শিরোনাম
আমাদের স্বভাব এমনই থাকবে!
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:২৯
আমাদের স্বভাব এমনই থাকবে!
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

পত্রিকা অফিস থেকে আমাকে দুই বার জিজ্ঞেস করা হয়েছে, কি ব্যাপার, আপনি এই বিষয়ে কিছু লিখছেন না কেন?


আমি যেহেতু নিয়মিত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষাঙ্গন নিয়ে লেখালেখি করি, তাই স্বাভাবিক অর্থে নিজ দায় থেকেই এই নিয়ে লেখা উচিত।


অরিত্রী নামের মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে, এই খবর গতকাল পেয়েছি।মেয়েটা ভিকারুননিসা স্কুলে পড়ত।এই মেয়ে কিংবা আত্মহত্যা'র ঘটনা নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না।


আমি বরং আমাদের চারপাশের অবস্থা গুলো আরেকবার তুলে ধরি।


ঢাকাতেই আমার জন্ম। সাধারণত আমাদের সময় যাদের জন্ম কিংবা বেড়ে উঠা ঢাকাতে, তারা ঢাকার বাইরে পড়তে যেত না।আমি বরাবর'ই মোটামুটি ভালো ছাত্র ছিলাম। আমার একাডেমীক ব্যাকগ্রাউন্ড সব সময়ই ভালো ছিল।স্বাভাবিক ভাবেই যে কোনো জায়গায় পরীক্ষা দিলে চান্স পেয়ে যাবো এমন একটা বিশ্বাস নিজের মাঝেই ছিল।


ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পরীক্ষা দিয়েছিলাম তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর এবং সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।ঠিক কোন কারনে আমি এই তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, আমার এখন আর পুরোপুরি মনে পড়ছে না। যেহেতু প্রথম দুটো ঢাকাতেই আর আমার বাসাও ঢাকাতে, তাই স্বাভাবিক ভাবে সেখানে পরীক্ষা দেয়ার কথা। ঢাকার বাইরে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, কারণ, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম- ঢাকার বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করলে কেমন হয়! সেই ইচ্ছে থেকেই সিলেটে পরীক্ষা দেয়া।


সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়েছি। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছি- সিলেটে পড়তে যাবো।


আমার বড় বোন আর দুলাভাই, যারা নিজেরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, এরা তো কোন ভাবে'ই আমাকে সিলেটে যেতে দিবে না। আমার বাবা'ও না।


একদিন আমার বাবা আমাকে ডেকে বললেন, তোমার বাসার বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করার কোন দরকার নেই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে কেউ অন্য কোথাও পড়ে?


আমি আর কিছু বললাম না। গিয়ে মা'কে মনের কথা জানালাম।আমার মা এই জীবনে কখনো আমাকে কোন কিছুর জন্য "না" করেনি।


শেষমেশ আমার মা, বাসার সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করালেন। আমার অন্যান্য ভাই-বোনরা তো সবাই রীতিমত আমাকে নিয়ে হাসাহসি করছে। কারণ, ওরা সবাই ঢাকতে'ই পড়াশুনা করেছে। আমার এক বোন বলেছে, এক সময় বুঝবি কতো বড় ভুল করছিস তুই।


কতো হবে বয়েস তখন? ১৭ এর মতো। গেলাম চমৎকার শহর সিলেটে। ক্লাস শুরু হলো। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, সব স্যার-ম্যাডাম জিজ্ঞেস করছে, তুমি কোন কলেজে পড়াশুনা করেছ?এটা জিজ্ঞেস করা খারাপ কিছু না। তবে বেশি অবাক হয়েছি, যখন আবিষ্কার করলাম কেউ একজন যদি নটরডেম কিংবা হলিক্রস-ভিকারুননিসা অথবা নামকরা কোন কলেজ থেকে থেকে পড়ে আসে, তাহলে স্যার কিংবা ম্যাডাম দুই চার লাইন বেশি'ই কথা বলছে তার সঙ্গে হেসে হেসে।


বুঝে গেলাম, স্রেফ ভালো স্কুল-কলেজে পড়ার জন্য শুধু শিক্ষকরাই না, ক্লাসের বন্ধুদের কাছে'ও তারা আলাদা সমাদর পাচ্ছে!


বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় এক ম্যাডাম আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেছিল, যা আমি এই জীবনে কোন দিন ভুলতে পারবো না।


আমি বিতর্ক করতাম। জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক। সেবার সার্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে বিদেশে যেতে হবে। আমি বিতর্ক দলের সদস্য। তো, যেই স্যার আমাদের দেখভাল করছিলেন, তিনি দুপুর দুটো'র সময় মিটিং দেখেছেন, আমাদের সেখানে থাকতে হবে।


দুপুর দুটো'র সময় ওই ম্যাডামের সঙ্গে আমাদের একটা ক্লাস ছিল। তাই আমি ম্যাডামকে গিয়ে বললাম, বিতর্কের জন্য স্যারের সঙ্গে একটা মিটিং আছে, হয়ত মিনিট ১৫ লাগবে। আমি কি আপনার ক্লাসে খানিক পরে যেতে পারি?


ম্যাডাম বললেন, ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই।


তো আমি মিটিং শেষে ক্লাসে ঢুকেছি। ম্যাডাম আমাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, এই ছেলে, তোমার সাহস তো কম না, আমার ক্লাশ বাদ দিয়ে মিটিং করতে যাও! কই থেকে উঠে আসছ? বাপ-মা কিছু শেখায়নি? মনে তো হয় বস্তি থেকে উঠে এসছ!


বিশ্বাস করুন, এই ম্যাডাম এর চাইতেও জঘন্য কিছু শব্দ ক্লাসে ব্যাবহার করেছেন, যেটা আমার পক্ষে অন্তত এই লেখায় তুলে দেয়া সম্ভব না।


আপনাদের জানিয়ে রাখি- এই ম্যাডাম ঢাকার ভিকারুননিসা স্কুল-কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছিলেন।


এই ভদ্রমহিলা উঠতে-বসতে আমাদের অর্থাৎ আমরা যারা সিলেটে পড়াশুনা করছি, তাদের অপমান করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন- তোমরা হচ্ছ ‘ক্ষ্যাত’!বিশ্বাস করুন, তিনি এই শব্দ বহু বার ব্যাবহার করেছেন অন্তত আমি যত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম।


আমি সাধারণত খুবই নরম স্বভাবের মানুষ। আমার আশপাশের কেউ বোধকরি খুব একটা বলতে পারবে না, আমি কোন দিন কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছি কিনা। কিন্তু সেইদিন ম্যাডাম বাবা-মা তুলে কথা বলতে, আমি উত্তর দিয়ে বললাম, আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি, আপনি আমাকে বলেন। আপনি আমার বাবা-মা'কে কেন টেনে আনছেন এখানে? আর আপনি যে বললেন আমি বস্তি থেকে উঠে এসছি। তাতে আপনার সমস্যা'টা কোথায়? নাকি বস্তির ছেলে-মেয়েরা যদি আপনার ছাত্র-ছাত্রী হয়, তাহলে তাদের পড়াবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? তাছাড়া আমি তো কোন অন্যায় করিনি, আমি তো আপনার অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলাম। সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে। কারন খুব কম ছেলে-পেল'ই ইংরেজিতে বিতর্ক করার সামর্থ্য রাখে।


এই ম্যাডাম আমার এই কথা শুনে এমন ভাবে চিৎকার করে উঠলেন, শুনে আমিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোমার সাহস তো কম না, মুখের উপর কথা বলো! এক্ষুনি বের হও ক্লাস থেকে। নইলে আমি তোমাদের কোর্স করাব না।


আমি উত্তরে বলেছি, ম্যাডাম, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। বের হতে হলে আপনি হন। কারণ, অন্যায় আপনি করছেন।


এই ম্যাডাম পুরো ক্লাসে বলে গেলেন, এই ছেলে যদি ক্লাসে থাকে, আমি তোমাদের কোর্স নিবো না। এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন।


আমার ক্লাস মেটরা এরপর আমাকে উনার কাছে গিয়ে মাফ চাইতে বলেছেন।


যা হোক, সেই কোর্স আমাকে অনেক পরে শেষ করতে হয়েছে। অনেক পরে জানতে পেরেছি ওই ম্যাডাম আর আমাদের বিতর্ক দলের দেখভাল করা স্যারের মাঝে বিরোধ ছিল। চিন্তা করে দেখুন অবস্থা, তাদের মাঝে বিরোধ, অথচ ঝালটা কিনা আমার উপর দিয়ে ঝাড়ল!


এই হচ্ছে আমাদের নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মনোভাব।এদের কোনো দোষ নেই। দোষ এদের শিক্ষকদের। কারণ, ভর্তি হবার পরই এদের প্রথমেই শিক্ষা দেয়া হয়- আমরা'ই সেরা। অন্য সবাই গরু ছাগল। সুতরাং গরু-ছাগলের সঙ্গে তো এমন ব্যাবহার করাই যায়!


যা হোক, সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। সেখানেও দেখি একই কাণ্ড!সহকর্মী যারা বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসছে, তারা অন্যদের সঙ্গে মিশতেই চায় না কিংবা মিশলেও ভালো ভাবে জানান দেয়- আমরা কিন্তু তোমাদের চাইতে আলাদা!


দেশের পাঠ চুকিয়ে আসলাম বিদেশে। সুইডেনের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। যেই বিষয় নিয়ে পড়ছি, সেটা পড়তে বাংলাদেশ থেকে আরও কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসছে। এর মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছে এমন দুই-একজন ছিল।


এদের একজন তো আমাকে একদিন প্রশ্ন করেছে, আপনি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এখানে চান্স পেলেন কিভাবে?অর্থাৎ বিদেশে এসেও রক্ষা নেই। সেখানেও নিজেদের ভাব কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে হবে! অথচ যে কিনা এই প্রশ্ন করেছিল, সে বোধকরি এখন হোটেল-রেস্টুরেন্টে ক্লিনিং করে বেড়ায়।


কোন কাজই খারাপ না। বরং এই কাজটাও সম্মানের। আমি তাকে ছোট করার জন্য বলছি না। ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য বলতে হচ্ছে।


আমি এখন ছোট্ট যেই শহরে থাকি, কতো হবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশির সংখ্যা? শ'দেড়েক হবে হয়ত।এদের মাঝে যেই ছেলেটা কিংবা মেয়েটা এখানকার বড় কিংবা পাবলিক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এই এক'ই শহরে থাকা প্রাইভেট কিংবা ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ম করে ছোট করে।


এই হচ্ছি আমরা বাংলাদেশি'রা। দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েও কোনো ফায়দা হচ্ছে না। স্বভাব একই থেকে যাচ্ছে! আমার ধারণা চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহে গেলেও আমাদের স্বভাব এমনই থাকবে!


এই মেয়েটা আত্মহত্যা করার পর আপনারা যারা এখন সবাই খুব আফসোসের সঙ্গে সহানুভূতি মিশিয়ে নানান সব লেখা লিখছেন কিংবা কথা বলছেন; দয়া করে একটু ভেবে বলুন তো- এই জীবনে আপনি নিজে কি কখনো উপরে বর্ণনা করা আচরণগুলো'র একটিও কারো সঙ্গে করেন'নি?


যে কোন কারণেই হোক, এর যদি সামান্য টুকু আচরণও করে থাকেন, তবে জেনে রাখুন-আপনার কথা কিংবা ব্যাবহারও হয়ত কারো-না-কারো জীবন ধ্বংস কিংবা আত্মহত্যার জন্য দায়ী।


আগে তো নিজেরা ঠিক হই, তারপর না হয় অন্য সব কিছু নিয়ে মন্তব্য করা যাবে।


আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com