শিরোনাম
বিবিসির গবেষণা প্রতিবেদন
ভারতে ভুয়া খবর ছড়াতে বেশি তৎপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:০৯
ভারতে ভুয়া খবর ছড়াতে বেশি তৎপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী
ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভুয়ো খবর, গুজব, উন্মত্ত জনতা এবং গণপিটুনি। একই চিত্রনাট্য, শুধু বদলে যাচ্ছে স্থান, কাল ও পাত্র। আর এই রঙ্গমঞ্চ শুধু বুলন্দশহর, দাদরি বা জয়পুর নয়। মারণ ভাইরাসের মতো তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে। আসাম থেকে কর্নাটক, ত্রিপুরা থেকে গুজরাত। ছবিটা প্রায় এক সব জায়গাতেই।


বাড়তে থাকা সেই তালিকায় শেষতম সংযোজন সুবোধকুমার সিং। উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরে গোহত্যার গুজবে উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে মারল কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে।


২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। সেদিন এই তালিকায় ঢুকেছিল মোহাম্মদ আখলাকের নাম। উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে সেদিনও গুজব রটেছিল, তার বাড়িতে গরুর মাংস রয়েছে। সেদিনও উত্তেজিত হয়েছিল জনতা। পিটিয়ে মারা হয়েছিল ৫২ বছরের আখলাককে।


৩০ মে, ২০১৫। রাজস্থানের জয়পুর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে বীরলোকা গ্রামের ভাগাড়ে পাওয়া গিয়েছিল ২০০টি গরুর মৃতদেহ। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গুজব। গোহত্যায় মেতেছেন স্থানীয় মাংস বিক্রেতা আব্দুল গফফর কুরেশি, এই অভিযোগে তাকে পিটিয়ে মারে উত্তেজিত জনতা। পরে জানা যায়, স্থানীয় এক ঠিকাদার পৌরসভার অনুমতি নিয়েই এই মৃত গরু ভাগাড়ে ফেলেছিলেন। এর সঙ্গে কুরেশির কোনো যোগ ছিল না।


প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘কমন ফ্যাক্টর’ একটিই। গুজব ও সোশ্যাল মিডিয়া। কখনো ফেসবুক, কখনো হোয়াটসঅ্যাপ, কখনো টুইটার। হিসেব বলছে, শেষ এক বছরে সারা ভারতে ভুয়া খবর বা ‘ফেক নিউজ’ সংক্রান্ত ঘটনার জেরে ৩৩টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং সেই সংখ্যা আরো বাড়ছে।


কিন্তু ভুয়া খবর ছড়ানোর এই সব ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন? তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত উত্তেজনাই কি এর এক মাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? সমস্যা কি শুধুই আধুনিক প্রযুক্তির কারণে?


অতীত ঘাটলে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা আদৌ নতুন নয়। সাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যখন ভিন্ন মতের মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না, যখন রাজনৈতিক উপায়ে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার যুক্তি বা ধৈর্য্য থাকে না, তখনই বেছে নেয়া হয় অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তা। ভুয়া খবর ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে খতম করা, ভিন্ন মতকে ভয় পাইয়ে দেয়ার এই পন্থাকেই হাতিয়ার করে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী অংশ।


ভুয়া খবর নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক হিংসাও আসলে সেই ধারারই অংশ। সেই ইঙ্গিতই মিলল বিবিসি প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে।


দীর্ঘদিন সমীক্ষা চালানোর পর এই রিপোর্ট সামনে এনেছে এই ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবোধ। ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনে এই উগ্র জাতীয়তাবোধই নিচ্ছে সব থেকে প্রভাবশালী ভূমিকা। আর এই বোধ ছড়ানোর জন্য সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংগঠন ও তাদের নেটওয়ার্ক।


দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন মতাদর্শের বিভিন্ন গোষ্ঠী ভুয়া খবর ছড়াতে তৎপর হলেও সংখ্যার হিসেবে বাকিদের বহু পেছনে ফেলে দিয়েছে বেশ কিছু ‘হিন্দুত্ববাদী’ নেটওয়ার্ক। ভুয়া খবর ছড়াতে এইসব নেটওয়ার্ক বাকিদের থেকে অনেক বেশি সংগঠিত বলেই দাবি করা হয়েছে বিবিসির রিপোর্টে।



কী ধরনের ভুয়া খবর ছড়ায় বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী হিন্দু নেটওয়ার্ক?


সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের দ্বারা প্রচারিত ভুয়া মেসেজগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মূলত চারটি বিষয়কে হাতিয়ার করে ছড়ানো হচ্ছে ফেক নিউজ। সেগুলো হলো- অপরাজেয় হিন্দু শক্তি, ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্য ও তার পুনরুদ্ধার, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতা, প্রগতি ও জাতীয় গর্ব। অর্থাৎ পরম্পরা মেনেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী। আসলে নতুন মোড়কে ছড়ানো হচ্ছে পুরনো বক্তব্যই।


ইন্টারনেট আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কীভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এই প্রোপাগান্ডা? তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এই গবেষণায়। এজন্য ১৬,০০০ টুইটার অ্যাকাউন্ট, ৩২০০ ফেসবুক পেজ এবং ৪৭, ৫৪৩টি ফেক নিউজ সংক্রান্ত প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করেছে তারা।


বিবিসির রিপোর্টে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, অধিকাংশ ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরের পেছনেই আছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রাথমিক নিশানা সোশ্যাল মিডিয়াই। প্রথমে বানানো হয় ভুয়া খবরের মেসেজ। ভিডিও’র থেকে ছবি ব্যবহারেই সাফল্য আসে বেশি। সেই ছবিসহ মেসেজটি বানানোর পর আসরে নামে অ্যামপ্লিফায়ার প্রোফাইল।


বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে এই ভুয়া খবর বা ফেক নিউজ, তাকেই বলা হয় অ্যামপ্লিফায়ার প্রোফাইল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অ্যাকাউন্ট হয় ভুয়া। সেই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম-মতাদর্শী বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করা হয় এই মেসেজ। এভাবেই ধীরে ধীরে ভাইরাল হয়ে ওঠে ভুয়া মেসেজ।


ভাইরাল হওয়ার পর কখনো তা এতটাই ‘সত্যি’ হয়ে ওঠে, যে মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমও হয়ে পড়ে এই ভুয়া খবরের শিকার। সেক্ষেত্রে আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এই ভুয়া খবর। একদম শেষ পর্যায়ে সাধারণ মানুষও এই খবর বিশ্বাস করে তা ছড়াতে শুরু করেন। এভাবেই মিথ্যা হয়ে ওঠে সত্যি।


আধুনিক দুনিয়ায় ফেক নিউজ যে একটা বাস্তবতা, তা প্রথম বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ফেসবুকের। তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পেছনে রাশিয়ার মদত ছিল। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের সংস্থা ব্যবহার করেছিল মার্কিন নাগরিকদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ডেটাবেস। সারা দুনিয়া এখন জেনে গেছে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই প্রভাবিত করা হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।


কিন্তু ভারতে এসে অন্য বাঁক নিয়েছে ভুয়ো খবর। কখনো ছেলেধরা, কখনো গরু চুরি, কখনো কিডনি চুরি, কখনো গরু পাচার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবর ছড়ানোর মাধ্যমে যে লাগাম ছাড়া সহিংসতার দরজা খুলে গেছে ভারতে, তা সারা দুনিয়ায় বেনজির।


ভারতের জন্য বিষয়টি উদ্বেগের কারণ, এই মুহূর্তে সারা ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়া দাপটও। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া। সারা পৃথিবীতে হোয়াটসঅ্যাপের বৃহত্তম বাজার এখন ভারত। ভুয়া খবর ছড়াতে হোয়াটসঅ্যাপকে সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হলেও পিছিয়ে নেই ফেসবুক, টুইটারের মতো অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াও।


কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় এ বিষয়ে বলেছেন, ভুয়া খবর ছড়াতে দক্ষিণপন্থী শক্তির তৎপরতা বরাবরের। জোয়ান অব আর্ককে মিথ্যা অভিযোগে পুড়িয়ে মারা থেকে শুরু করে হিটলারের জমানায় গোয়েবলসের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, সর্বত্রই ভুয়া খবর ছড়ানোকে কার্যসিদ্ধি হাসিল করার অন্যতম রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।


তিনি বলেন, ডিজিটাল জমানায় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলছে। ভারতেও এখনো পর্যন্ত যে কারণে বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছে ‘হিন্দুত্ববাদী’রাই।


একই সঙ্গে তিনি জানান, ইন্টারনেট আসার পর কোনো ব্যক্তি খুব সহজে খবর তৈরি করতে পারেন। সেই খবর খুব সহজে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশও করতে পারেন। ইন্টারনেট ডেটা সস্তা হওয়ার কারণে কোনো মেসেজ ফরওয়ার্ড করতে বিশেষ কিছু খরচও হয় না। সেই হিসেবে দেখতে গেলে উদ্দেশ্য এক থাকলেও এখন কার্যসিদ্ধি করা সম্ভব আরো সহজে। আগের থেকে ফারাক এখন এটাই। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com