসব চলবে না। এখন এরা ঘুমুবে। কাল সকালে জেগে উঠলে ঝোলা গুড়দিয়ে খানকতক রুটি খাবে। তার পর বেলা হলে লতা ভাত চড়িয়ে দেবে আর মরিচ বাটা দিয়ে চিংড়ি রাঁধবে। তাতেই হবে।


ঠাকুর আমায় বললেন,দেখ ডাক্তার, তোমার ফী কিছু দেব না, আজ তুমি যা দেখলে তারই দাম লাখ টাকা। কালই আমি ওদের ধর্ম মতেদের বিয়ে দেব, আমার আশ্রমেই এরা থাকবে।


আমি উত্তর দিলাম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার চোখ কান সার্থক হয়েছে, গা দিয়ে ঘাম ছুটছে, আগাপাস্তলা রোমাঞ্চিত হচ্ছে। আমি ধন্য হয়ে গেছি। এখন অনুমতি দিন, আমি বাড়ি ফিরে যাই দুডোজ ব্রোমাইড খেয়ে নার্ভ ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়ি। এই বলে সেই রাতেই কেরানীগঞ্জ ফিরে এলুম।


ডাক্তার হরিশ বললেন, “ফ্ল্যাবারগাস্টীং মিরাকল”।


কর্নেল আশরাফ বললেন, প্রেমের এমন পারফেক্ট পরিণাম সাহিত্যেও নেই, আর সিমবায়োসিসের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বায়োলজির বইয়েও পাওয়া যায় না। আচ্ছা স্যার, নায়ক—নায়িকার তো একটা মিল দিলেন, কিন্তু করিমুল্লার কি হল?


কালা ডাক্তার বললেন, শুনেছি, এক বছর পরে সে চুপি চুপি ঠাকুরের আশ্রমে এসেছিল, কিন্তু শুক্কুর আর করিমুল্লা দেখে ভূত—পেত্নী মনে করে তখনই ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে সে নিরুদ্দেশ।


—আহা, তার জন্য দুঃখ হয়, বেচারা খুন করেও মেয়েকে শায়েস্তা করতে পারল না। আচ্ছা তার পর আর কখনও আপনি পঞ্চী আর জটিরামকে দেখেছিলেন?


—দেখেছিলাম। দু—বছর পরে ঠাকুর চিঠি লিখলেন, লতা আর শুক্কুরের ছেলের জন্মদিন, তুমি অবশ্যই আসবে।


—কি দেখলেন গিয়ে?


—দেখলাম, ঠাকুর ঠিক আগের মতন গেরুয়া পরে দাঁড়িয়ে হুঁকো টানছেন, শুক্কুর তার মস্কিউলার হাতে কুড়াল নিয়ে কাঠ কেটে চেলা করছে, লতা ছেলেকে কোলে বসিয়ে আদর


করছে।


বিবার্তা/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com