
ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অধিকৃৎ ফিলিস্তিনি অঞ্চল বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। আন্তর্জাতিক সমর্থনকে ‘গণহত্যার অর্থনীতি’ অভিহিত করে তা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের এক বক্তৃতায় এ মন্তব্য করেন আলবানিজ। এ সময় তিনি তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বেশ কয়েকটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন, যেগুলো ফিলিস্তিদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতায় সমর্থন দিচ্ছে।
আলবানিজ বলেন, “দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলের অবস্থা ভয়াবহ।”
“আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুরতম গণহত্যার জন্য দায়ী ইসরায়েল”।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গত ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধে প্রায় ৫৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধ ২২ মাসে পদার্পণ করেছে। এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ কয়েকবার বাস্তুচ্যূত হয়েছে, শহর ও নগর ধ্বংস হয়েছে, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে এবং বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
গণহত্যার অর্থনীতি
জীবিকার অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি শীর্ষক প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দখলকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করতে এবং সরিয়ে দিতে ইসরায়েলের বসতি-কলোনি প্রজেক্ট লাগসই করছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, অস্ত্র নির্মাতা, বিখ্যাত টেক কোম্পানি, ভারি সরঞ্জাম কোম্পানি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব কোম্পানি ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন থেকে শুরু করে দখলকৃত এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব কায়েমে সহযোগিতা করছে। তারা দখলকৃত এলাকায় নজরদারি এবং ফিলিস্তিনিদের হত্যায়ও মদত যোগাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় রক্তপাত বন্ধে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইসরায়েলকে চাপ দিতে কার্পণ্য করছে। অন্যদিকে বেশকিছু করপোরেট কোম্পানি ইসরায়েলের অবৈধ পেশার অর্থনীতি ছাড়াও এখন গণহত্যা থেকে লাভবান হয়েছে।
প্রতিবেদনে ইসরায়েলের অবৈধ সুযোগ নেওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিগুলোকে আইনের মুখোমুখি করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের সামরিক মেরুদণ্ড
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে সামরিক-শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী দখলদারিত্ব এবং সামরিক প্রচার যেন হয়ে উঠেছে সামরিক প্রযুক্তি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ড্রোন থেকে শুরু করে এআই সংবলিত লক্ষ্যবস্তু বানানোর যন্ত্র ও এফ-৩৫ ফাইটার জেট কর্মসূচির পরীক্ষা কেন্দ্র।
এফ-৩৫ কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লকহিড মার্টিনের নেতৃত্বাধীন। কিন্তু এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইতালীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিএসহ বৈশ্বিকভাবে তৈরি করা হয়। ড্রোন আধুনিকায়নের জন্য প্রতিবেদনে ইসরায়েলি কোম্পানি এলবিট সিস্টেমস ও আইএআইওর নামও উল্লেখ করেছে।
এছাড়া প্রতিবেদনে জাপানের ফানুক করপোরেশনের নামও তুলে ধরেছে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানটি সমরাস্ত্র তৈরির জন্য রোবোটিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে। এছাড়া ড্রেনমার্কের শিপিং কোম্পানি এপি মোলার-মায়েরস্কও তালিকাভুক্ত করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা সামরিক সরঞ্জাম নির্বিঘ্নে ইসরায়েলে সরবরাহ করেছে গাজা যুদ্ধ শুরু থেকেই।
এছাড়া প্রতিবেদনে প্রযুক্তি খাতের ভূমিকাও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজানের মত বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের গণনজরদারি ব্যবস্থা সক্রিয় করে সমন্বিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক ব্যক্তি ও গোয়েন্দাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ায় আইবিএমও দায়ী। প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্যের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে। অন্যদিকে মার্কিন কোম্পানি পালানটির টেকনোলজিস গাজা যুদ্ধ শুরু থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
এছাড়া প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটারপিলার ইনক, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই এবং সুইডেনের ভলভো গ্রুপের মতো ভারি যন্ত্রপাতির কোম্পানির দিকে ইঙ্গিত করেছে। কারণ এসব কোম্পানি ফিলিস্তিনে সম্পদ ও অবকাঠামো ধ্বংসের যন্ত্রপাতির যোগান দিয়েছে।
অপব্যবহার নথিভুক্ত করতে জাতিসংঘ নিযুক্ত স্বাধীন ও মুক্ত বিশেষজ্ঞ আলবানিজ বলেন, “ আমি যেটাতে জোর দিচ্ছি, সেটা কোনো একটি তালিকা নয়, এটা একটা প্রথা বা সিস্টেম। আর সেটাই তুলে ধরতে হবে।”
ইসরায়েল: প্রতিবেদন ‘ভিত্তিহীন’
জেনেভায় আলবানিজের বক্তব্যকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান প্রতিনিধিরা। জাতিসংঘে আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নোয়েল হোয়াইট বলেন, দখলকৃত ফিলিস্তিন এলাকার বসতি থেকে পণ্য আমদানি আইন করে বন্ধের বিষয়ে তার সরকার কাজ করছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আলবানিজের বক্তব্যের বিষয়ে জেনেভায় ইসরায়েলের কূটনৈতিক মিশরকে অনুরোধ করলেও তারা তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া দেয়নি।
এর আগে এই মিশন আলবানিজের প্রতিবেদনকে আইনি ভিত্তিহীন, অবমাননাকর ও তার কার্যালয়ের জন্য মানহানিকর বলে অভিহিত করে।
গাজায় গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। এজন্য দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিজে) তদন্তের মুখে রয়েছে।
বিবার্তা/এএইচকে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]