মাস্টার
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৩, ১২:২১
মাস্টার
ডাবলু লস্কার
প্রিন্ট অ-অ+

চারিদিকে হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, হুলস্থুল দৌড়াদৌড়ি। সন্ধ্যা তখন তার মা গৌরিপ্রিয়া দেবীর সাথে বসে ভাত খাচ্ছে। হৈ-হুল্লোড় শুনে সন্ধ্যা খাওয়া বাদ দিয়ে কান পেতে থাকে কি হচ্ছে বোঝার জন্য।


এর মধ্যে রাঙা কাকি হাপাতে হাপাতে এসে বলে, " হারান বৈদ্যর ছেলে চিন্টুরে কারেন্টে ধরিছে।"


এই কথা শুনে সবাই রাঙা কাকির সাথে দৌড়ে তিন রাস্তার মোড়ে ফকিরদের জামতলায় চলে আসে। এসে দেখে বিশাল জটলা। বিশাল জাম গাছের উপরে মগডালে চিন্টু জাম গাছের বড় ডাল আঁকড়ে ধরে আছে আর বাঁচাও আমারে বলে চেঁচাচ্ছে।


কিন্তু কেউই আগাতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ জাম গাছের একটা ডাল মাঝে মাঝে বাতাসে হেলে পাশের কারেন্টের লাইনে স্পর্শ করছে আর তখনই কারেন্টের ঝাঁকি অনুভব করছে চিন্টু। এ অবস্থায় ছোট মানুষ অনেক ভয় পেয়ে গাছ থেকে আর নামতে পারছে না।


পাশ থেকে সবাই চিৎকার করছে নেমে আসার জন্য কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না। এর মধ্যে ভিড় ঠেলে কেউ যেন তরতর করে গাছে উঠে যায়। পাশ থেকে একজন বলে, " মাস্টার বিপদ হবে নেমে এসো। "


কিন্তু কে শোনে কার কথা কয়েক বার মৃদু ঝাটকা খেয়ে ঠিকই নামিয়ে আনে চিন্টুকে গাছ থেকে।


এর মধ্যে কারন্টের শক খেয়ে দুজনেরই অবস্থা কিছুটা খারাপ।


সন্ধ্যা অবাক হয়ে ভাবে কী সাহস এই মাস্টার নামের মানুষটার। কোন ভয়ডর কিচ্ছু নেই।


সন্ধ্যা বাড়িতে এসেছে এই দু-তিন দিন। এসেই সে গ্রামের সবার কাছ থেকে শুধু একটি নামই শুনছে মাস্টার।


যশোরের ভবদহ বিলের সাথেই মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা সন্ধ্যারা। তার বাবাকে সবাই মহাজন বলে ডাকে। মহাজন একাই নিয়ন্ত্রণ করে এত বড় বিলের ঘেরের ব্যাবসা। সবাই প্রচণ্ড ভয় পায় মহাজনকে। বাড়িতে অনেকগুলো কাজের লোক। তবে মহাজনের সব থেকে বিশ্বস্ত কাজের লোক ফনী। গত ছয় মাস আগে ভবদহের পাশ থেকে হাত পা বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মাস্টারকে।
কে বা কারা প্রচণ্ড মারধর করে ফেলে রেখে যায় তাকে। পাশের গ্রামের নরেন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলে মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে স্মৃতি শক্তি গেছে।


এ কারণে কেউই তার পরিচয় জানতে পারেনি। তবে কিছুদিন না যেতেই প্রচুর কাজ করতে থাকে সে মহাজনের বাড়িতে। মহাজন প্রথম প্রথম এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুককে নিয়ে বিরক্তিতে থাকলেও এখন তার কাজে অনেক খুশি। মহাজন ফ্রিতে এমন একজন কাজের লোক পাবে ভাবতেই পারেনি! কিছু দিন পরে লোকজন দেখে এই আগন্তুক ছোট ছোট বাচ্চাদের ছড়া শেখাচ্ছে। সেখান থেকেই লোকজন তাকে মাস্টার নামে ডাকা শুরু করে।


সন্ধ্যার পরীক্ষা থাকায় প্রায় আট মাস সে বাড়িতে আসে না। কিন্তু এর মধ্যে যে বাড়িতে এই এত কিছু ঘটে যাচ্ছে তা কিছুই জানতো না। সে অবাক হয়ে মাস্টার নামের এই লোকটার কথা শোনে। গ্রামের প্রায়ই প্রতিটি মানুষ লোকটাকে ভালোবাসে। সারাদিন ফণীসহ অন্যদের সাথে পড়ে থাকে ভবদহের বিলে। বেশি কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। সন্ধ্যায় পাড়ার বাচ্চাদের এক সাথে নিয়ে সুর করে ছড়া শেখাচ্ছে আবার গভীর রাতে ভবদহের বিল পাহারায় গিয়ে আপন মনে বাঁশি বাজায়।


কেমন যেন মায়া হয় সন্ধ্যার লোকটার প্রতি। সেদিন দুপুরবেলায় সন্ধ্যা বাড়ির সব কাজের লোককে খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। অন্য সবাই যেখানে চিল্লাচিল্লি করছে মাছ দাও, মাংস দাও সেখানে মাস্টার নামের লোকটা শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেল।


অন্যবার বাড়িতে আসলে সন্ধ্যা উন্মুখ হয়ে থাকে কখন যশোর যাবে মেসে সবার কাছে। কিন্তু এবার যেন কেমন বাড়িতেই অনেক ভালো লাগছে। সেদিন মাস্টার স্নান করার জন্য যখন সরিষার তেল নিতে আসে হঠাৎ সন্ধ্যা বলে ওঠে, "আমাদের বাড়িতে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না তো? "


মাস্টার কিছু বলে না শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায়। সন্ধ্যার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মাস্টারের সাথে একটু কথা বলার জন্য অনেক ছটফট করে সে। কী বলবে কী দিয়ে শুরু করবে বাড়ির এই কাজের লোকটার সাথে কিছুই মাথায় আসে না তাই সুযোগ বুঝে আজকে এ কথাটাই বলে।


মাস্টার আর ফণী সারারাত ভবদহ বিলের পাশে অস্থায়ী ছাউনিতে ঘুমায়। ইদানীং ঘুমের মাঝে মাস্টার চিৎকার করে ওঠে। বলে, " ফনীদা আমারে মাইরে ফেইলো। ধরো আমারে। " ফনীর ঘুম ভেঙে যায় মাস্টারের চিৎকারে। ফনীর একটাই সমস্যা তার ঘুম ভেঙে গেলে মাথা কাজ করে না। আবোলতাবোল বলা শুরু করে। প্রচণ্ড রেগে যায় হিতাহিতজ্ঞান থাকে না। প্রায়ই মাস্টার এ রকম ঘুমের ভিতর চিৎকার করা শুরু করছে ইদানীং। সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে মাস্টার চিৎকার শুরু করলেই ফনী প্রচণ্ড রেগে যায় বলে, " এই সালার ছওয়াল তোরে মারবি কিডা? এইহানে এই ভবদহই আমরাই মারি, আর কোন বাপের ব্যাটার সাহস আছে তোরে মারবি? কয়েক বছর আগে নিজির হাতে মারিছি একটারে। সালা তোর ধারণা আছে কার সাথে থাহিস তুই। এই বলেই আবার ঘুমিয়ে যায় ফনী।


এর পরদিন থেকেই ফনীকে আর মাস্টারকে খুঁজে পাওয়া যায় না মনোহরপুর গ্রামে। সবাই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাদের কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মহাজনকে অনেক চিন্তিত দেখায়। গ্রামের সবাই মাস্টারের জন্য দুঃখ করতে থাকে। ফনীকে কেউ পছন্দ করতো না। এভাবে কেটে যায় প্রায়ই ছয়দিন।


সেদিন সকালে মহাজন বাড়িতে পুলিশে ভরে যায়। একটা কালো রঙের মাইক্রোবাস থেকে নামতে দেখা যায় মাস্টারকে। গায়ে পুলিশের পোশাক। বুকের পাশে নেমপ্লেটে লেখা হাসান জাহিদ। সবাই অবাক হয়ে যায়। গাড়ি থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নামানো হচ্ছে ফনীকে। গায়ে মুখে প্রচণ্ড মারের দাগ।


মহাজনকে এরেস্ট করা হয়। সন্ধ্যা ছুটে আসে।


মাস্টার সবার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করে, " উপস্থিত গ্রামবাসী আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার পরিচয় গোপন করার জন্য। আমি ডিবির এসি হাসান জাহিদ। গত কয়েক বছর আগে এ গ্রামে ভবদহের বিলে সনাতন নামে একটা ছেলে পানিতে ডুবে মারা যায়। আসলে সনাতন পানিতে ডুবে মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়। আর তাকে হত্যা করে মহাজন আর ফনী পানিতে চুবিয়ে। পরে পানিতে ডুবে মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়। সনাতন আমার বন্ধু ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রুমে একই বেডে আমরা দু'বন্ধু ঘুমাতাম। সাঁতারের দিকে বরাবরই ওর খুব নেশা ছিল আমার মতো। আমরা দু'বন্ধু পদ্মার উত্তালে স্রোতে সাঁতার কাটতাম। সেই বন্ধু একটা বিলের পানিতে ডুবে মারা যাবে এটা সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করিনি। তাই পুলিশে চাকরি হওয়ার পর আমি নিজে থেকেই হায়ার অথোরিটিকে বলে সনাতন মার্ডার মিস্ট্রি নিয়ে কাজ শুরু করি। এবং সেভাবেই এখানে আসা ছদ্মবেশ নিয়ে। আসলে সনাতন বুঝতে পেরে গিয়েছিল মহাজন ভবদহ বিলের সব ইজারা নিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে। তাই সে এটা নিয়ে মহাজনের কাজের প্রতিবাদ করেছিল। মহাজন বুঝতে পারে সনাতন ভবিষ্যতে তার পথের কাঁটা হতে পারে। তাই ফনীকে দিয়ে তার সাথে ভালো সর্ম্পক করে একদিন রাতে ভবদহে সাঁতার কাটবে এই নেশা ধরিয়ে সাঁতারের সময় ফনী আর মহাজন মিলে পানিতে চুবিয়ে তাকে হত্যা করে।"


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com