
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় অজ্ঞাত তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাকিবুল ইসলাম জানান, গত শুক্রবার রাতেই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন।
এ ঘটনায় পুলিশের ১০ থেকে ১২ জন সদস্য আহত হয়েছেন । বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে।তবে আজ শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত এ মামলার আসামি হিসেবে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বলেছে আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. শরীফ আল রাজীব সাংবাদিকদের জানান, গতকাল বিক্ষুব্ধ জনতা নুরাল পাগলের দরবারে হামলা চালায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গেলে তাদের ওপরও হামলা হয় এবং গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে এবং আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও মরদেহ উত্তোলন করে মহাসড়কে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার পর বর্তমানে গোয়ালন্দে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও দরবার এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আজ সকালে পরিদর্শনকালে দেখা গেছে ধ্বংসস্তূপ দেখতে উৎসুক জনতার ভিড় করেছে।
শনিবার দুপুরে নুরুল হকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান করছে। ভেতরের সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়ির সবগুলো ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেসব আসবাবপত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, সেগুলোতেও আগুন লাগানো হয়েছে। খড়ের স্তূপ থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছিল।
আনসার ক্লাব মাঠের পাশের চা বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করা সত্ত্বেও জানান, শুক্রবার আনসার ক্লাব মাঠে সমাবেশে আসা কিছু মানুষের কাছে বাসের লাঠি ছিল। নেতাদের নির্দেশে তারা লাঠি জমা দেয়। ঠিক সেই সময়ে ৫০-৬০ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্র, হাতুড়ি, লোহার রড, শাবল নিয়ে হাজির হয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিতে চাইলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং রেললাইনের পাথর ছুঁড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ সরে গেলে তারা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে এবং নুরুল হকের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।
নুরুল হকের প্রতিবেশীরা জানান, উত্তেজিত জনতা তিন ভাগে ভাগ হয়ে তার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। একদল ইটপাটকেল ছোঁড়ে, অন্যদল বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির ভেতরে থাকা ১৫-২০ জন ভক্ত এবং কাজের মহিলা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তাদের মারধর করে আহত করা হয়। হামলাকারীরা ঘরের আসবাব ও মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়, যা নিতে পারেনি তা পুড়িয়ে ফেলে। ওই এলাকার বাসিন্দারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে রাতভর লুটপাট চলে নুরুল হকের বাড়িতে।
স্থানীয় বাসিন্দা সৌরভ শেখ বলেন, “একজন মানুষ মারা গেলে তার আর কী থাকে। তার লাশ নিয়ে যা করা হয়েছে, তা কোনো ধর্মেই পড়ে না।
এ ঘটনার বিষয়ে গোয়ালন্দ পৌর বিএনপি সভাপতি ও ইমান আকিদা রক্ষাকারী কমিটির সদস্য আবুল কাশেম মন্ডল বলেন, “নুরুল হকের কবর দেয়াকে কেন্দ্র করে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। আমরা সমাবেশে আসা মানুষকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পুলিশ সমাবেশে আসা লোকজনকে আটকে দিলে তারা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এরপর একদল নুরুল হকের বাড়িতে হামলা চালায়।
"ঘটনাটি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক"- দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, "বিএনপি এ ধরনের ঘটনা প্রত্যাশা করে না। আমরা চাই, যারা বাইরে থেকে এসে এই হামলা চালিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক।”
অন্যদিকে রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বলেন, “সকালবেলা আমি গোয়ালন্দে গিয়ে দেখেছি, নুরুল হকের কবর মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছে। আমি আমাদের নেতাকর্মী ও ইমান আকিদা রক্ষাকারী কমিটির সদস্যদের বলেছিলাম যেন কোনো সমস্যা না হয়। পরে বিকেলে শুনি উত্তেজিত জনতা নুরুল হকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লাশ তুলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের দলের কেউ জড়িত নয়।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২৩ আগস্ট বার্ধক্যের কারণে মারা যান নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা। ওই দিন রাতে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় আস্তানায় তাঁর লাশ দাফন করেন ভক্তরা। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কবর সমতল করারসহ কয়েকটি দাবি জানায় স্থানীয় আলেমসহ তৌহিদি জনতা।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ও নুরাল পাগলার পরিবারের কয়েক দফা বৈঠক হয়। তবে কবর নিচু না করায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বেলা তিনটার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্যসচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান সবাইকে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এসময় ভক্তদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়। পরে উত্তেজিত জনতা নুরাল পাগলের মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে পুড়িয়ে দেয়।
বিবার্তা/মিঠুন/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]