শিরোনাম
এডিস মশার বিস্তার রোধে মিলবে ডেঙ্গু জ্বর থেকে মুক্তি
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০১৯, ১১:২৪
এডিস মশার বিস্তার রোধে মিলবে ডেঙ্গু জ্বর থেকে মুক্তি
আকরাম হোসেন
প্রিন্ট অ-অ+

ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন জটিল আকার ধারণ করছে। কয়েক বছরের পরিসংখ্যানও এবার ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে রাজধানীবাসীর মনে বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার মতো সেরকম পরিস্থিতি এখনো আসেনি।


রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও অনেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। হাসপাতাল সূত্র বলছে, ঘণ্টায় ছয়জনের বেশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন।


সূত্রটি আরও বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন। চলতি মাসে গড়ে প্রতিদিন ১৫৪ জনের ওপরে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। রবিবার (১৪ জুলাই) ২ হাজার ১৬৪ জন রোগী পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসছেন হাসপাতালে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চলতি বছর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গু বাড়ছে।


অন্যদিকে রাজধানীর শাহবাগ ও প্রেস ক্লাবের সামনে সম্প্রতি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে দেখা গেছে।


চলতি বছরের প্রথম আট দিনে ১ হাজার ১৮২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।


ডেঙ্গু জ্বর একটি পীড়াদায়ক রোগ। এ জ্বরে আক্রান্ত হলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি এর রেশ শরীরে থেকে যায় দীর্ঘদিন। তবে ডেঙ্গু প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়। বিশ্রাম ও নিয়মমাফিক চললে এ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক শিপলু নাফিজ বির্বাতাকে বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে। এ ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সে ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সে মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।


ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাযন। তবে ডেঙ্গু জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে, যাতে বড় ধরনের কোনো ঝুঁকি না আসে।


স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গত বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু প্রাণঘাতী রোগ না হলেও অবহেলার বা অতিমাত্রায় পৌঁছলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।


জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডি সেন্টাল হাসপাতালে ৭৪ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে ২০ জন, বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে ৪৭ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৫১ জন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইলে ৫৪ জন, আজগর আলী হাসপাতালে ২৪ জন, সালাউদ্দিনে ৩০ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২৭ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯৮ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৯৬ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২০ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৮১ জন, বারডেম হাসপাতালে ৬ জন, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৫০ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৫১ জন, বিজিবি হাসপাতালে ১৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া ঢাকার বাইরেও ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে।


এ বছরের জানুয়ারিতে ৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, জুন মাসে ১ হাজার ৭৫৯ জন এবং জুলাই মাসে এ পর্যন্ত ২ হাজার ১৬৪ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে ৯৩৮ জন ছাড়া অন্য রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন।


ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসার ব্যাপারে অধ্যাপক শিপলু নাফিজ বির্বাতাকে আরও বলেন, শরীরে জ্বর আসার সাথে সাথে ডাক্তার দেখাতে হবে। ডেঙ্গু হলে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছতে হবে। সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে।



ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। জ্বর হওয়ার চার থেকে পাঁ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত চার বা পাঁচ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এর দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।


সচেতন মহল বলছে, ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের প্রথম কাজ হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ করা এবং এ মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে পারলেই মিলবে ডেঙ্গু জ্বর থেকে মুক্তি।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর মতে, স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।


তিনি বলেন, যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস, যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে- সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।


প্রতিরোধের ব্যাপারে অধ্যাপক শিপলু নাফিজ বলেন, রাতে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে। বিশেষভাবে দিনে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে থাকে। বাড়ির আশপাশে পানি জমে থাকলে এডিস মশার জন্ম হয়। এজন্য বাসা বাড়িতে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে। ফুলের টপ, বালটিসহ অন্যান্য যেসব পাত্রে পানি জমে থাকে, তা ফেলে দিতে হবে।


স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার বিবার্তাকে বলেন, এডিস মশা নোংরা পানিতে ডিম পাড়ে না। পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। বাসা বাড়িতে, ফুলের টবে, বালতির পানিতে, এসির পানিতে, ফ্রিজের নিচের পানিতে, ডাবের খোলা, গাড়ির টায়ারের পরিষ্কার পানিতে এ মশা ডিম পাড়ে।


পানি তিন দিন জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা হয়। আমাদেন বাসা বাড়ি, বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে এডিস মশার বিস্তার না হতে পারে।



বিবার্তা/আকরাম/ উজ্জ্বল/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com