শিরোনাম
ভারতে আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব বাড়ছে
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:১০
ভারতে আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব বাড়ছে
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভারতে ''সর্বভারতীয় দল'' বলতে আছে হাতেগোনা কয়েকটি। তাই কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকার টিকিয়ে রাখতে আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভারতের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও এসব দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।


আর তাই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, পাঞ্জাবে আকালি দল, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে, ডিএমকে, ওড়িষ্যায় বিজু জনতা দলের মতো আঞ্চলিক দলগুলো অতীতেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে।
ভারতে আজ এটাই বাস্তবতা যে, কেন্দ্রে বা রাজ্যগুলোতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গঠনের দিন আর নেই। এখন সময় জোট সরকারের। আর ঠিক এ কারণেই আঞ্চলিক দলগুলোর হাত না ধরে উপায় নেই জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোর। নির্বাচনের আগে বা পরে জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোকে আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে গাটছড়া বাঁধতেই হয়।


বর্তমানে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে জোট সরকার তাই একটা দস্তুর। পশ্চিমবঙ্গের, অর্থাৎ মমতা বন্দোপাধ্যয়ের তৃণমূল কংগ্রেসের কথাই ধরা যাক। পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙ্গে এই দল গঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি। মমতা বন্দোপাধ্যায় এ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। দলের প্রতীক জোড়া ঘাসফুল, মতাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, শ্লোগান মা-মাটি-মানুষ। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে এককভাবে ১৮৪টি আসন পেলেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্য বিধানসভার ২২৭ টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। ওই সময় কেন্দ্রে সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক দল ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ২০১২ সালে ইউপিএ জোট থেকে বেরিয়ে আসে তৃণমূল কংগ্রেস। ইতিমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসকে সর্বভারতীয় দলের স্বীকৃতি দেয় নির্বাচন কমিশন। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ২৯৪টি আসনের মধ্যে এককভাবে ২১১টি আসন পেয়ে আবার সরকার গঠন করে তারা। এর আগে ২০০৯ সালে সংসদীয় নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জিতেছিল ২০টি আসনে। ১৯৯৯ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধে তৃণমূল। ২০১৪ সালে সংসদীয় নির্বাচনে এককভাবে লড়ে পায় ৩৪টি আসন।
উত্তরপ্রদেশ-কেন্দ্রিক বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)


উত্তরপ্রদেশ-কেন্দ্রিক বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) মুখ্যত দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের পার্টি। ভারতীয় সংবিধান রচনার প্রাণপুরুষ, দলিত নেতা ড. বি. আর আম্বেদকরের আদর্শে ১৯৮৪ সালে এই দল গঠন করেন কাঁসিরাম। তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে ২০০১ সালে দলের ভার নেন মায়াবতী। বিভিন্ন দলের সমর্থনে চারবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। ওই রাজ্যের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী তিনি। নির্বাচনী প্রতীক হাতি। ১৯৯৯ সালে মায়াবতী কৌশল বদলান। তিনি মনে করেন, বহুজন মানে তো সকলের। তাই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রার্থী করে বাজিমাত করেন, পাশাপাশি মুসলিমদেরও দলে টানার চেষ্টা করেন। নিজের রাজনৈতিক ভিত মজবুত রাখতে রাজনৈতিক আপস করতেও পিছ পা হননি দর কষাকষির খেলায় সিদ্ধহস্ত মায়াবতী। এর অংশ হিসেবে উত্তরপ্রদেশের দুটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি বিজেপিকে হারিয়ে দেন, আর এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন, চারটি রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা এবং আগামী বছরের সংসদীয় নির্বাচনে সম্মানজনক আসন না পেলে তিনি জোটে যাবেন না। ছত্তিশগড়ে আসন্ন বিধানসভা ভোটে তিনি হাত মিলিয়েছেন অজিত যোগীর পার্টির সঙ্গে। বিএসপি লড়বে ৩৫টি আসনে এবং অজিত যোগীর জনতা কংগ্রেস পার্টি ৫৫টি আসনে। অন্য আঞ্চলিক দলগুলোও চাইলে আসতে পারে। বর্তমানে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিএসপির চারজন এবং নিম্নকক্ষ লোকসভায় একজনও নেই।


উত্তরপ্রদেশের প্রভাবশালী সমাজবাদী পার্টি (এসপি)


সমাজবাদী পার্টি (এসপি) উত্তরপ্রদেশের খুবই প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল। জনতা দল ভেঙ্গে গঠিত হয় ১৯৯২ সালে। প্রতিষ্ঠাতা মুলায়েম সিং যাদব। দলের মতাদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, নির্বাচনী প্রতীক সাইকেল। ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে শাসক দল মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিকে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করে। মুলায়েম সিং পঞ্চমবার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন, কিন্তু তিনি নিজের ছেলেকে বসালেন মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে। পরবর্তীকালে শুরু হয় পিতা-পুত্রের পারিবারিক সংঘাত। পুরো কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেন মুলায়েমপুত্র অখিলেশ যাদব। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরে যায় সমাজবাদী পার্টি। সম্প্রতি ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে পিতা-পুত্রের সন্ধি হয়েছে। কিন্তু মুলায়েমের ছোট ভাই শিবপাল যাদব সেটা মেনে নিতে পারেননি, গত আগস্ট মাসে তিনি নতুন দল গঠন করেন। নাম সমাজবাদী সেক্যুলার পার্টি। সংসদের লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সমাজবাদী পার্টির বর্তমান আসনসংখ্যা যথাক্রমে ৭টি ও ১৩টি৷। রাজ্য বিধানসভায় ৪০৩টি আসনের মধ্যে ৫৫টি৷


শিখ ও পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী শিরোমণি অকালী দল


পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শিখ ও পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দলটির নাম শিরোমণি অকালী দল। সবচাইতে পুরানো প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল এটি। প্রতিষ্ঠা ১৯২০ সালে। স্বাধীনতা সংগ্রামে দলটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। অকালী নামেই বেশি পরিচিত। নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। বর্তমান সভাপতি সুখবীর সিং বাদল। গুরুদুয়ারার মতো শিখ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর দল। ১৯৬৯ সালে একক বৃহত্তম দল হলেও সরকার গড়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পেয়ে জোট বাঁধে (সাবেক ভারতীয় জনসংঘ) বিজেপির সঙ্গে। সেই সরকার বেশি দিন টেকেনি৷ ১৯৯৯ সালের বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পাঞ্জাবে সরকার গঠন করে, মুখ্যমন্ত্রী হন প্রকাশ সিং বাদল৷ ওই নিয়ে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু ২০১৭-এর বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যায় দলটি। বর্তমানে পাঞ্জাব শাসন করছে কংগ্রেস সরকার। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় অকালী দলের সদস্য মাত্র চারজন। রাজ্য বিধানসভায় ১১৭ টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৫টি।


রাজধানী দিল্লির আম আদমি পার্টি


আম আদমি পার্টি বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির শাসক দল। ২০১২ সালে দলটি গঠিত হয়। ২০১১ সালে জন লোকপাল বিল পাস করানো নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী দুই বিশিষ্ট আন্দোলনকারী আন্না হাজারে ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন' আন্দোলনের রাজনীতিকরণ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আন্না হাজারে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকে রাখতে চান রাজনীতির বাইরে, কেজরিওয়াল চান এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিতে। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি৷ উঠে আসে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে। সরকার গঠন করে কংগ্রেসের শর্তাধীন সমর্থনে। অবিলম্বে লোকপাল বিল আনার শর্ত ছিল৷।কিন্তু যখন তা হবার সম্ভাবনা দেখা গেল না, তখন আম আদমি পার্টি সরকার ৪৯ দিনের মাথায় ইস্তফা দেয়। ২০১৫ সালের দিল্লি বিধানসভা ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ফের ক্ষমতায় আসে তারা। বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে আম আদমি পার্টি একাই পায় ৬৬টি আসন। পাঞ্জাবেও আম আদমি পার্টি জায়গা করে নিয়েছে। পাঞ্জাব বিধানসভার ১১৭টি আসনের মধ্যে আম আদমির আছে ২০টি আসন।


তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে দল


নিখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুনাত্রা কাড়াগাম (এআইএডিএমকে) বর্তমানে দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাড়ু ও পুড়ুচেরির শাসক দল। এই দল সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দ্রাবিড় আঞ্চলিক পার্টি। এর প্রতিষ্ঠাতা তামিল চলচ্চিত্র জগতের স্বনামধন্য নায়ক এম.জি রামচন্দ্রন। রাজ্যের ডিএমকে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে এই দল গঠন করেন তিনি। তাঁর পরলোকগমনের পর হাল ধরেন রামচন্দ্রনের আরেক সহকর্মী তামিল চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা জয়ললিতা। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখে এআইএডিএমকে। বলা বাহুল্য, তিনিই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল এআইএডিএমকে। সাতের দশকে দুর্নীতির অভিযোগে ডিএমকে দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এআইএডিএমকে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে। এ দলের নির্বাচনী প্রতীক জোড়া পাতা। সি.এন আন্নাদুরাই-এর প্রদর্শিত পথই দলের আদর্শ। প্রথম দিকে কংগ্রেসের সঙ্গে একটা আঁতাত হয়, পরে তাতে ভাঙ্গন ধরতে থাকে।


তামিলনাড়ুর পুরনো দল ডিএমকে


দ্রাবিড় মুনাত্রা কাড়াগাম (ডিএমকে) তামিলনাড়ু রাজ্যের পুরনো আঞ্চলিক দল। এর প্রতিষ্ঠাতা সি.এন আন্নাদুরাই। জাস্টিস পার্টি হিসেবে পরিচিত দ্রাবিড় কাড়াগাম পার্টি ভেঙ্গে গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু দলের নেতৃত্ব দেন করুণানিধি। দলের মতাদর্শ সামাজিক গণতন্ত্র ও আঞ্চলিকতাবাদ৷। রাজনৈতিক অবস্থান মধ্য-বাম। বিভিন্ন সময়ে পরিস্থিতি বুঝে আঁতাত হয় কংগ্রেস, বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ইউপিএর সঙ্গে। দলের প্রতীক চিহ্ন উদীয়মান সূর্য। মূল পার্টি দ্রাবিড় কাড়াগামের দুই শীর্ষ নেতা পেরিয়ার ও আন্নাদুরাইয়ের মধ্যে মতভেদ চরমে উঠলে দল ভেঙ্গে বেরিয়ে যান আন্নাদুরাই। মতভেদের মূল কারণ পেরিয়ারের বৃদ্ধ বয়সে এক তরুণীকে বিয়ে করে তার হাতেই দলের নেতৃত্ব তুলে দিতে চাওয়া।


ওড়িষা রাজ্যের বিজু জনতা পার্টি


বিজু জনতা দল বর্তমানে ওড়িষা রাজ্যে ক্ষমতাসীন। ওড়িষার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়েকের ছেলে নবীন পট্টনায়েক এখন মুখ্যমন্ত্রী। পিতার নামেই দলের নাম। গঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। দলের প্রতীক শঙ্খ। ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে আঁতাত। এখন কোনো জোটে নেই। মূল দল জনতা পার্টির সঙ্গে মতভেদের কারণে বিজু পট্টনায়েকের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে মূলধন করে নবীন পট্টনায়েক ২০০৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন৷ কেন্দ্রে খনি মন্ত্রী হন। কিন্তু ২০০০ সালে ওড়িষা বিধানসভা নির্বাচনে বিজু জনতা দল বিপুলভাবে জয়ী হলে নবীন পট্টনায়েক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপদে ইস্তফা দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। তারপর থেকে আরো তিনবার তাঁর দল বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় নবীন পট্টনায়ক এখন মোট চারবারের মুখ্যমন্ত্রী। সূত্র : ডয়চে ভেলে


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com