পৃথিবীর উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩, রেকর্ড ভাঙতে পারে ২০২৪
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:০৯
পৃথিবীর উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩, রেকর্ড ভাঙতে পারে ২০২৪
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

২০২৪ সালে পৃথিবীর উষ্ণতম জানুয়ারি মাস দেখেছে বিশ্ব। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস ১৯৫০ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস সিথ্রিএস-এর তাপমাত্রা রেকর্ড তালিকায় সর্বোচ্চ।


১৮৫০ সালের পর পৃথিবীর উষ্ণতম বছরের রেকর্ডে ২০২৩ সাল স্থান পায়। এরপরই উষ্ণতম জানুয়ারির রেকর্ড গড়ল ২০২৪ সাল। বছরের শুরুতেই পৃথিবীর উষ্ণতম জানুয়ারি মাস দেখেছে বিশ্ব। গত ২০২৩ সালের জুনের পর থেকে প্রতিটি মাসই বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাসের রেকর্ড গড়েছিল। গত ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বে ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গরমের বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ব্যাকরণ ভুলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। ২০২৩ সালে ইউরোপ থেকে আমেরিকা তীব্র দাবানল, মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে রেকের্ড ভাঙা দাবদাহে বিপর্যস্ত হয়। এশিয়ার দেশগুলোতে খরায় পুড়ে ফসলের মাঠ। ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্র রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।


বৃহস্পতিবার (৮ জানুয়ারি) এই তথ্য জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস)। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস ১৯৫০ সাল থেকে সিথ্রিএসের তাপমাত্রা রেকর্ড তালিকায় সর্বোচ্চ। এর আগে উষ্ণতম জানুয়ারির রেকর্ড ছিল ২০২০ সালের। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে।


মার্কিনসহ বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গত বছরের তুলনায় ২০২৪ সাল আরও বেশি রের্কড গরম হওয়ার এক-তৃতীয়াংশ সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এটি শীর্ষ পাঁচটি উষ্ণতম বছরে র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৯৯ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, গত মাসে বৈশ্বিক সমুদ্র পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা অন্যান্য যে কোনো বছরের জানুয়ারি মাসের রেকর্ডের তুলনায় সর্বোচ্চ ছিল।


পরিবেশবিদ সামসুল হুদা বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি নামে একটি জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিশ্ব নেতারা। এই চুক্তির আওতায় দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করা প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলেন বিশ্ব নেতারা। তবে এখনো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বিশ্ব। গত ২০২৩ সালের টানা ১২ মাস বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে দেখেছে বিশ্ববাসী।


আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মানবসৃষ্ট একাধিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ভূপৃষ্ঠে উষ্ণ পানির স্রোত বা এল নিনোর আবহাওয়ার ঘটনার কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ বিষয়ে সিথ্রিএসের ডেপুটি ডিরেক্টর সামান্থা বার্গেস বলেন, ‘শুধু রেকর্ড উষ্ণ জানুয়ারিই নয়, আমরা পুরো ১২ মাস প্রাক-শিল্প সময়ের চেয়ে ১.৫ সেন্টিগ্রেড (১.৭ ফারেনহাইট)-এর বেশি তাপমাত্রার আশঙ্কা করছি।’ তিনি আরও বলেছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত হ্রাস করা।


জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিকুর রহমান বলেন, অতি খরা ও বৃষ্টি এল নিনো ও লা নিনো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী এল নিনো ও লা নিনা। লা নিনো বা লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে এবং লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল পানি ও উষ্ণ পানির তারতম্য বিশ্লেষণ করে পেরুর জেলেরা এল নিনো ও লা নিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পান। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী গিলবার্ট দেখান যে এল নিনো বা লা নিনার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের মধ্যে সম্পর্ক আছে। তখন বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন এবং এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন।


স্বাভাবিক অবস্থায় পেরু ও ইকুয়েডর উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শীতল পানিতে ঝাঁক বেঁধে মাছ আসে। কয়েক বছর পরপর হঠাৎ করে মহাসাগরে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়। গরম পানির প্রবাহ আছে। এই উষ্ণ পানিতে মাছ পাওয়া যায় না। কর্মহীন হয়ে পড়ে জেলে সম্প্রদায়। ফসলের ক্ষতি হয়। এ অবস্থার নাম এল নিনো।


এল নিনোর প্রভাব কমে আসার পর প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন রূপে আসে অতিশীতল পানি। এ সময় জেলেদের জালে মাছ বেশি ধরা পড়ে। তখন আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করে না। বায়ু হয়ে যায় স্বাভাবিক। বৃষ্টির দেখা মেলে। এ অবস্থাকে জেলেরা নাম দিয়েছেন লা নিনা।


জলবায়ুর প্রভাবে এল নিনো নামে পরিচিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে খরা আর ঘাম ঝরানো গরমে বিশ্ববাসীর প্রাণওষ্ঠাগত। তীব্র উষ্ণতা নিয়ে আসা এল নিনোর পরেই বিপরীত প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসে লা নিনা। লা নিনার প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টি ও হিমবাহ গলে বন্যা দেখা দেয়। ক্রমাগত বাড়তে থাকা বন্যায় এশিয়াবাসীর সংকট দ্বিগুণ করে তুলছে।


ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে ইকুয়েডর ও পেরুর উপকূলের দিকে বিষুবরেখার অন্যদিক থেকে উষ্ণ পানির স্রোত আসতে শুরু করে। এর ফলে সাগরের পানির উষ্ণতা বাড়ে এবং ঝড়, খরা ও অনাবৃষ্টি হয়। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো দেখা দেয়। এল নিনোর প্রভাবে তুষারঝড়, দাবানল এবং খরা সংঘটিত হয়।


২০২৩ সালে আগুনে পুড়েছে অ্যামাজন, অস্ট্রেলিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া ও সাইবেরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, ক্যারিবীয় অঞ্চল ও এশিয়ার বড় অংশ ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্পের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়েছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপ, চীন ভারত বন্যার শিকার হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ড টেকসই না হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা, বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড়, দাবদাহ, ভূমিধস ও খরা এসেছে আরও বেশি ভয়াবহতা নিয়ে। এসব সংকট খাদ্য নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলছে।


জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামসুজ্জামান হেলালী বলেন, অত্যন্ত শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষ ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দুর্ভোগে পড়ে। প্রচণ্ড খরায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। দাবদাহে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের দ্বাদশ দীর্ঘ মেকং নদীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। মেকং নদীবিধৌত বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামে খরা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াও সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মালয়েশিয়ায়ও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বছরে হাজার কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও জানিয়েছে, পর্যাপ্ত মজুত থাকায় খাদ্য সংকট এখনো তীব্র হয়ে উঠেনি। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় বিশ্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। বাংলাদেশে আমন আবাদের ভরা মৌসুমে নদ-নদীতে পানি পাওয়া যায় না। উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়।


সাধারণত এল নিনোর পরপরই লা নিনা আসে। এল নিনোর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে লা নিনা শুরু হয়। এল নিনোর প্রভাবে সাগরে উষ্ণ পানির স্রোত প্রবাহিত হওয়ার পর পরে সাগরের পানির উষ্ণতা কমে আসে। সাগরের পানির এ উষ্ণতা কমে আসাকে লা নিনা নামে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। লা নিনার প্রভাবে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয়। ১৯৯৮ সালে লা নিনার প্রভাবে বাংলাদেশ ভারত ও চীনে ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়। বছরের শেষ দিকে লা নিনা দেখা দিলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়।


পরিবেশ বিজ্ঞানী শুমেন্দ্র দেবনাথ বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এল নিনো ও লা নিনার প্রতি সংবেদনশীল। ২০১৭ সালের বন্যায় বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে লা নিনা ছিল ওই বন্যার অন্যতম কারণ। বলা হচ্ছে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বা তেঁতাল্লিশের মন্বন্তরের কারণ ছিল এল নিনো।


বাংলাদেশে যেসব বছরে খরা হয়েছে যেমনÑ ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৯৭ ইত্যাদি ছিল এল নিনোর বছর। আবার যে বছরগুলোতে বন্যা হয় যেমনÑ ১৯৭০, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৭, ২০২০ ও ২০২১ বছরগুলো ছিল লা নিনার বছর।


বাংলাদেশ নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এসএম মনজুরুল হান্নান খান যায়যায়দিনকে বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূল ছাড়বেন কমপক্ষে ৩৩ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু হবে। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ। এ তথ্য কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জলবায়ুর প্রভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com