রম্য গল্প
ইট ছুড়লে পাটকেল ফ্রি
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৩, ১১:৫৭
ইট ছুড়লে পাটকেল ফ্রি
শফিক হাসান
প্রিন্ট অ-অ+

পবন পুরোহিত চকবাজারে চকখড়ি কিনতে গিয়ে জানলেন সেখানে শুধু লেখার চক নয়, রূপচর্চার সামগ্রীসহ আরও অনেককিছুই বিক্রিই হয়। শৈশবের অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন, লেখার জন্য চকই ভালো, কোথাও ভুল হলে চকের লেখাটি মুছে ফেলে সহজেই পুনরায় লেখা যায়। তার উদ্দেশ্য জেনে দোকানদার বললেন, ‘কলম নিয়ে যান। চক দিয়ে কাগজে লেখা যায় না।’


পাইকারি দরে বারো ডজন কলম কিনলেন পবন পুরোহিত। কিন্তু কী হলো তারপর! রঙবেরঙের কলমের চোখা নিবসমগ্র তাকেই উপর্যুপরি ‘বেয়োনেট চার্জ’ করতে থাকবে বুঝতে পারলে দাঁতের মাজন কিনতেন। কালো নিম মার্কা মাজন ব্যবহারে দাঁত পরিষ্কার থাকত, সুযোগ বুঝে জায়গামতো মাজন দিয়ে আঙুলের ছাপও দিতে পারতেন। নতুনধারার অটোগ্রাফ নিশ্চয়ই মানুষ লুফে নিত। বইমেলা বুলেটিনগুলো হয়তো ফিচার প্রকাশ করত— ‘মেলায় এসেছে নতুন নিমওয়ালা’ কিংবা ‘অটোগ্রাফ প্রদানে নতুন শৈলী’! কিন্তু এটা কী হলো!


প্রকাশক মহোদয় বইমেলার প্রথম দিন থেকেই কাব্যবইটি স্টলে তুলেছেন। তাকে ফোনকল করে বলেও দিয়েছেন, ‘ইয়ার-দোস্ত, পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, ফেসবুক বন্ধুগো লয়া বইমেলায় আইসেন। অটোগ্রাফ দিয়া বই বেইচেন। বহুত কবি কলম নিয়া আর ফেরত দেয় না। আপনের কলম লগে রাইখেন। স্টলের কলম মাইরা দিয়েন না।’


নানান কিসিমের কলম আঁটি বেঁধে ১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় বইমেলায় প্রবেশ করছিলেন। মনে আনন্দ আমেজ; আহা, কতদিন পরে নাম দস্তখত করবেন। ব্যাংক লেনদেন নেই বলে অনেকদিন চেকবইয়েও সই করা হয় না। এই আনন্দে বাগড়া দিতেই বোধহয় পেছন থেকে একজন চড়াকণ্ঠে ডাকল— ‘ভাই, কলম কত করে?’


দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে পবন পুরোহিত বললেন, ‘কলমের ফেরিওয়ালা মনে হয়? আমি কবি। অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য কলম কিনেছি।’


বিস্ময় প্রকাশ করে পাল্টা জবাব এল,‘এত্ত কলম! আমি এক কলমেই দশ বছর চালিয়ে নিই।’


‘আপনি আর আমি কি এক বস্তু! আপনার পরিচয়?’ দাঁত-মুখ খিচিয়ে জানতে চাইলেন পবন পুরোহিত।


‘আমিও কবি। কাব্যদেবীর যাদু প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে দ্বাবিংশ কাব্যগ্রন্থ— বুকের মাঝে তুই পাটখেতেও তুই। সুনীলদা বেঁচে থাকলে বইটি নিয়ে দু’চার কথা লিখতেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন তো!’


তরুণ কবি পবন পুরোহিতের মনে পড়ে গেল প্রকাশকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। পান চিবুতে চিবুতে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি, ‘কয়-শ কপি বই ছাপবার চান?’


‘অন্তত তিন লাখ কপি তো লাগবেই। নইলে সারা দেশের আনাচেকানাচে আমার বই পৌঁছাবে না।’


প্রকাশক মুখে জমা পানের পিকটা কোঁত করে গিলে ফেলে বললেন, ‘কী যা তা কন! তিন লাখ বইয়ের দাম কত— ধারণা আছে?’


চৌষট্টি জেলায় বিভাগ আছে আটটি। এখানে তিন লাখ বই কি বেশি কিছু! প্রকাশকের সঙ্গে মৃদু বাদানুবাদের পর তিনি ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে তিন লাখকে তিনশ টাকায় গুণ দিলেন। অঙ্কটা দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। বাধ্য হয়ে বললেন, ‘কোটি টাকার হিসাব আমি পারি না!’


‘বুঝছি, আপনে অঙ্ক কাঁচা কবি। বই ছাপব একশ বিশ কপি। টাকা দিয়া যান।’


টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন বলে বইও চলে এসেছে ঠিক সময়ে। এখন দরকার ভালো একটা মার্কেটিং। সেই মার্কেটিংয়ের শুরুতেই কিনা মেজাজ গরম করে দিল কোথাকার কোন পাটখেত কবি! খেত-খামারি কবিকে পাত্তা না দিয়ে সামনে বাড়লেন পবন পুরোহিত। এবার একটি বুকস্টল থেকে ডাক এল, ‘ও ভাই, ঝরনা কলম আছে?’


তিনি বুঝলেন কান বেঁধে মাছ বহন করার মতো কলমগুলোকে রশি দিয়ে বহন ঠিক হয়নি। লোকজন তার সম্মানজনক পরিচয় ভুলে যাচ্ছে! স্টলকর্মীকে বললেন, ‘৯৮৭ নম্বর স্টলের সামনে আসেন। কবিতার বই কিনলে বলপেন ফ্রি পাবেন।’


আবার সামনে এসে দাঁড়ালেন পাটখেত কবি। বললেন, ‘আপনাকে মূল কথাটাই তো বলা হলো না!’


‘আপনার বই কিনতে হবে তো! পরে কিনব।’


‘আরে না। আমি বলতে চেয়েছি, আপনার বই কত কপি ছাপা হয়েছে?’


‘প্রকাশক তো বললেন ১২০ কপি ছাপবেন।’


‘তাহলে ১০০ কপিও ছাপা হয়নি।’


‘কী বলেন!’


‘ধরে নিলাম ১২০ কপিই। কিন্তু আপনি এত কলম কেন কিনেছেন কেন? এই কলমগুলো দিয়ে কত লাখ বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে!’


এবার পবন পুরোহিত নিজের মধ্যে ফিরলেন যেন। বললেন, ‘কথাটা মন্দ বলেননি। তবে আমার বই একাদশ-দ্বাদশ মুদ্রণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তাই একত্রে কিনে নিলাম। লোকজনও অবস্থা দেখে বুঝবে ওজনদার কবি, পাঠক আছে!’


‘তাহলে তাড়াতাড়ি যান। অটোগ্রাফ দিয়ে বই বেচেন। অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত হলে আমার স্টলের সামনে আসবেন। ১২১৭ নম্বরে ক-তে কবিতা প্রকাশন।’


পবন পুরোহিত নিজ স্টল বকবিতা প্রকাশনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাজ্জব ঘটনা, সামনে দাঁড়িয়ে একজন পাঠক তার বইটিই পড়ছে নিবিষ্টভাবে। ছোঁ মেরে পাঠকের হাত থেকে বইটি নিয়ে বললেন, ‘চিন্তা নেই। আমি এসে গেছি। অটোগ্রাফ পাবেন। ফটোগ্রাফও হবে, এরপর আছে মহাজন কফি। তারপরে চলবে তুমুল আড্ডা!’


ছয়রঙা কালির ছয়টি কলম ব্যবহার করে ধুমসে লিখে চলেছেন তিনি। পুস্তানি থেকে শুরু করে পরপর তিন পৃষ্ঠায় চঞঙ লিখে চতুর্থ পৃষ্ঠায় স্থিত হলেন। লিখতে লিখতে একবার তাকালেন সামনে। কী কাণ্ড, ভক্তের ছায়াও নেই! হতভম্ব হয়ে তার সামনে থাকা স্টলকর্মীকে বললেন, ‘সুবর্ণা, আমার কাস্টমারটা কই?’


‘কীসের কাস্টমার? তিনি কি বলেছেন বই কিনবেন!’


‘সে নিশ্চয়ই এতক্ষণ আমার অটোগ্রাফের অপেক্ষায় ছিল!’


‘আহা রে, কী আমার কবি, অটোগ্রাফ দেওয়া তার হবি!’


‘সুবর্ণা, তুমি বোধহয় আমাকে সূক্ষ্ণভাবে অপমান করার চেষ্টা করছ!’


‘সূক্ষ্ণভাবে নয়, তীক্ষ্ণভাবে! আর আমার নাম সুবর্ণা, কে বলেছে?’


স্টলকর্মীর হুল ফোটানো কথায় কর্ণপাত করলেন না তিনি। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সুন্দর বর্ণের সমষ্টি দিয়ে সুন্দর মানুষের নাম সুবর্ণা হওয়াই বাঞ্ছনীয়!’


‘আপনি তো দেখছি কল্পনাপ্রবণ কোবি। গোরু বানানে ও-কার দিতে হচ্ছে আপনাদের মতো তালগোলহীন মানুষের জন্যই। বউনি করতে পারিনি, নষ্ট-করা বইয়ের টাকা দেন এখন!’


নিজের বই কেউ নিজে কেনে নাকি! পবন পুরোহিত টাকা দিলেন না। উল্টো বললেন, ‘আমি দেখি ওই লোকটিকে খুঁজে পাই কিনা। ওকে আজ বই কিনিয়ে ছাড়ব। আমার সময় নষ্ট করে, তোমার বই নষ্ট করে- কত্ত বড় সাহস!’


কয়েকটি স্টলের সামনে চক্কর মারলেন তিনি। কোথায় তার অটোগ্রাফপ্রত্যাশী সেই পাঠক, হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি! কলমের বোঝা বইতে বইতে হাত টনটন ব্যথা করছে। যুগপৎ হাত ও মনের ব্যথার মধ্যে ভ্রাম্যমাণ একজন অঙ্কনশিল্পী এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার হাতে বর্ণমালা এঁকে দিই? মাত্র দশ টাকা।’


পবন পুরোহিত একটু চিন্তা করলেন। সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন কম সময়ের মধ্যে। বললেন, ‘তুমি আমার পিঠে পাঞ্জাবির উপরে লিখে দা— বই কিনলে অটোগ্রাফ ফ্রি; এসো সেলফি তুলি!’


পিঠ-লিখনের পর শিল্পীর পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি টাকা দিলেন না। দুইটা কলম ধরিয়ে দিলেন। বোঝা কমাতে হবে। কলমও শেষ করতে হবে। বোকার মতো এতগুলো কলম কেনা ঠিক হয়নি। শিল্পী কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্যার, কলম দিয়ে কী করব? টাকা দ্যান। মন্দির গেটে গিয়ে চা-বিড়ি খাই।’


আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে পবন পুরোহিত বললেন, ‘তুমি যখন বড় শিল্পী হবে, ভক্তদের অটোগ্রাফ দেবে না? সেই কলম আগাম দিয়ে দিলাম। সঙ্গে আমার আশীর্বাদও রইল।’


শিল্পী এবার খুশিমনে বিদায় নিল। কিন্তু পিঠ-লিখনের পরেও মিলল না প্রত্যাশিত সাড়া। ওই বিভ্রান্তকারী অটোগ্রাফশিকারি (!) পাঠককেও কোথাও দেখা গেল না। পালিয়ে গেল নাকি! বাধ্য হয়ে মেলা প্রদক্ষিণের সিদ্ধান্ত নিলেন দশকের বাউন্ডারির বাইরে অবস্থানকারী কবি। তার গায়েও দশকের সিল লাগলে অবলীলায় লাখো কবির সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারতেন। কিন্তু দশকওয়ারি সংকলনে কেউ কখনো তাকে রাখেনি। তাই নিজেকে অমুক দশকের কবি দাবি করার সুযোগও পাচ্ছেন না।


ঘুরতে ঘুরতে একটা কলমের খাপ খুলে আবার এলেন নিজ স্টলের সামনে। অটোগ্রাফ নিতে ইচ্ছুক কোনো পাঠককে যদি পাওয়া যায়! কিন্তু পাঠক কই, এই ছুটির সময়েও বইমেলা খাঁখাঁ করছে। টাকালোভী সুবর্ণা কটমট করে তাকিয়ে থাকল তার দিকে! বান্ডিল থেকে কলম বের করে বাড়িয়ে দিলেন সুবর্ণার দিকে। বললেন, ‘একটা কলম তোমাকে দিলাম!’


‘কলম দিয়ে কী করব? আমি কি আপনাদের মতো কবি নাকি!’ অগ্নিরোষ আরও প্রজ্জ্বলিত করে সুবর্ণা কলমটা ছুড়ে মারল দূরে। অপমানটা গায়ে না মাখার ভান করে তিনি সরে এলেন। ভাবতে পারেননি, ভালোবেসে যার নাম সুবর্ণা রেখেছেন সে-ই এমন কুবর্ণা আচরণ করবে।


পাটখেত কবিকে খুঁজে পেলে গল্প করা যেত। কিন্তু সে যদি আবার নিজের বই গছিয়ে দেয়! এই ভয়ে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করলেন পবন পুরোহিত। হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করলেন, দেশের সবচেয়ে বড় কবির বইও বিক্রি হচ্ছে না। উপরন্তু একটি স্টলে বিশ টাকায় বইয়ের সঙ্গে ছবি তুলে দেওয়া হচ্ছে।


‘পাঠকের’ পছন্দের যে কোনো ধরনের বইয়ের নাম বললেই হাজির করছে। তারা এসব ছবি পোস্ট করে কিংবা লেখকের মেসেঞ্জারে দিয়ে বলতে পারবে— আপনার বইটা কিনেছি, পড়ে খুব ভালো লাগল!


পবন পুরোহিত ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের বই বিক্রি হয় না, আর তোমরা এখানে অনৈতিক বাণিজ্য করছ! আর আমি কলমের ভার নিয়ে ঘুরে মরছি বৃথাই!’


একজন জবাব দিল, ‘কলমের ব্যবসাই তো ভালো। আমাদের প্রকাশকও কলমের ফ্যাক্টরি দিয়েছেন! দেখছেন না, এখানে আমি বই বিক্রির বদলে ফটো স্টুডিওর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি!’


ত্যক্ত-বিরক্ত পবন পুরোহিত ভাবলেন, মেলা ও মেলার বাইরে সব ধরনের কবিতার বই সেরদরে বিক্রি করে দিতে পারলে তিনিও কলম ফ্যাক্টরির মালিক হতে পারবেন। সেই ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের চাকরি অফার করবেন সুবর্ণাকে! তিনি যখন সুবর্ণার বস হয়ে যাবেন, সুবর্ণা নিশ্চয়ই এতটা ফোঁসফাঁস করতে পারবে না। একটু সম্মান দেখিয়ে কথা বলবে।


ভবিষ্যৎ চিন্তা পাশে সরিয়ে তিনি একজনকে বললেন, ‘বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছি এমন একটা ছবি তুলে দেবে?’


‘না স্যার। বই নষ্ট করা যাবে না। তাহলে জরিমানা দিতে হবে! আমরা ছবি তোলার পর বইটা আবার ফেরত দিয়ে আসি।’


‘তারা কি বইটা ভাড়ায় দেয়?’


‘না। আমরা বলি একজন পাঠক কিনতে চাচ্ছেন; তিনি কিনলে টাকা দিয়ে যাব নতুবা বই ফিরিয়ে দেব। ওরা দিতে আপত্তি করে না। বিক্রি-বাট্টা নেই তো!’



দুই.



বইমেলার অষ্টম দিনেও যখন এক কপি বই বিক্রি হলো না, আক্ষরিক অর্থেই মুষড়ে পড়লেন পবন পুরোহিত। কপাল ভালো, সুবর্ণা এটা নিয়ে তাকে কখনো ব্যঙ্গোক্তি করেনি। এতদিনে তিনি সুবর্ণার খুঁটির জোর সম্বন্ধেও অবগত হয়েছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন সেলস গার্ল, এখন ঠিকই জানেন এই ক্ষমতাধর হচ্ছে প্রকাশক মতলব জোয়ার্দারের শ্যালিকা। যার দুলাভাই আধুনিক কবিতার বড় প্রকাশক, সে একটু ঠাঁটবাট দেখাতেই পারে।


শুধু পবন পুরোহিতেরই নয়, তেমন কারও কবিতাবই বিক্রি হচ্ছে না। দশমীর দিনে সুবর্ণা কাছে ডাকল পবন পুরোহিতকে। সুপরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘বড় কবি হতে চান তো?’


আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি এটা কী বললে সুবর্ণা! বড় কবি কে হতে চায় না? এমনকি যারা কবি নয়, তারাও মনে মনে ঠিকই বড় কবি হতে চায়।’


‘বড় কবি হতে হলে বড়সড় অঙ্কের খরচও আছে। করতে পারবেন তো?’


‘তুমি বললে আমি সব করতে পারব; স-ব!’


‘কিছু লোক ভাড়া করুন। ভাড়াটিয়া লোকগুলোর কাজ হবে একটাই; এরা ঘুরে ঘুরে নানা জায়গায় ও বইমেলার চতুর্প্রান্তে বলে বেড়াবে— আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি— পবন পুরোহিত বড় কবি। এমন কয়েকজনকে চুক্তি করে আনতে পারবেন না?’


‘কেন নয়? আজই আমি কাজে নামছি।’


পরবর্তী এক সপ্তাহে দশজন চুক্তিভিত্তিক কর্মী দশ দিগন্তে ঘুরে ঘুরে কৌশলী ভঙ্গিতে সাক্ষ্য দিল— পবন পুরোহিত বড় কবি। কিন্তু বিক্রিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়ল না। বাধ্য হয়ে সুবর্ণার দ্বারস্থ হলেন তিনি— ‘তোমার বুদ্ধি তো পরাজিত হলো।’


‘এবার তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ান। ইউটিউবে চটকদার কনটেন্ট আপলোড করুন। বই বিক্রি না হয়ে যাবে কোথায়।’


ইউটিউবে কনটেন্ট আপলোড করার প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান না থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রচারণা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলেন। চেনা-অচেনা সব বন্ধু ও শত্রুকে মেসেঞ্জারে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন পবন পুরোহিত। বোধকরি এতে উল্টো ফলই ফলল। এমন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়রা যার যার টাইমলাইনে পবন পুরোহিতের ছবিসহ বইয়ের প্রচ্ছদ আপলোড করল— খুব ভালো বই, এক্ষুনি কিনে আনুন।


ভার্চুয়াল প্রচার দেওয়া একজনও বই কিনলেন না। বোধকরি তারা ভেবেই নিয়েছেন, এই পোস্ট দেখে তাদের শুভান্যুধ্যায়ী হাজার হাজার মানুষ লাইন দিয়ে বই কিনবে; নিজেরা এক কপি কিনলে কী আর না কিনলেইবা কী!


বইমেলার ছাব্বিশতম দিনেও যখন অর্ধ কপি বই বিক্রি হলো না, মুষড়ে পড়লেন পবন পুরোহিত। অকৃত্রিম সুহৃদ সুবর্ণার দ্বারস্থ হলেন আবার। বললেন, ‘বই প্রকাশ করতে গিয়ে যত টাকা খরচ হয়েছে, এ কদিনে তারচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়ে গেল। ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করব বুঝতে পারছি না।’


সুবর্ণা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘স্টলে বসে বসেই আমি আপনার কবিতা পড়েছি। আপনি অনেক উঁচু মাপের কবি। বড় কবির বই বিক্রি না হলে কবিরা গুনাহ হয় না।’


‘ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার মতো একজন পাঠক থাকলেই আমার চলবে। ভাবছি, কলমের ফ্যাক্টরি দেব। তুমি কি সহযাত্রী হয়ে আমার সঙ্গে থাকবে?’


‘অবশ্যই। তবে আমি দেব কাগজের ফ্যাক্টরি। আপনার কলম আমার কাগজ— চমৎকার সব কবিতা লেখা হবে!’


আবেগ কম্পিত থরথর কণ্ঠে পবন পুরোহিত বললেন, ‘তুমি আমার কবিতা হবে, সুবর্ণা?’


‘সেটা না হয় হলাম কিন্তু আপনার বউ?’


‘ও তো আমার প্রবন্ধ। নিরস প্রবন্ধ। জানো, প্রবন্ধ পড়তে আমার একটুও ভালো লাগে না!’


সুবর্ণা হেসে কুটি কুটি হয় কবিতা-প্রবন্ধের এমন সমীকরণে। হাসি থামলে সুবর্ণা বলে, ‘যার এক কপি বইও বিক্রি হয় না, তার কি দুইটা প্রবন্ধ থাকা জরুরি! একটা লিখিত অন্যটা অলিখিত প্রবন্ধ নিয়ে এমন মাতামাতি করা তাকে মানায় নাকি?’


‘কবিতার বই অবশ্যই বিক্রি হবে। তুমি সব বই বেঁধে দাও। আগামীকাল থেকে আমি লোকাল বাসে বই বিক্রি করব। বইমেলার খায়েশ মিটে গেছে! আজ পর্যন্ত একটা টেলিভিশনও আমার সাক্ষাৎকার নিতে এল না! দৈনিক পত্রিকাগুলোর বইমেলা প্রতিবেদক সব যেন মরে ভূত হয়ে গেছে!’


‘কী আর করবেন, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সংস্কৃতি তো নতুন নয়। কিন্তু আপনার অটোগ্রাফ দেওয়ার কলমগুলো তো সবই রয়ে গেল! এসব কোন কাজে লাগাবেন?’


‘কলমের সদগতিও হবে। বাস থেকে যারাই এক কপি বই কিনবেন তারাই পাবেন একটি করে কলম সম্পূর্ণ ফ্রি!’


‘আর অটোগ্রাফ?’


‘আমি বুঝে গেছি, এই বাজারে অটোগ্রাফের কোনো মূল্য নেই। অটোগ্রাফের পাইরেটেড কপি এখন নীলক্ষেতেও বিক্রি হয় না।’


বইগুলো বাঁধা-ছাঁদা হলে সুবর্ণা অন্য স্টলকর্মীদের সাহায্য নিয়ে তুলে দিল কবির মাথায়। মনে মনে বলল, পবন পুরোহিত বিষয়ে আজ রাতে দুলাভাইয়ের সঙ্গে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করা যাবে। বইমেলা থেকে ফেরত নিতে ভ্যান ভাড়া সাশ্রয় হলো, গুদামের মূল্যবান জায়গাও রক্ষা পেল— দুলাভাই নিশ্চয়ই খুশিতে আকর্ণ বিস্তীর্ণ হাসি দেবেন!



তিন.



পবন পুরোহিত লোকাল বাসে বই বিক্রি করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন, সেটা নিয়ে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ (কবিবউয়ের নাম মোনালিসা খানম, নিরস কিংবা সরস প্রবন্ধ হিসেবে তাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি) কিংবা সুবৃহৎ উপন্যাস লেখা যাবে। এই লেখক আপাতত সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছেন। বলাবাহুল্য, শফিক হাসান নিজেও পবন পুরোহিতের কবিতার বই কেনায় তেমন আগ্রহ দেখাননি। বইমেলাতে নয়, লোকাল বাসে তো নয়ই! বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি নিজের দেড়খানা বইও কখনো বিক্রি হতে দেখেননি; সেই তিনি কেন নগদ কিংবা বাকিতে অন্যদের বই কিনতে যাবেন! সতীর্থ কারও বই না কিনেই পাঠক-ক্রেতক (ক্রয়কারী) সম্প্রদায়ের উপর মধুর প্রতিশোধ নেওয়া যায়। ইটের বদলে পাটকেল ছুড়ে মারতে না পারলে নিজেকে দুর্বল দুর্বল মনে হয়!


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com