শিরোনাম
বাংলাদেশী বাদলকে কারামুক্ত করতে ইন্ডিয়া গেটে জমায়েত
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০১৮, ১৬:১৪
বাংলাদেশী বাদলকে কারামুক্ত করতে ইন্ডিয়া গেটে জমায়েত
কলকাতা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

গত দশ বছর ধরে দিল্লির তিহার জেলে (সংশোধনাগার) বন্দী বাংলাদেশের বাগেরহাটে জেলার বাসিন্দা বাদল ফরাজিকে মুক্তির দাবিতে দিল্লির রাজপথে শান্তিপূর্ণ জমায়েতে পা মেলালেন কয়েক হাজার মানুষ। বাদলের পাশে থাকার বার্তা দিতে রবিবার বিকালে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে হাজির হয়েছিলেন তারা।


জমায়েতে ছিলেন শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের মানুষ। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড আর পোস্টার। যদিও সেই জাময়েতে রাজনীতির কোনো রং ছিল না।


ইন্ডিয়া গেটের এই জমায়েতের প্রধান উদ্যোক্তা ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা রাহুল কাপুর। বাদলকে দ্রুত কারাগার থেকে মুক্ত করতে গত দুই বছর ধরে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন তিনি।


রাহুল কাপুর


দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কে মার্স্টাস করা রাহুল সামাজিক কাজের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তিহার জেলে যাতায়াত করছেন তিনি। কারাগারের বন্দীদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিংয়ের কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজির সাথে পরিচয় হয় রাহুলের। বাদলের কথা শুনেই প্রচণ্ড নাড়া দেয় রাহুলকে।


রাহুল জানতে পারে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে বাদলকে। বাদলের মুখ থেকে সবকিছু শুনে নতুন লড়াই শুরু করেন ভারতীয় সমাজসবী রাহুলের। দিল্লির কারাগার থেকে বাদলকে মুক্ত করতে, বাদলের ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ভুলে সম্মিলিতভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আর্জি জানান রাহুল। সাড়াও মেলে দারুণ।



ইতিমধ্যেই 'জাস্টিস ফর বাদল' শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে ২০০০ জনের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। এর পাশাপাশি বাদলের মুক্তির বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও চিঠি লিখে বাদলের মুক্তির বিষয়টি তরান্বিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন রাহুল। আর এরপর বাদলের মুক্তির ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ইন্ডিয়া গেটে এই জমায়েতের আয়োজন। বাদলের পাশে দাঁড়াতে গত কয়েক দিন ধরেই ফেসবুকে লাগাতার প্রচার চালিয়েছেন রাহুল।


তিনি জানিয়েছেন, ভারতে ঘুরতে এসে পুলিশের হাতে বাদল ফরায়েজি (২৮) আটক হন। এরপর এক খুনের ঘটনায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এখন তিনি ভারতে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ কাটাচ্ছেন। কিন্তু যখন এই খুনের ঘটনা ঘটে বাদল তখন তার নিজের দেশে ছিলেন। তার মুক্তির ব্যাপারে আমি বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়েছিলাম। আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে চিঠি লিখেছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। তাই নতুন এই উদ্যোগ।


এদিকে, ছেলে বাদলের মুক্তির পথ চেয়ে বাগেরহাটে বসে আছেন তাঁর মা সরাফালি বেগম। দিল্লির তিহার জেল থেকে ছেলের দ্রুত মুক্তির জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্ররমন্ত্রী রাজনাথ সিং, দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আর্জি জানিয়েছেন সরাফালি বেগম।


ফেসবুকের মাধ্যমেই তিনি দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আর্জি জানিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলেন, 'আমি সকলের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, আমার ছেলে যাতে বুকে ফিরে আসতে পারে। ছেলের শোকেই আমার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমিও অসুস্থ। আমি যাতে ছেলেকে শেষ দেখা দেখে মরতে পারি। আমার মাও অসুস্থ, শয্যাশায়ী তিনি। রুপির অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আজ আমি খুবই অসহায়, আমাদের দেখার কেউ নেই, দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমি কোনো রুপি চাই না, আমি চাই আমার ছেলে যাতে আমার কাছে ফিরে আসে। আমি ভারতের সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যে আপনারা সেই ব্যবস্থা করবেন।'



উল্লেখ্য, তাজমহল দেখতে ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভারতে গিয়েছিলেন বাগেরহাটের মংলা বন্দরের কাছে ১৭ নম্বর ফারুকি রোডের টিএ ফারুক স্কুলের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বাদল। ওইদিন দুপুরে বেনাপোল অভিবাসন কার্যালয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতের হরিদাসপুর সীমান্তে প্রবেশের পরই খুনের অপরাধে বিএসএফ বাদলকে আটক করা হয় তাকে।


জানা যায়, ২০০৮ সালে ৬ মে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধাকে খুনের অভিযোগে বাদল সিং নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজছিল পুলিশ। তাকে ধরতে সীমান্তেও সতর্ক করা হয়েছিল। তখন শুধু নামের মিলের কারণেই বাংলাদেশী নাগরিক বাদল ফরাজিকেই হাজতে ঢুকতে হয়।


হিন্দি বা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে না পারার মাসুল গুণতে হয় বাদলকে। কারণ ভাষা সমস্যার কারণেই বাদল সে সময় বিএসএফ'র কর্মকর্তাদের বোঝাতেই পারেননি যে, খুনের অভিযোগে যে বাদলকে খোঁজা হচ্ছে তিনি সেই ব্যক্তি নন।


এরপর হরিদাসপুর থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বাদল ফরাজিকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে। খুনের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয় বাদলের বিরুদ্ধে।


২০১৫ সালের ৭ আগষ্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লির সাকেট আদালত। বাদলকে যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে দিল্লি হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের সেই রায় বহাল রাখে। পরে তার স্থান হয় দিল্লির তিহার জেলে।


কিন্তু বিনা দোষে এই সাজা কোনোভাবেই মেনে নেয়নি বাদল। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল। কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আরজি খারিজ করে দেয়। ফলে গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে জেলের কুঠুরিতে জীবন কাটাতে হচ্ছে বাদলকে।


তবে গত এক দশক ধরে বাদলও বসে নেই। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিল্লিতে বৃদ্ধা খুনের সময় তিনি যে ভারতেই ছিলেন তাও জানিয়েছেন তিনি। তার কথা শুনে কারাগারের অন্য কয়েদিরা ও জেল কর্তৃপক্ষেরও বিশ্বাস, বাদল মিথ্যা বলছেন না। কারাগার কর্তৃপক্ষও বাদলের সংযত ও ভাল ব্যাবহারের প্রশংসা করছে।


গত এক দশক ধরে নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন বাদল। কারাগার থেকে পড়াশোনা করেই স্নাতক হন বাদল। কারাগার চত্ত্বরে থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনির্ভাসিটি থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছেন বাদল। একটা সময় যে ভাষা সমস্যার কারণে তাকে এতবড় শাস্তি পেতে হয়েছিল তাকে, আজ তিনিই ইংরেজি বা হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছে সে।


বিবার্তা/ডিডি/কামরুল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com